দেশে বরাবরই কোনো না কোনোভাবে প্রতি মৌসুমেই কৃষকরা তাদের চাষাবাদ নিয়ে হতাশায় পড়ছেন। অথচ দেশের সরকার প্রতিবারই নির্ধারিত মূল্য বেঁধে দিচ্ছে কৃষকদের কাছ থেকে ফসল কেনার জন্য। চাল, ডাল, গম, ভুট্টার পাশাপাশি নিত্যপ্রয়োজনীয় সবজির দাম নিয়েও প্রায়ই লোকসান গুনতে হচ্ছে তাদের। নতুন করে করোনার আবির্ভাব পুরো অর্থনীতিতে ধাক্কা দিচ্ছে এটি যেমন সত্য তেমনি কৃষকরা লোকসান গুনে গুনে করোনা পরবর্তী সময়ে খাদ্যশূন্য পরিস্থিতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে পুরো দেশ এটিও বেশ স্পষ্ট।
দেশ যখন ক্রান্তিকাল অতিবাহিত করছে সে সময়ে দেশের অধিকাংশ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান তাদের ব্যবসায় লোকসান গুনছে। বিভিন্ন অর্ডার বাতিল হয়ে গেছে। শ্রমিকদের বেতন ভাতার জন্য সরকার প্রণোদনা দিচ্ছে। কিন্তু পুরো দেশের মানুষকে যারা ফসল ফলিয়ে বাঁচিয়ে রাখছেন তাদের জন্য ঠিক কতটা ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে সেদিকে চোখ রাখা প্রয়োজন। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী ক্ষুদ্র ও মাঝারি কৃষকদের জন্য ৫% সুদে পাঁচ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনার ঘোষণা দিয়েছেন। তিনি নিজেও স্বীকার করেছেন যে করোনার পরপরেই খাদ্যের তীব্র সংকট দেখা দিতে পারে। সেদিক থেকে খাদ্য মন্ত্রণালয়কে বেশি পরিমাণে ক্রয় করার নির্দেশও দেন তিনি।
প্রতিবছরই নির্দেশ দেয়া হয় যাতে কৃষক তার ন্যায্যমূল্য পায়। কিন্তু গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে বাস্তব চিত্র দেখা মেলে উল্টো। প্রতিবারই ফসলের দামে লোকসান আর কৃষকের হাহাকার ভরা করুন চিত্র ফুটে ওঠে। সিন্ডিকেটের দাপটে কখনও খামারি তার দুধ ডিম রাস্তায় ফেলে আবার কৃষক তার যত্নে গড়া ফসল মাঠেই নষ্ট করে দেয়। এতদিন ধরে খণ্ড খণ্ডভাবে বিষয়গুলো ফুটে উঠলেও করোনার প্রভাবে অধিকাংশ কৃষকের ফসলের দাম তলানিতে এসে ঠেকেছে।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত বেশ কিছু প্রতিবেদনে দেখা যায়, ময়মনসিংহে পুইশাকের দাম না পেয়ে জমিতেই হাল দিয়ে দিচ্ছেন চাষি। দিনাজপুরেও কৃষকদের আবাদকৃত সবজির মধ্যে করলা, কাঁচা মরিচ, ক্ষিরা, বেগুন, মিষ্টি কুমড়া, লাউ, টমেটো বিক্রি হচ্ছে পানির দরে। দাম হারিয়েছে টাংগাইলের সবজি চাষিরাও। বরিশালের তরমুজ বাজারে আসার মৌসুমেই হারাচ্ছে দাম। পাইকাররা কিনেও খুব একটা স্বস্তি পাচ্ছেন না। এছাড়া দুধ, ডিম, মুরগীসহ বিভিন্ন খামারিরা ক্রমশই লোকসানের দিকে যাচ্ছে।
শুধু তাই নয়, বাংলাদেশ ও ভারতের আবহাওয়া অধিদপ্তরের পূর্বাভাস অনুযায়ী চলতি সপ্তাহ থেকেই মেঘালয় এবং ভারত অববাহিকায় ১৫০-২৫০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে। এছাড়া বাংলাদেশের অভ্যন্তরেও উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বৃষ্টিপাত হতে পারে। এতে করে হবিগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, সিলেট, নেত্রকোনা ও কিশোরগঞ্জ জেলার হাওর অঞ্চলের প্রধান নদীসমূহের পানি সমতল অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পেয়ে বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। যদি কোনভাবে করোনার মধ্যেই বন্যা দেখা দেয় তাহলে চাষির বোরো শস্য বাড়িতে তোলার আগেই মাঠে তলিয়ে যাবে।
সত্যিকার অর্থে কৃষকদের বাঁচাতে করোনা পরবর্তী সময়ে খাদ্যের অভাব পূরণ করতে চাইলে এখন থেকেই কৃষকদের ফসল ন্যায্য মূল্যে ক্রয় করা উচিত। প্রয়োজনে ভর্তুকি দিয়ে হলেও কৃষকদের বাঁচিয়ে রাখা প্রয়োজন। বিশেষ করে সরকার যেহেতু ত্রাণ কার্যক্রম হাতে নিয়েছে সেদিক থেকে প্রতিটি জেলায় প্রশাসনের মাধ্যমে তাদের ফসল ক্রয় করে তা রিলিফ সেন্টার বা স্বল্প মূল্যে বিক্রির ব্যবস্থা করতে পারে। কৃষকদের ঘরে তুলনামূলক খাবার সঞ্চিত থাকলেও নগদ টাকা খুব কমই থাকে তাদের কাছে। করোনার প্রাদুর্ভাবে কোন কারণে যদি অধিকাংশ কৃষক তার ফসলের ন্যায্য মূল্য না পায় তবে তার ক্ষতি পুষিয়ে নিতে ভিন্ন দিক চিন্তা করার আগেই তার ফসলের লাভ নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
চলমান পরিস্থিতি যদি ধরে নেয়া হয় রোজার ঈদের পরেই করোনা মুক্ত হবে দেশ, তাহলে তখন থেকেই খাদ্যের চাহিদা বেড়ে যাবে। সেদিক বিবেচনায় রাষ্ট্রের প্রধান কাজ এখনই কৃষককে তার ফসলের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করা। চাহিদা অনুযায়ী যোগানে ব্যর্থ হলে খাদ্যদ্রব্যের দাম এতটাই আকাশচুম্বী হতে পারে যে খাদ্যদ্রব্য কেনার জন্যেই দেশজুড়ে বাড়বে আইনশৃঙ্খলার অবনতি আর নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্তের ঘরে চলবে নীরব দুর্ভিক্ষ।
সাবিত আল হাসান: ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম