করোনার কোনো জাতি, ধর্ম, বর্ণ ভেদ নেই। বলা যায় করোনা একটি অসাম্প্রদায়িক, অবর্ণবাদী কিন্তু সাম্রাজ্যবাদী রোগ। পৃথিবীর সব দেশেই করোনা হানা দিয়েছে। শক্তিধর রাষ্ট্র আমেরিকার প্রেসিডেন্ট প্রথমদিকে করোনাকে চাইনিজ ভাইরাস বলে দায় চাপানোর চেষ্টা করলেও শেষমেষ করোনা আমেরিকাকেও ছাড়েনি। ইতালিও ভেবেছিল তাদের কিছু হবে না। ইউরোপে আজ ইতালির অবস্থাই সবচেয়ে নাজুক। স্পেনের অবস্থাও একই। আর বিশ্বের মধ্যে এখন সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় রয়েছে আমেরিকা। সেখানে মোট মারা গেছে ৩৯ হাজার ১৫ জন আর গত ২৪ ঘণ্টায় মারা গেছে ১ হাজার ৮৪৯ জন।
এটি একটি বৈশ্বিক মহামারি। পুরো বিশ্ব আজ একটি মহামারির সামনে থমকে দাঁড়িয়েছে। যেখানে মানুষের জীবন সেখানেই করোনা। যেখানে করোনা সেখানেই মৃত্যু। ফলে জীবন, মৃত্যু ও করোনা আজ একাকার। জীবন ও মৃত্যুর ভেদরেখায় দাঁড়িয়ে আছে করোনা।
বাংলাদেশে করোনা আঘাত করেছে মার্চের প্রথম সপ্তাহেই। এ পর্যন্ত মারা গেছেন ৯১ জন। করোনা রোধে প্রায় এক মাস ধরে চলছে বিভিন্ন মাত্রার লকডাউন। সব কিছুই বন্ধ। চলছে সামাজিক সঙ্গরোধ। কিন্তু লকডাউনে সবার জীবন এক রকম চলে না। গরিবের কাছে লকডাউন মানে কাজ-কাম নাই, পেট চালানো দায়। সরকার সে কথা মাথায় রেখে ত্রাণ সরবরাহের উদ্যোগও নিয়েছে। ইতোমধ্যে প্রণোদনার ঘোষণাও দেয়া হয়েছে। চাল-ডাল-তেল তথা নিত্য ভোগ্যপণ্য নিম্ন আয়ের মানুষের মধ্যে বিতরণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এ মুহূর্তে নিম্নবিত্ত মানুষের কাছে করোনার চেয়ে ক্ষুধার ভয়ই বেশি। তাদের কোনো কাজ নেই তাই পেট চালানোর উপায় নেই।
করোনা থেকে রক্ষার উপায় হচ্ছে ঘরে থাকা। জনবিচ্ছিন্ন হয়ে ঘরে বসে থেকে তো আর পেট চলে না। এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের পক্ষেই ঘরে বসে থেকে রুটি রুজির ব্যবস্থা করা সম্ভব না। করোনা না হয় ক্ষুধা -নিম্নবিত্ত মানুষকে এ দুয়ের মধ্যে একটিকে বেছে নিতে হচ্ছে। দেশের প্রায় ১৭ কোটি মানুষের মধ্যে পাঁচ কোটি মানুষের কোনো স্থায়ী ও নিয়মিত রুজির ব্যবস্থা নেই। তারা দিন আনে দিন খায়। চাকরি করা নিম্ন আয়ের মানুষের একটি বড় অংশ পোশাক কারখানায় কাজ করে। সেখানেও বেতন নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে ফি বছর। করোনাকালে এ অনিশ্চয়তা আরও প্রকট হয়েছে। সরকার প্রণোদনা দিয়েছে। কিন্তু সে প্রণোদনা শ্রমিকের পকেটে যাবে কিনা এ নিয়ে সন্দেহ আছে। তাদের বর্তমান মজুরির দেখা নেই, বকেয়া মজুরির তো কথাই নেই। তার ওপর চলছে ছাঁটাইয়ের হুমকি।
