১.
‘আমরা তো অল্পে খুশি,
কী হবে দুঃখ করে?
আমাদের দিন চলে যায়
সাধারণ ভাতকাপড়ে।’
এটি জনপ্রিয় কবি জয় গোস্বামী’র বিখ্যাত ‘আমরা তো অল্পে খুশি’ কবিতার প্রথম চার লাইন। কি অসাধারণ কবিতা। দারিদ্র আর অভাবকে কবি কি চমৎকার লেখনীতে তুলে এনেছেন।
আমাদের সাথে দারিদ্র্যের সম্পর্কটা বেশ নিবিড়। অবাক হচ্ছেন? সত্যিই বলছি। এই নিবিড় সম্পর্কের জন্যই অভাব আমাদের কাছ থেকে দূরে যেতে চায় না। কখনো প্রত্যক্ষ, কখনো পরোক্ষভাবে দারিদ্র্য আমাদের সাথেই ঘুরে।
১৯৪৩ সালে জয়নুল আবেদিন দুর্ভিক্ষের ছবি আঁকেন। তাতে ক্ষুধা, দারিদ্র্য যেভাবে ফুটে উঠেছে তা সত্যিই অনবদ্য। শুধু কি ১৯৪৩? বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরও এই দেশ থেকে দারিদ্র্য যায়নি। কবি রফিক আজাদ তার ‘ভাত দে হারামজাদা’ কবিতায় লিখেছেন,
‘ভাত দে হারামজাদা
তা না হলে মানচিত্র খাবো।’
কি নিদারুণ করুণ পরিস্থিতি তৈরি হলে একজন কবি ক্ষুধা বা দারিদ্র্যকে এইভাবে তুলে ধরেন। দেশ স্বাধীন, কিন্তু দারিদ্র্য? সে পরাধীন হয়ে মানুষের মধ্যে বসবাস করা শুরু করেছে।
এতো গেল আগেকার সময়। কিন্তু এখন? এখনো দারিদ্র্য আয়েশি ভঙ্গিতে আমাদের মাঝে অবস্থান করছে। এখনকার দারিদ্র দুই ধরনের। প্রথমটি কৃত্রিম। যা মানুষের তৈরি অর্থাৎ-পর্যাপ্ত খাবার থাকার পরও নিম্ন শ্রেণি পেশার মানুষের খাবার স্বার্থলিপ্সু দলীয় নেতাকর্মীরা লুট করছে। ফলে মানুষকে অভুক্ত থাকতে হচ্ছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০১৯ সালের তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশে ৩ কোটি ৪০ লাখ মানুষ গরিব। তাদের মধ্যে পৌনে দুই কোটি মানুষ হতদরিদ্র।
আমাদের খাবারের অভাব হওয়ারই কথা ছিল না। কিন্তু হচ্ছে। কারণ রাজনৈতিক লোকজন সকল প্রকার ত্রাণ নিজেদের দখলে রেখে দিয়েছে। একদিকে জনগণ না খেয়ে মারা যাচ্ছে, অপরদিকে রাজনৈতিক নেতাকর্মীরা সেই খাবার ঘরে, মাটির নিচে, গোডাউনে, খাটের নিচে লুকিয়ে রাখছে। আবার ত্রাণ চাইলে তাদের মারধোর করা হচ্ছে।
দারিদ্র্যের আরেকটি কারণ সংকট। যেমন করোনা পরিস্থিতির কারণে দেশের অর্থনীতিতে এখন মন্দা। ফলে অর্থনীতি সচল না হওয়ার কারণে দেশে খাদ্য সংকট তৈরি হবে। যা ভবিষ্যতে আমাদের জন্য ভয়ানক শঙ্কার ইঙ্গিত দেয়। এখন সরকারই পারে সঠিক প্রস্তুতি নিয়ে এই সংকট মোকাবেলা করতে।
২.
‘গ্লোবাল রিপোর্ট অন ফুড ক্রাইসিস–২০২০’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদন বলছে, ২০১৯ সালে বিশ্বের ১৩ কোটি ৫০ লাখ মানুষ আধপেটা খেতে পায়, ক্ষুধা পেটে রাতে ঘুমাতে যায়। বিশ্বের ৫৫টি দেশের জনগণের ওপর এই গবেষণা চালানো হয়। বাংলাদেশও এর মধ্যে ছিল। করোনা পরিস্থিতি কারণে ২০২০ সালের শেষের দিকে এই সংখ্যা বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হতে পারে।
এইবার আমাদের দেশের পরিস্থিতি কেমন তা জানি। ২০২০ সালের ২৫ এপ্রিল ইংরেজি দৈনিক ঢাকা ট্রিবিউন-এ একটি ছবিসহ সংবাদ প্রকাশিত হয়। সেই সংবাদে উঠে আসে ফরিদা বেগমের গল্প। অভুক্ত ফরিদা জানতে পারে বংশালে ত্রাণ মিলবে। তাই সে কড়া রোদ মাথায় করে রাজধানীর খিলগাঁও থেকে পায়ে হেঁটে ছুটে যায় বংশালে। এতো দূর থেকে এসে আধা কেজি চাল মিলে তার কপালে। সেই চাল পরিবারের মুখে তুলে দিতে ফরিদা ছুটে বাসার দিকে। অভুক্ত ফরিদা জীবনের সাথে আর পেরে ওঠে না। তীব্র রোদ ফরিদাকে হার মানিয়ে দেয়। ক্ষুধা পেটে ফরিদা চালসহ অজ্ঞান হয়ে রাস্তায় পড়ে যায়।
‘গ্লোবাল রিপোর্ট অন ফুড ক্রাইসিস–২০২০’এর প্রতিবেদনের সাথে আমাদের ফরিদার গল্প একেবারে মিলে যাচ্ছে। ২০২০ সাল এখনো শেষ হয়নি। এখনই ফরিদারা ক্ষুধার কাছে হার মানছে। বছরের শেষে এই রকম আরও অসংখ্য ফরিদার গল্প আমরা জানবো।
ফতুল্লায় ত্রাণ না পেয়ে ইউনিয়ন পরিষদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান খন্দকার লুৎফর রহমান স্বপনের বাড়ির সামনে বিক্ষোভ করেন এলাকাবাসী, টাঙ্গাইলের ভূঞাপুরে লকডাউনে থাকা গ্রামবাসীরা খাবারের দাবিতে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেছেন, জামালপুর সদর উপজেলার শরিফপুর ইউনিয়নের বগালী গ্রামের রাজমিস্ত্রির জোগালি, মাটিকাটা শ্রমিক ও রিকশাচালকরা বিক্ষোভ করেছেন, ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার আউলিয়াপুর ইউনিয়নের লোকজন কচুবাড়ি এলাকার ঠাকুরগাঁও-পঞ্চগড় সড়ক অবরোধ করে খাদ্যসামগ্রীর দাবিতে সামাজিক দূরত্ব মেনে বিক্ষোভ করেছেন, খাবারের দাবিতে জাতীয় পার্টির প্রয়াত চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদের বাসভবন ‘পল্লী নিবাস’ ঘেরাও করে বিক্ষোভ করেছেন শত শত নারী-পুরুষ, করোনাভাইরাস সংক্রমণ ঝুঁকির মধ্যে সরকারি ছুটিতে কুড়িগ্রামে ত্রাণের দাবিতে বিক্ষোভ ও সড়ক অবরোধ করেছেন একটি গ্রামের দরিদ্র মানুষ, ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া এবং মধুপুর উপজেলার সীমান্তবর্তী গ্রাম গজারিচালায় ২৫০ গারো পরিবারের দিন কাটছে অনাহারে, বরিশাল নগরীর ১ নম্বর ওয়ার্ডের পশ্চিম কাউনিয়া এলাকার কর্মহীন নিম্ন আয়ের মানুষেরা বিক্ষোভ করেছেন, কুড়িগ্রামের ভূরুঙ্গামারীতে ত্রাণের দাবিতে বিক্ষোভ করেছেন কর্মহীন দিনমজুর মানুষেরা, মাদারীপুরে ত্রাণের দাবিতে ঢাকা-বরিশাল মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ ও মানববন্ধন করেছেন হতদরিদ্র ব্যক্তিরা, রংপুরে ত্রাণের দাবিতে চার এলাকায় কর্মহীন অসহায় মানুষ বিক্ষোভ করেছেন, ত্রাণ বিতরণে স্বজনপ্রীতির অভিযোগে নোয়াখালীর সদর উপজেলার অশ্বদিয়া ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়ের সামনে জেলেদের অবস্থান, উল্লাপাড়া ও ভূরুঙ্গামারীতে অবরোধ-বিক্ষোভ, ‘ত্রাণের দাবিতে এলাকাবাসীকে নিয়ে বিক্ষোভ’ করার জেরে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় শ্রমিক লীগের নেতাকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ, খাদ্য সহায়তার দাবিতে যশোরের ঢাকা রোড ব্রিজ এলাকায় কর্মহীন দরিদ্ররা বিক্ষোভ করেন, ত্রাণের দাবিতে বিক্ষোভ, সড়ক অবরোধ ও মানববন্ধন করেছেন দিনাজপুর, রংপুর, গাইবান্ধা, ঠাকুরগাঁও, জয়পুরহাট, যশোর, সাতক্ষীরা ও ঢাকার সাভারের মানুষ। এরপর কি আর কিছু বলার প্রয়োজন আছে?
বিনয় দত্ত: কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক