করোনা ও বাংলাদেশ: প্রয়োজন গবেষণায় মনোযোগ

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

মো. হামিদুল ইসলাম | 2023-09-01 22:47:03

এক
বাংলাদেশের একটি ইঞ্জিনিয়ারিং ভার্সিটির ছাত্র আজাদ। শেষ বর্ষে এসে গবেষণার বিষয় নিয়েছে গ্রিন বিল্ডিং। তার গবেষণা সফল হলে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা, বাইরের এনার্জি সোর্স ব্যবহার ও অর্থ সাশ্রয় হবে। কিন্তু এই গবেষণার ফান্ড কোথায়? ফান্ড খুঁজতে হাঁসফাঁস হয়ে রাস্তায় ঘুরতে থাকে এই মেধাবী। কোনভাবেই টাকার ব্যবস্থা করতে পারে না। গবেষণার প্রপোজাল নিয়ে আবেদন করে বিদেশে। ভিসা হলেই বাংলার এই উজ্জ্বল নক্ষত্রটি পাচার হয়ে যায়।

দুই
বাংলাদেশের কৃষিক্ষেত্রে যে সফলতা তা সম্ভব হয়েছে কেবলমাত্র এবং শুধুমাত্র কৃষিবিদ শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের গবেষণার জন্য। কিন্তু সেখানে গবেষণার ফান্ড কই? কৃষিবিদরা নতুন নতুন ফসলের জাত আবিষ্কার করে চলেছেন। কিন্তু এরা কোনদিন মিডিয়ার চোখে পড়ে না। এরা কোন দিন লাইম লাইটে আসে না।।

তিন
মেডিকেলের যে ছেলেটা আজ একটা রোগ নিয়ে গবেষণা করছে, হয়তো তার জন্যই এদেশ কোটি কোটি টাকার ক্ষতি থেকে বেঁচে যাবে। কিন্তু তার এই গবেষণার বিষয় এবং অর্থ কোন দিনই কারো নজরে আসে না। পদ-পদবী, সম্মান ও শক্তিতে অন্যদের থেকে তলানিতে থেকে যায়। রাষ্ট্রের শ্রেষ্ঠ এই মেধাবীরা সবজান্তা শমসেরদের কবলে দিশা হারা। কেউ কেউ বিদেশ পাড়ি জমাই। কেউবা দেশটাকে ভালবেসে ধুকে ধুকে বেঁচে থাকে।

চার
গত বছর আমরা কুয়েটে বিল্টেক ফেস্ট করেছিলাম। এখানে দুই লাখ টাকা যোগাড় করতে গিয়ে গায়ের ঘাম ঝরে গিয়েছিল। অথচ সেখানে যেসব আইডিয়া এবং প্রজেক্ট এসেছিল, তা দেখলে আপনি চমকিত হবেন। শুধুমাত্র অর্থের অভাবে এই প্রজেক্টগুলো বাস্তবের মুখ দেখতে পারে না। যদি বাস্তবে রূপ দেয়া যেত তাহলে লাভবান হতো, দেশের টাকা দেশেই থাকত।

পাঁচ
গত বছরের আগস্টে ছাত্রদের নিয়ে দুইটা গ্রিন বিল্ডিং প্রজেক্ট ভিজিট করেছিলাম। সেখানে জানতে পারলাম এই সব প্রজেক্টের কনসালটেন্ট ভারত বা শ্রীলঙ্কার। এদের বেতন মাসে কয়েক লাখ ডলার। পদ্মা সেতুর বেশীর ভাগ ইঞ্জিনিয়ার দেশের বাইরের। যারা প্রতিমাসে কোটি টাকা এদেশ থেকে নিয়ে যাচ্ছে। অথচ আমরা বলছি নিজের টাকায় পদ্মা সেতু বানাচ্ছি। কিন্তু কবে বলব নিজের টাকায় এবং নিজের লোকবল দিয়ে পদ্মা সেতুর মত সেতু বানাচ্ছি। সেই কথাটা বলার জন্য দরকার নিজের লোকদের উন্নতি এবং অর্থ বিনিয়োগ ও গবেষণা। সেদিকে কারো ভ্রুক্ষেপ আছে কি? হাজার হাজার শ্রমিকের সাথে সাথে কিছু সংখ্যক মানসম্পন্ন ইঞ্জিনিয়ার বা ডাক্তার বা গবেষক বানান। দেশটা পাল্টে যাবে মুহূর্তেই।