সবার আয় এক নয়, ব্যয়ও এক নয়। তাই করোনা বা লকডাউনের প্রভাবও সবার কাছে এক রকম নয়। অনেকেই লকডাউন উদযাপন মোরগ পোলাও দিয়ে শুরু করেছিলেন। ধীরে ধীরে তারা এখন ডিম আর আলু ভর্তায় নেমে এসেছেন। সমাজের উচ্চবিত্তদের এ নিয়ে চিন্তা নেই। বছরের পর বছর বিরিয়ানি খেলেও পয়সার ঘাটতি হবে না। কিন্তু যারা দিন আনে দিন খায় তাদের পাতে সারা বছরই ডাল, আলু ভর্তা বড় জোর একটি ডিম জোটে। এখন তাদের আয় রোজগার নেই। তারা এখন কী খায়, কীভাবে চলে এটাই করোনাকালের সবচেয়ে বড় মানবিক প্রশ্ন।
সরকার সরকারের কাজ করেছে। সীমিত সম্পদ নিয়ে সে মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে। ওদিকে মুনাফাখোর ও লুটপাটকারীরাও ঝাঁপিয়ে পড়েছে গরিবের চাল, তেল মজুদ করতে। দুর্ভিক্ষ ও মহামারির সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ মজুতদার ও লুটপাটকারীরা। এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া জরুরি। স্বাধীনতার পরের দুর্ভিক্ষে একদিকে মানুষ না খেয়ে মরেছে আরেকদিনে চোরের দল চুরির মহামারি শুরু করেছে।
তাই মহামারি শুধু রোগের নয়, চুরির। মহামারির সময় সরকার ও রাষ্ট্রকে যুগপথ দুই মহামারির বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নিতে হয়। বরং সরকারের পক্ষে চুরির মহামারি ঠেকানো কঠিন হয়ে পড়ে। সরকারকে এখনও সে কাজটিই করতে হবে। দুর্ভিক্ষ ও মহামারির সময় সমাজের একটি শ্রেণি বিশাল সম্পদের মালিক হয়ে যায়। কাজেই রাষ্ট্রকে এখন এদের বিরুদ্ধে সজাগ থাকতে হবে। এরা বদনামের ভাগী নয়। ভাবমূর্তি নষ্ট হলে সরকারের হবে। কিন্তু এরা টাকা কামাই করবে। তাই এরা শুধু মানুষ বিরোধী নয়। এরাই আসল রাষ্ট্র ও সরকারবিরোধী।
এদিকে লকডাউনের ফলে নিম্নমধ্যবিত্তদের দিন কঠিন হয়ে উঠছে। তাদের হাতে কাঁচা টাকা পয়সা নেই। অনেক অফিসই বেতন না দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে। অনেকে আবার শুধু পুরো বেতনের বদলে বেসিক দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে। কর্মী ছাঁটাইতো আছেই। যারা এক বেলা মাছ আর দুই বেলা ডাল-সবজি দিয়ে চলতো এখন তাদের তিন বেলাই ডাল-সবজি দিয়ে চলার চিন্তা করতে হচ্ছে। তা হোক। পেটকে বুঝ দেয়া যায়। বেঁচে থাকার জন্য যেটুকু খাওয়া দরকার সেটা হলেই চলবে। পেট উঁচু না করলেও তাদের চলে। কিন্তু মাস শুরুর এক সপ্তাহের মধ্যে বাড়িওয়ালার তাগাদা তার কী জবাব দেবে নিম্ন মধ্যবিত্তরা? সরকারতো আর বাসা ভাড়া দিয়ে দেবে না। আর ভাত দুই মুঠ কম খাওয়া যায়, বাড়ি ভাড়াতো আর বেসিক দেয়া যায় না। বাড়ি ভাড়া বাকি রেখে শুধু সার্ভিস চার্জ দিলেতো বাড়িওয়ালারও চলে না।
