বৈশ্বিক মহামারি করোনাযুদ্ধে বুক পেতে দিয়ে ক্লান্তিহীন লড়াই করে চলেছেন জরুরি পেশায় নিয়োজিত বাংলাদেশসহ বিশ্বের অধিকাংশ চিকিৎসক, নার্স, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য, মাঠ প্রশাসনে কর্মরত ও ব্যাংকে কর্মরত জনবল, স্বেচ্ছাসেবক এবং সংবাদকর্মীসহ অনেক পেশার মানুষ। নিজেদের জীবনে সংক্রমণের ঝুঁকি ও মৃত্যুর আশঙ্কা থাকা সত্ত্বেও থেমে নেই তাদের পেশাগত কর্মতৎপরতা, স্বাস্থ্য পরিষেবা প্রদান ও মানুষ হিসেবে মানুষের পাশে মানবিকতাবোধ নিয়ে দাঁড়ানোর স্পৃহা।
তাদের এই অবদান বিশ্ববাসীকে একদিকে যেমন কৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ করেছে, অন্যদিকে 'সবার উপরে মানুষ সত্য'-এই শাশ্বত সত্যকে আরও একবার সামনে এনেছে। মৃত্যু ঝুঁকি ও সংক্রমণের ভয়ে গোটা পৃথিবীর মানুষ যখন ঘরের মধ্যে বন্দি, তখন এই সব মানুষগুলো নিজের জীবন ও পরিবারকে ঝুঁকিতে রেখে নিজেদেরকে অকাতরে বিলিয়ে দিচ্ছেন।
দুই.
পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মত বাংলাদেশও করোনায় ক্রান্তিকাল অতিবাহিত করছে। অসহায় হয়ে পড়েছে মধ্যবিত্ত ও নিম্ন আয়ের খেটে খাওয়া মানুষেরা। ইতোমধ্যে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী করোনা মোকাবেলায় সামনের দিকে থাকা করোনাযোদ্ধাদের জন্য তালিকা তৈরি করত: পুরস্কার ঘোষণা করে ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়ে মানবিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এছাড়া তিনি উল্লেখ করেছেন, করোনাযুদ্ধের সাথে সরাসরি জড়িত প্রজাতন্ত্রের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের জন্য ৭৫০ কোটি টাকার স্বাস্থ্য ও জীবন বীমার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। এর ফল অনেক বেশি মধুর হবে বলে প্রত্যাশা করা যায়।
বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দাভাবের প্রভাবে বাংলাদেশ যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয়ে বরং দেশের অর্থনীতির চাকা সচল ও গতিশীল থাকে সেই ব্যবস্থা নেবার ঘোষণাও প্রধানমন্ত্রী দিয়েছেন। নি:সন্দেহে এটি অত্যন্ত সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত। পাশাপাশি স্বাস্থ্য অধিদপ্তর করোনা ভাইরাস সংক্রমণে আক্রান্তদের ক্ষতিপূরণের জন্য একটি পরিপত্র জারি এবং আক্রান্ত চিকিৎসক, নার্স, মেডিকেল টেকনোলজিস্ট ও অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীদের তালিকা প্রণয়নের জন্য উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা বরাবর একটি চিঠি প্রেরণ করেছে। বিষয়টি ভালো। তবে করোনা মহামারি সংক্রমণ পরিষেবা ও প্রতিকারের সাথে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত সকল পেশাজীবীর জন্য স্বাস্থ্যবীমা, সুরক্ষা ও ঝুঁকি ভাতার ব্যবস্থা থাকলে এটি আরও ভালো ও বিজ্ঞানসম্মত হবে। কখনো কখনো যে কোন ধরণের আর্থিক প্রণোদনা বড় ধরণের তাৎপর্যপূর্ণ ইতিবাচক ফলাফল বয়ে আনে।
আমরা জানি, যে কোন দুর্দিনে দেশের পাশে থাকা প্রতিটি নাগরিকের পবিত্র দায়িত্ব ও কর্তব্য। আজকের এই লেখার মাধ্যমে সরকার সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করতে চাই, বৈশ্বিক মহামারি মোকাবেলায় আক্রান্ত-অনাক্রান্ত সকল করোনাযোদ্ধাদের জন্য সামাজিক সুরক্ষা, স্বাস্থ্যবীমা ও বিশেষ ঝুঁকি ভাতা প্রদানের ব্যবস্থা করাই হবে রাষ্ট্রের জন্য ঈমানি দায়িত্ব। ব্যাংকে কর্মরত জনবলের জন্য স্বাস্থ্যবীমা ও অন্যান্য আর্থিক প্রণোদনার বিষয়টি যেভাবে বাস্তবায়ন হয়ে সামনে এসেছে, ঠিক একইভাবে করোনা সংক্রমণ কার্যক্রমের সাথে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত আক্রান্ত-অনাক্রান্ত সকলের জন্য বিষয়টির আশু বাস্তবায়ন জরুরি। এতে একদিকে আক্রান্ত জনবল যেমন সুবিধা পাবে, তেমনি অনাক্রান্তরা কাজে অনেক আন্তরিক হবে এবং স্বাস্থ্য পরিষেবা প্রদানে অনুপ্রেরণা পাবে।
তিন.
সময় এখন স্বাস্থ্যখাতের সব শাখা-উপশাখাগুলোকে সচল ও সক্রিয় করার মাধ্যমে কিছু সমাজতাত্ত্বিক সুপারিশ বাস্তবায়ন করা। যেমন
১. ব্যক্তিগত ও পারিবারিক সুরক্ষার ব্যাপারে অধিক সচেতনতা ও সতর্কতা অবলম্বন করা।
২. পুরো দেশকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অঞ্চলে বিভক্ত করে আঞ্চলিক পর্যায়ে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র স্থাপন করা।
৩. কমিউনিটি ক্লিনিকসহ সকল স্বাস্থ্যকর্মীদের মাধ্যমে সতর্কতার সাথে স্বাস্থ্য পরিষেবা ব্যবস্থা গ্রামীণ ও শহর পর্যায়ে সচল রাখা। ৪. কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোতে 'মোবাইল হেল্প লাইন' চালু করা।
৫. সার্বক্ষণিক এ্যাম্বুলেন্স সার্ভিস সচল রাখা।
৬. আঞ্চলিক কেন্দ্রগুলোর সাথে জেলা পর্যায়ের সরকারি হাসপাতাল এবং ক্ষেত্র বিশেষে নিকটবর্তী মেডিকেল কলেজের সাথে সমন্বিত উপায়ে নিবিড় যোগাযোগ ব্যবস্থা সচল রাখা।
৭. অতিদ্রুত প্রত্যেক এলাকার ইমাম, পুরোহিত, শিক্ষক-শিক্ষার্থী, স্থানীয় সরকারের চেয়ারম্যান-সদস্য, এলাকার সম্মানী ও সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিবর্গের সমন্বয়ে স্থানীয় কমিটি তৈরি করা, যারা করোনা মোকাবিলায় সার্বিক যোগাযোগ; সুষ্ঠুভাবে ত্রাণ বিতরণ; মসজিদ, মন্দির, গির্জা থেকে মাইকের মাধ্যমে স্থানীয় অধিবাসীদেরকে সচেতন ও সতর্ক করার ব্যবস্থা করবেন।
৮. সেনাবাহিনীসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাথে স্থানীয় কমিটির যোগাযোগ ব্যবস্থা চালু করা
৯. কোনভাবে যেন কোথাও 'উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা' তৈরি না হয়, সেদিকে নজর রাখা।
১০. ত্রাণ বিতরণ কর্মকাণ্ড পুলিশ ও সেনাবাহিনীর নজরদারিতে রাখা।
১১. প্রত্যেক বাড়ি ও ধর্মীয় উপাসনালয়ে সকাল-সন্ধ্যা বিশেষ প্রার্থনার ব্যবস্থা করা।
১২. কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে না পৌঁছানো পর্যন্ত 'লকডাউন,সঙ্গরোধ ও সামাজিক দূরত্ব' ব্যবস্থাকে জোরদার রাখা।
১৩. সাধারণ জ্বর, সর্দি-কাশি নিরাময়ের জন্য ঔষধ গ্রহণে কালক্ষেপণ না করা এবং সাধারণ রোগী যেন উদ্বিগ্ন না হয় সে ব্যাপারে চিকিৎসক, নার্স ও কমিউনিটি স্বাস্থ্যকর্মীদের সংবেদনশীল আচরণ করা।
১৪. সরকারি নির্দেশনা, আইইডিসিআরের ঘোষণা, স্থানীয় প্রশাসন ও স্বাস্থ্য পরিষেবা কেন্দ্রের স্বাস্থ্যকর্মীদের উপদেশ মেনে চলা, ইত্যাদি।
বিষয়টি ভালো যে, বাংলাদেশের সরকার সামাজিক সুরক্ষা খাতকে জোরালো করে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ভার নিয়েছেন। স্বল্প আয়ের মানুষের জন্য সম্পূর্ণ বিনামূল্যে খাদ্য সামগ্রী বিতরণের জন্য গম এবং চাল বরাদ্দ করেছেন। দিন আনে দিন খায় এমন খেটে খাওয়া মানুষ, রিকশা-ভ্যান চালক, অন্যের বাড়িতে কাজ করে খাওয়া গৃহ পরিচারক-পরিচারিকা, শ্রমিক, মজুর, দরিদ্র, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী, সমুদ্রতীরবর্তী জনগোষ্ঠী, চা শ্রমিক, হত দরিদ্র কৃষক প্রভৃতি নানা শ্রেণি পেশার অসহায় মানুষ খাদ্য ও স্বাস্থ্য ঝুঁকির মধ্যে পড়ে গেছেন। যাদের চোখে এখন অন্ধকার। সরকার ঘোষণা করেছে আগামী তিন মাস বিনামূল্যে চাল বিতরণ করবে এবং প্রয়োজনে ভর্তুকিও প্রদান করবে। তবে লক্ষ্য রাখা জরুরি 'মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা ও উন্নয়নের বাংলাদেশকে' সুরক্ষা ও টিকিয়ে রাখার জন্য বরাদ্দকৃত চাল-গম যেন সরকার, রাষ্ট্র, জনগণ ও মানবতার শত্রুরা খেয়ে না ফেলে।
বাংলাদেশ বিশ্বব্যবস্থার অবিচ্ছেদ্য অংশ। সুতরাং বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার নেতিবাচক প্রভাব বাংলাদেশে যাতে না পড়ে সেদিকে এখন থেকে নজর দিতে হবে। অর্থনীতির মুদ্রাস্ফীতির বিষয়টি মাথায় রেখে বর্তমান অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য আগে-ভাগে রাষ্ট্রীয় অর্থনীতির সমাজতত্ত্ব আমাদের সময়মত বুঝতে হবে।
মোহাম্মাদ আনিসুর রহমান: পিএইচডি গবেষক, প্রাথমিক ও কমিউনিটি স্বাস্থ্য পরিষেবা-বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট, ঝেজিয়াং ইউনিভার্সিটি, চীনএবং শিক্ষক ও সাবেক চেয়ারম্যান, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, বশেমুরবিপ্রবি, গোপালগঞ্জ।