ছয়
মনে আছে- মালয়েশিয়া কিভাবে উন্নতি করেছে? নিজের মেধা নিজের দেশে রেখেছে। নিজের দেশের মেধার উন্নতির জন্য অর্থ বিনিয়োগ করেছেন। শুনেছি, একবার মালয়েশিয়ার প্রেসিডেন্ট মাহাথির মোহাম্মদ একটা রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন- যতদিন এই রোগের চিকিৎসা আমার দেশে আবিষ্কার না হয়, ততদিন আমি অপারেশন করাবো না। পরবর্তীতে ঠিকই তিনি মালয়েশিয়াতেই সেই অপারেশন করিয়েছিলেন। এটাই নিজের উন্নতির জ্বলন্ত প্রমাণ।

সাত
দিনকে দিন রাজনৈতিক কার্যকলাপ থেকে শুরু করে দেশের নীতি নির্ধারক কর্মচারীরা কেমন যেন গোলমেলে হয়ে যাচ্ছেন। এই করোনার পরিস্থিতিই ধরুন না। চীনে বিস্তার থেকে বৈশ্বিক বিস্তার পর্যন্ত বাংলাদেশ অনেক সময় পেয়েছে। কিন্তু শুধু কথার থুবড়ি ছিটিয়েছেন আমাদের কর্তা ব্যক্তিরা। অমুক আছে, তমুক আছে। আমরা তমুক দেশের থেকে উন্নত ইত্যাদি কথা-বার্তার ফুলঝুরি। নেই কোন সুনির্দিষ্ট গবেষণা। আমার কতটা ডাক্তার লাগবে, কতটা আইসিইউ বেড আছে, কি পরিমাণ পিপিই লাগবে, পরিস্থিতি খারাপ হলে কি করব? এই প্রশ্নগুলোর সুনির্দিষ্ট উত্তর নেই। সুতরাং জগাখিচুড়ি সম্পূর্ণ হয়ে হযবরল-এর পথে হাঁটছি আমরা। আমরা আম জনতা সেই পথে পিষ্ট হয়ে চলেছি দিন থেকে দিনান্তর।

আট
অন্যদিকে মিস ওয়ার্ল্ড বাংলাদেশ বা কন্সার্ট বা রিয়েলিটি শো- এর জন্য কোটি টাকা স্পন্সর হাতের তুড়িতেই এসে যায়। এখানে মেধার বালাই নাই। মেধা এখানে নস্যি।

নয়
ক্রিকেট বা যেকোনো খেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রচুর অর্থ ব্যয় করতে কার্পণ্য করি না। বাংলাদেশের কোন কোম্পানি আছে যে সাম্প্রতিক গবেষণায় অর্থ ব্যয় করেছে? অধিকাংশেরই উত্তর হবে, না। কতজন ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার বা কৃষিবিদ বা গবেষক গবেষণায় ফান্ড পান? প্রয়োজনের তুলনায় নগণ্য। তাহলে এখন কেন করোনার ভ্যাকসিন, পিপিই বা ভ্যান্টিলেটরের জন্য হাহাকার। কোন উত্তর দিতে পারবেন?

ভার্সিটির যে ছেলেটে টাকার জন্য গবেষণা করতে পারে না, স্পন্সরের জন্য ঘুরতে ঘুরতে পায়ের জুতা ক্ষয় করে ফেলে। শেষে টাকা না পেয়ে বিদেশে পাচার হয়ে যায়। মেধা হেরে যায় এই নেংটির কাছে। কবে সেই সুদিন আসবে যেদিন সবাই মেধাবীদের কদর করবে? নিজ দেশের মাথা উঁচু এবং উন্নত করার জন্য মেধার পেছনে টাকা ঢালতে হবে। গবেষণায় বরাদ্দ বাড়াতে হবে। দেশের যোগ্য মেধাবীদের প্রাপ্ত সম্মান ও পৃষ্ঠপোষকতা দিতে হবে। তাহলেই হয়তো সোনার বাংলাদেশের টেকসই উন্নয়ন হবে। দেশের কর্তা ব্যক্তিদের কবে এই শুভ বুদ্ধির উদয় হবে? সেই দিনের অপেক্ষায় রইলাম।

মো. হামিদুল ইসলাম: সহকারী অধ্যাপক, বিল্ডিং ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড ইন্সট্রাকশন ম্যানেজমেন্ট বিভাগ, খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (কুয়েট)।

এ সম্পর্কিত আরও খবর