হাজার হাজার বছর ধরে মানুষের স্বাভাবিক জীবন যাপনে যে সৌজন্য ও অভ্যাস চলমান আছে, তা পরিবর্তন করার সময় এসেছে। অর্থনীতি ও মানুষের জীবিকার কথা চিন্তা করে অনেক দেশই লকডাউন তুলে দিচ্ছে। বাংলাদেশেও একের পর এক খুলে দেওয়া হচ্ছে অফিস, কারখানা, দোকানপাট, শপিংমল। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশও এক ভিন্ন অধ্যায়ে পা রাখতে যাচ্ছে। অল্পদিনের মধ্যেই আবার স্বাভাবিক কর্মকাণ্ডে ব্যস্ত হবো আমরা। করোনাভাইরাসের সঙ্গে সহাবস্থানে থেকে শুরু করবো যার যার কর্মময় জীবন। করোনা আর মানুষের এই মুখোমুখি জীবন-যাপনে নতুনভাবে নিজেদেরকে তৈরি করতে হবে। বদলাতে হবে দীর্ঘদিনের কিছু অভ্যাস, সৌজন্য ও আদর-ভালোবাসা প্রকাশের প্রক্রিয়া। নিরাপদে থাকার ক্ষেত্রে এর কোনো বিকল্প আপাতত অন্য কোনো পথ নেই।
একটি সময় ছিল যখন মানুষের মধ্যে কোনো রকম সৌজন্যবোধ ছিল না। অন্যান্য প্রাণীর মতো মানুষেরও ছিল সহজাত কিছু জীবতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য। আচার-আচরণ, ভদ্রতা, নম্রতা, শালীনতা, হীনতা, দীনতা, আভিজাত্য—কিছুই ছিল না তাদের মধ্যে। সভ্যতার ক্রমবিবর্তনের ফলে মানুষের নানা বোধ জাগতে থাকে। এই বোধের কারণেই অন্যান্য প্রাণী থেকে নিজেরা আলাদা হতে থাকে। এই আলাদা হবার পেছনে মানুষের সুপরিকল্পিত কোনো ভূমিকা ছিল না। নানা সমস্যার সম্মুখীন ও জীবনের নানা চাহিদা মেটানোর প্রয়োজনে তারা নিজেদেরকে বদলাতে থাকে। ফলে তাদের মধ্যে তৈরি হতে থাকে সম্প্রীতি, সহমর্মিতা, মায়া, ভালোবাসা ও পারস্পরিক সৌজন্যবোধ। এই সৌজন্যবোধ নিজেদের উন্নতিকরণেরই একটি সহজাত প্রকাশ।
আধুনিক কালের মানুষ হিসেবে আমরা যথেষ্ট সৌজন্যবোধ সম্পন্ন। এই সৌজন্যের মধ্যে বেশির ভাগই শরীর সংস্পর্শ জাতীয়। যেমন : করমর্দন, কোলাকোলি, গালে গাল স্পর্শ, চুমু দেওয়া ইত্যাদি। মাথায়, গালে, কপালে, চোখে, মুখে, পিঠে হাত দিয়ে আমরা আদর-ভালোবাসা প্রকাশ করে থাকি। তাছাড়া, আমাদের অনেক অভ্যাস রয়েছে যেগুলোর কারণে আমরা বরাবরই ঝুঁকিতে থাকি। যেমন: ভালো করে হাত না ধোয়া, শিষ্টাচার বহির্ভূত হাঁচি-কাশি দেওয়া, রাস্তাঘাটে কফ-থুথু ফেলা, অপরিষ্কার কাপড় পরা, একজনে আরেকজনের জিনিস ধরা বা ব্যবহার করা, গায়ে গায়ে লেগে কাজ করা, গণপরিবহনে ঠাসাঠাসি করে চলাচল করা, কাছাকাছি গিয়ে জোরে জোরে কথা বলা ইত্যাদি।
বর্তমানে করমর্দন সৌজন্য, ভদ্রতা ও আন্তরিকতার প্রাথমিক পর্যায়। পরিচিত, অল্প পরিচিত কারো সাথে দেখা হলেই আমরা করমর্দন করি। করোনা বিস্তারের প্রধান মাধ্যম হলো হাত। তাই করমর্দন বা হ্যান্ডশেকের পরিবর্তে কোনো শুভেচ্ছা শব্দ বা ইঙ্গিত ব্যবহার করার অভ্যাস করতে হবে। কোলাকুলির উচ্ছ্বাস ও আন্তরিকতাও অনুরূপ ইঙ্গিতের মাধ্যমে প্রকাশ করতে হবে।
আমাদের দেশে খুব একটা প্রচলন না থাকলেও অনেক দেশে চুমু ও গালে গাল স্পর্শ এক ধরনের সৌজন্য প্রকাশ, ভদ্রতা। গালে গাল স্পর্শ ও চুমুর মতো সৌজন্যমূলক স্পর্শগুলো একান্ত ব্যক্তিগত পর্যায় ছাড়া সকল ক্ষেত্রে পরিহার করতে হবে। এগুলোও কোনো ইঙ্গিত বা ভঙ্গির মাধ্যমে প্রকাশ করার অভ্যাস করতে হবে।
সন্তান ও প্রিয়জনকে আদর করার ক্ষেত্রেও মাথায়, গালে, কপালে, চোখে, মুখে, পিঠে স্পর্শ করে থাকি। করোনাভাইরাসের মধ্যে নিরাপদ থাকতে হলে এসব আদর ভালোবাসার পদ্ধতিগুলো পরিবর্তন করতে হবে। এ ক্ষেত্রেও কোনো শব্দ বা ইঙ্গিত ব্যবহার করা যেতে পারে।
এই তো গেলো সৌজন্যে আর আদর ভালোবাসার কথা। এবার আসি অভ্যাসের প্রসঙ্গে। আমাদের কিছু অভ্যাস, যা পরিবর্তন করা ছাড়া নিরাপদে থাকার কোনো সুযোগ নেই। দিনে কয়েকবার সাবান বা হ্যান্ড ওয়াশ দিয়ে হাত ধোয়ার অভ্যাস আমাদের নেই বললেই চলে। নতুন কর্মময় জীবনে এই অভ্যাস করতে হবে।
শিষ্টাচার বহির্ভূত হাঁচি-কাশি দেওয়া পরিহার করতে হবে। বাংলাদেশের মতো যত্রতত্র কফ, থুথু পৃথিবীর কোনো দেশের মানুষই ফেলে না। এই অভ্যাস পরিহার করতে হবে। পরিষ্কার কাপড় পরতে হবে। একজনকে আরেকজনের জিনিস ধরা বা ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকতে হবে। গায়ে গায়ে লেগে কাজ করা কিংবা গণপরিবহনে ঠাসাঠাসি করে চলাচল করা যথাসম্ভব পরিহার করতে হবে। কাছাকাছি গিয়ে কথা বলার অভ্যাস দূর করতে হবে। ঘরের বাইরে মাস্ক পরার অভ্যাস করতে হবে।
দেশ ও মানুষকে বাঁচাতে হলে দীর্ঘদিন সব কিছু বন্ধ রাখা যাবে না এটা যেমন সত্য, তেমনি করোনার বিস্তারের মধ্যে সব কিছু খুলে দিলে মানুষ নিরাপদ থাকবে না এটাও সত্য। বাঁচতে হলে খুলতে হবে। আমাদের সৌজন্য ও অভ্যাসগুলো পরিবর্তন করলে কিছুটা হলেও নিরাপত্তা বাড়বে।
লেখক: কবি ও শিক্ষক