যেভাবে কোভিড-১৯ ছড়াচ্ছে এবং বৈশ্বিক অর্থনীতি রুদ্ধ হচ্ছে তা আমরা আগে কখনো দেখিনি। ১৯২৯ এ মহামন্দা এক দশক ধরে বজায় ছিল। ২০০১ এর ৯/১১ এর আক্রমণও অর্থনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছিল। ২০০৭- এ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাব-প্রাইম বন্ধকী সংকট যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসের দীর্ঘতম মন্দার সূচনা করে।
বিশ্বব্যাপী অর্থনীতি ধুকছে। আমেরিকার শ্রম বিভাগ গত দুই সপ্তাহের মধ্যে সর্বোচ্চ বেকারত্বের দাবি রেকর্ড করেছে- যা ১০ মিলিয়নের কিছু কম।
ভারতের দিকে দেখুন, যেখানে ১.৩ বিলিয়ন লোক লকডাউনে আছে। শ্রমশক্তির ৮০ শতাংশই যেখানে স্ব-কর্মসংস্থানযুক্ত বা একটি দৈনিক মজুরি উপার্জন করে। তাদের মাঝে ১২০ মিলিয়ন অভিবাসী শ্রমিক; যাদের অনেকে এখন চাকরি হারিয়েছেন।
দক্ষিণ আফ্রিকাতে সৈন্যরা ৫৭ মিলিয়ন লোকের বাড়িতে থাকা নিশ্চিত করতে টহল দিচ্ছে। দক্ষিণ আফ্রিকার ছায়া স্বাস্থ্যমন্ত্রী সিভিয়ে গোয়ারুবে মনে করেন বেকারত্বই দক্ষিণ আফ্রিকার ক্ষেত্রে সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক ইস্যু। প্রায় অর্ধেক দক্ষিণ আফ্রিকান জনগোষ্ঠীই দরিদ্র। বাস্তবতা হলো তারা যদি কাজে না যায় এবং কাজ না করে তবে তা হবে তাদের খাবার পাওয়া বা না পাওয়ার মাঝের ব্যবধান।'
তাহলে আমরা কীভাবে এই বিশ্বব্যাপী বেকারত্ব এবং অর্থনৈতিক স্থবিরতা থেকে মুক্তি পেতে পারি? আমরা হয়তোবা জোগান এবং চাহিদা আইনের সঙ্গে পরিচিত। করোনাভাইরাস দুটোকেই ঘায়েল করতে সক্ষম হয়েছে। প্রথমত, সরবরাহ খাত ধাক্কা খায় যেহেতু কারখানা, ব্যবসা এবং সীমান্ত বন্ধ হয়ে গেছে এবং তা চাহিদা খাতের ধাক্কার দিকে ধাবিত করে কারণ শিল্প কারখানাগুলোর কাঁচামালের প্রয়োজন নেই যদি তারা উৎপাদনই না করে। লকডাউন মানে লোকজন জিনিসপত্র কিনছে না অথবা কেনার সামর্থ্য নেই কারণ তারা পয়সা উপার্জন করছে না।
সমস্যাটি চীনে শুরু হয় যেখানে রোগটি ডিসেম্বরে প্রকৃতপক্ষে দেখা যায় এবং জানুয়ারিতে এর বিশাল প্রভাব পড়ে। চীন হল বৈশ্বিক সাপ্লাই চেইনের মূলভিত্তি। ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো তাই বিকল্প খোঁজা শুরু করে। চীন আন্তর্জাতিক বাজারের একটা বড় ক্রেতাও।
সবচেয়ে বড় প্রশ্ন যেটা অর্থনীতিবিদরা এখনো বোঝার চেষ্টা করছেন তা হলো এটা কি 'ভি' আকৃতির মন্দা নাকি 'ইউ' আকৃতির মন্দা অথবা ''এল'' আকৃতির মন্দা। 'ভি' আকৃতির মন্দাতে অর্থনীতির দ্রুত পতন ঘটে কিন্তু দীর্ঘ অর্থনৈতিক কাঠিন্য এবং দীর্ঘস্থায়ী মন্দার বদলে অর্থনীতি তাড়াতাড়িই ঘুরে দাঁড়ায়। এখন, সবচেয়ে উৎসাহদায়ক খবর আপাতত আমরা যা পেয়েছি তা হলো, চীনের ক্ষেত্রে এটি একটি 'ভি' আকৃতির মন্দা। এখন, চীন যদি তা করতে পারে তাহলে আশা হল যে ইউরোপ আমেরিকাও তা পরে করতে পারবে। ইউরোপিয়ান এবং আমেরিকানরা নজিরবিহীনভাবে সরকারি সাহায্য লাভ করছে। করোনাভাইরাস মহামারিতে অস্থির অর্থনীতির জন্য ব্রিটিশ সরকার ইতিমধ্যে ৩৩০ বিলিয়ন পাউন্ড এবং যুক্তরাষ্ট্রের সিনেট ২.২ ট্রিলিয়ন ডলারের প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে।
এই সকল স্বল্পমেয়াদী সুরক্ষা প্যাকেজ হয়তোবা অর্থনীতির ক্ষতি হ্রাস করতে পারে। কিন্তু এই মহামারি দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে। ফলে, সরকারগুলোর জন্য কঠিন হিসাব হলো করোনাভাইরাসে মৃত্যু বনাম আর্থিক ক্ষতির হিসাব করা।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে বিগত ৭৫ বছরে বিশ্ব এমন কিছুর সাক্ষী হয়নি। সরকারও এ মাত্রায় কখনো সাড়া দেয়নি। তাই, যদিও এটা ভয়ানক একদিক দিয়ে, তবে এটা আমাদের মানবিক দিকটাও দেখায় যে আমরা আমাদের মৃত্যুর সংখ্যাটাও কমাতে চাই।
মো. শরীফ হাসান: শিক্ষক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়