বাড়িওয়ালারই বা দোষ কি? তারও তো এই বাড়ি ভাড়ার টাকা দিয়েই বিবি-বাচ্চাদের নিয়ে চলতে হয়। সবাইতো আর ঢাকার বুকে ৫-১০টা ফ্লাট বা বাড়ির মালিক নয়। বাড়িওয়ালাদেরও একটি বড় অংশই সারা জীবনের সঞ্চয় বা কিস্তি দিয়ে একটি দুইটি ফ্লাট করেছেন। একটিতে থাকেন আরেকটির টাকা দিয়ে চলেন। তাদেরও হাত পা বাঁধা। কাজেই করোনার কাছে সবাই জিম্মি। তবে এর মধ্যেও কিছু বাড়িওয়ালা তাদের বাড়ি ভাড়া মওকুফ করে দিয়েছেন। যারা পেরেছেন মওকুফ করেছেন। সবাই পারলেও যে করেন বা করবেন সে আশাও করি না। আবার এর বিপরীত চিত্রও আছে। ঠিক সময়ে ভাড়া দিতে না পারায় সন্তানসহ একটি পরিবারকে বাসা থেকে বের করে দেওয়ার খবরও দেখি গণমাধ্যমে।
মহামারি এক কঠিন সময়। অনেক মানবিকতা ও অমানবিকতার চিত্রই আসবে ভবিষ্যতে, যদি না সহসা এ মহামারি থেকে মুক্তি মেলে। আশা করি দ্রুতই কেটে যাবে এ মেঘ।
কিন্তু আকাশে মেঘ হলে ঘরে থাকাই নিরাপদ। মহামারি আমাদের জন্য এক মহাবিপদ সংকেত। করোনা মহামারির সময়ে ঘরে থাকাই একমাত্র প্রতিরোধক, যেহেতু কোনো প্রতিষেধক এখনও আমাদের হাতে নেই। মানুষকে নিরাপদ রাখার জন্য, বাঁচিয়ে রাখার জন্য সরকার সব কিছু বন্ধ করে দিয়েছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, অফিস, মিল কারখানা এমনকি মসজিদ-মাদরাসা ও অন্য উপাসনালয়ও বন্ধ। নিরাপদ সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করার ওপর জোর দেয়া হচ্ছে। সরকার করোনা সংক্রান্ত নিয়মিত ব্রিফিংও করছে অনলাইনে। কোরআন হাদিসের আলোকে মসজিদে নামাজও সীমিত করা হয়েছে।
কিন্তু এরই মধ্যে গতকাল ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় প্রখ্যাত ইসলামিক বক্তা যোবায়ের আহমেদ আনসারীর জানাজায় হাজারো মানুষের জনসমাগম বিদ্যমান লকডাউনকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। লকডাউন উপেক্ষা করে এই জনসমাবেশ করোনাকেই উসকে দেয়ার শামিল। স্বাস্থ্যমন্ত্রী এখানে প্রশাসনের ব্যর্থতা দেখছেন। কিন্তু একই সঙ্গে মানুষের অসচেতনতার বিষয়টি আরো বেশি দৃশ্যমান।
মনে রাখতে হবে এখন মহামারিকাল। এখন গ্রহণকাল। দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ফরজ। না পড়লে গুনাহ হবে। জামায়াতে নামাজ পড়াই ইসলামের শিক্ষা। বাংলাদেশ ও সৌদি আরবসহ পৃথিবীর অনেক দেশেই মহামারির এই কঠিন সময়ে মসজিদগুলো বন্ধ রয়েছে। মুমিন বান্দারা আজ মসজিদে যেতে না পেরে বেদনাহত। কিন্তু এরই মধ্যে ফরজে কেফায়া (যা না পড়লে গুনাহ নেই) জানাজা নামাজ পড়তে এতো মানুষের সমাগম আকাঙ্ক্ষিত ছিল না। সমাজের মুসল্লিদের পক্ষ থেকে কেউ জানাজা নামাজ পড়লেই এ নামাজ আদায় হয়ে যায়। একইভাবে ক'দিন আগেও ররগুনায় করোনাক্রান্ত আ.লীগ নেতার জানাজায়ও জনতার ঢল নেমেছিল। এসব লকডাউনের তাহলে ফায়দা কী?
লকডাউনে একদিনে খেটে খাওয়া নিম্ন আয়ের মানুষ তথা নিম্ন মধ্যবিত্তদের হাহাকার, বাড়িওয়ালার চাপ। অন্যদিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় লকডাউন ভেঙে মানুষের ঢল। সামাজিক সঙ্গভোগ ও লকডাউন একসঙ্গে চলতে পারে না।
এরশাদুল আলম প্রিন্স: কলামিস্ট