বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়টি বর্তমানে সবচেয়ে বেশি আলোচিত হচ্ছে। বাংলাদেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সাধারণ মানুষের খাদ্য নিরাপত্তার চিন্তাও বেড়ে চলেছে। গত ১ এপ্রিল জাতিসংঘের তিন অঙ্গসংগঠন খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও), বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) ও বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) এক যৌথ বিবৃতিতে মহামারি করোনাভাইরাস সংকট যদি মোকাবেলা করা না যায়, তাহলে গোটা বিশ্ব খাদ্য সংকটে পড়বে বলে সতর্ক করেছে।
উল্লেখ্য, গত তিন দশকে নানা কারণে বিশ্ব অর্থনীতি মন্দার মুখে পড়লেও বাংলাদেশে তার প্রতিক্রিয়া পড়েনি। বরং অনেক ক্ষেত্রে বৈশ্বিক মন্দায় লাভবান হয়েছে বাংলাদেশ। কিন্তু এবার করোনাভাইরাসের কারণে বিশ্ব যে অনিবার্য অর্থনৈতিক মন্দার শিকার হতে যাচ্ছে তার ভুক্তভোগী হবে প্রতিটি দেশ, প্রতিটি জাতি।
বাংলাদেশে আগামী ২৫ এপ্রিল পর্যন্ত সাধারণ ছুটিতে বন্ধ কলকারখানা, অফিস-আদালত এবং উৎপাদন কেন্দ্র। পরিস্থিতি সম্পূর্ণ অনুকূলে না এলে আরও দীর্ঘায়িত হতে পারে এই লকডাউন প্রক্রিয়া।
যেকোনো রাষ্ট্র নাগরিকের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে- এমনটি খুব স্বাভাবিক। কারণ খাদ্য অধিকার নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের অন্যতম দায়িত্ব। একজন নাগরিকের মর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকার জন্য উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করতে হয় রাষ্ট্রকে। বর্তমান সংকটে বাংলাদেশ সরকারও বিশেষ মনোযোগের সাথে জনগণের খাদ্য নিরাপত্তা প্রদানের চেষ্টা করে যাচ্ছে। এই নিরাপত্তা নিশ্ছিদ্রভাবে সম্পন্ন করা সরকারের অন্যতম একটি চ্যালেঞ্জ। কারণ ইতোমধ্যেই দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ত্রাণ বণ্টনের বিষয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এসব অনিয়ম বন্ধ করতে প্রধানমন্ত্রীর কঠোর হুঁশিয়ারি সত্ত্বেও তা বন্ধ করা সম্ভব হচ্ছে না।
এ মুহূর্তে সরকারিভাবে, দলীয়ভাবে এবং ব্যক্তিগত ও তৃণমূল পর্যায়ে যেসব স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী রয়েছে তাদের বেশিরভাগই আন্তরিকভাবে খাদ্য নিরাপত্তার ইস্যুটি মোকাবেলা করার চেষ্টা করছে। কিন্তু বিভিন্ন কারণে নানা ধরনের অব্যবস্থাপনার খবরও পাওয়া যাচ্ছে।
আগামীতে এই সংকট যত দিনই থাকুক না- তা যথাযথভাবে নিয়ন্ত্রণের ওপরই রাষ্ট্রের সার্বিক নিরাপত্তা নির্ভর করছে। রাষ্ট্রের এই চ্যালেঞ্জ ক্রমেই ঘনীভূত হচ্ছে। বিশেষ করে আর কয়েকদিন পরেই যেহেতু রমজান শুরু হবে। সেহেতু জনগণের খাদ্য চাহিদার ওপর খানিকটা বাড়তি প্রভাব পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। মোটাদাগে করোনাভাইরাস এবং রমজানের দ্বৈত প্রভাবে দেশের খাদ্য নিরাপত্তায় সংকট তৈরি হওয়ার শঙ্কাটি অনেকটা দৃশ্যমান হতে শুরু করেছে।
সার্বিক পরিস্থিতি কেমন হতে পারে তা অনুমান করতেই আমরা শঙ্কিত ও আতঙ্কিত হয়ে উঠছি। যদিও প্রধানমন্ত্রী বারবার আশ্বস্ত করছেন যে, পর্যাপ্ত পরিমাণে খাদ্য মজুদ রয়েছে। তিনি সাধারণ জনগণকে শঙ্কিত না হতেও পরামর্শ দিয়েছেন বারবার। এমনকি তার প্রদত্ত ৩১দফা নির্দেশনাতেও আসন্ন ব্যাপক অর্থনৈতিক মন্দা মোকাবেলায় সর্বোচ্চ খাদ্য উৎপাদনসহ সার্বিক পরিকল্পনা গ্রহণের উপর জোর দেওয়া হয়েছে।
কিন্তু চিরাচরিত একটি প্রবাদের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। সেটি হলো- ‘চোরে না শোনে ধর্মের কাহিনী’। প্রধানমন্ত্রী যতই বলুক নানা ধরনের চাটুকারিতা, চৌর্যবৃত্তি সকল শুভ কাজকে ক্ষেত্রবিশেষে নষ্ট করে দিচ্ছে।
গত বেশ কিছুদিন থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি বিষয় খুবই সমালোচিত হচ্ছে। সেটি হলো, প্রধানমন্ত্রীর সাথে ভিডিও কনফারেন্সে দু’একটি ব্যতিক্রম ছাড়া জেলা প্রশাসকসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা প্রকৃত তথ্য না দিয়ে সবকিছু নিয়ন্ত্রণে রয়েছে বলে দাবি জানান। যেমন, গত ২০ এপ্রিল গাজীপুরের পুলিশ সুপারের বক্তব্যে যথেষ্ট ব্যতিক্রম লক্ষ্য করা গেছে। তিনি খুব সুস্পষ্টভাবে কিছু অভিযোগ এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন।
প্রতিবছরই রমজান মাসকে কেন্দ্র করে দেশে নিত্যপণ্যের মূল্য অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পায়। রমজানে চিনি, ভোজ্য তেল, ডাল, খেজুর ও পেঁয়াজের চাহিদা কিছুটা বাড়তি থাকার সুযোগে একশ্রেণির ব্যবসায়ী-আমদানিকারক নানা অজুহাতে এসব পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির মাধ্যমে জনদুর্ভোগ সৃষ্টি করে নিজেদের পকেট ভারী করার নেতিবাচক চেষ্টায় লিপ্ত হয়। কিন্তু খুব কম ক্ষেত্রেই এসব সিন্ডিকেটধারীদের বিচারের আওতায় আনতে দেখা গেছে। ফলে বর্তমান সংকটাবস্থাতেও তথাকথিত বাজার সিন্ডিকেট আরো সক্রিয় হয়ে নিত্যপণ্যের কৃত্রিম সংকট তৈরির ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র করতে পারে।
ইতিহাসের অভিজ্ঞতা বলে, মহামারির পর খাদ্য ঘাটতিই মানুষকে সবচেয়ে বেশি ভুগিয়েছে, তারপর অন্য মৌলিক চাহিদাগুলো। কাজেই জীবন যাপনের প্রধান অনুষঙ্গ খাদ্যে সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা মেনে সর্বস্তরের জনসাধারণকে সচেতন হতে হবে। আমাদের খাদ্য নিরাপত্তার জন্য যা যা উৎপাদন দরকার আমাদের এখন থেকে উদ্যোগ নিতে হবে। তবে সচ্ছলদের ক্ষেত্রে বলতে চাই, দেশের এই সংকটকালীন সময়ে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আপনাদের কাজ করতে হবে। বিশেষ করে বাজার স্থিতিশীল রাখতে তথাকথিত ঘরোয়া মজুদ করার প্রবণতা থেকে সবাইকে বেরিয়ে আসতে হবে।
চলমান এই ভয়াবহ সংকট ব্যক্তি পর্যায় থেকে আন্তরিকভাবে মোকাবেলা করতে না পারলে শুধু সরকার কিংবা প্রশাসনের পক্ষে তা করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। বাস্তবতা ও পরিস্থিতিকে যথাযথভাবে অনুধাবন করে দুর্যোগ মোকাবেলা করা আমাদের সকলের কর্তব্য। সরকারের সমালোচনা করা বা সরকারের কাছে আমাদের চাওয়া, পাওয়া থাকতেই পারে। আমার মনে হয় এই সময়ে সকল চাওয়া-পাওয়ার ঊর্ধ্বে থেকে সরকার যেভাবে সহায়তা করছে, দল-মত-ব্যক্তি নির্বিশেষে আমাদেরকেও এই সহযোগিতায় শামিল হতে হবে।
ড. সুলতান মাহমুদ রানা: সহযোগী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়