স্মৃতিকথা লিখতে কোথা থেকে শুরু করব ভেবে পাচ্ছি না। আমিসহ আমার ভাইবোনদের পড়ালেখা ও বেড়ে ওঠার গল্পটা ভিন্ন মাত্রার। মা-বাবার কঠোর সাধনা ও ইচ্ছাশক্তির কাছে কোনো কিছুই বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। বাবা বড্ড অসময়ে পৃথিবী ছেড়ে চলে যান ১৯৮৯ সালের ২ জুনে। শুরু হয়ে যায় আমার স্বশিক্ষিত মায়ের পদযাত্রা- যা ছিল আমার দেখা সবচেয়ে আঁকাবাঁকা পথ। তার সঙ্গে যোগ দেন আমার বড় ভাইয়েরা এবং পরে আমরা সবাই।
আমি গর্ব করে এইটুকু বলতে পারি, আমার ভাইয়েরা আমাদের জন্য যা করেছেন তা অনেকের কাছেই অবিশ্বাস্য। আমার ভাইয়েরা আমাদের পড়ালেখার টাকা যোগান দিতেন। পাঁচ ছেলে আজ মাস্টার্স শেষ করে চাকরি করছে। আবার ছেলেদের মধ্যে তিন ছেলে পিএইচডি শেষ করে বিদেশে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি করছে। দুই ছেলের স্ত্রী পিএইচডি শেষ করে চাকরি করছে।
যদি কোনো মৃত মানুষ দেখতে পায়, তাহলে হয়তো তোমরা আমাদের দেখছ। দেখবে, তোমাদের স্মৃতি ও স্বপ্নগুলো পরিবর্তন হয়নি। তোমাদের স্মৃতি আজও অম্লান। মা যখন বেগম রোকেয়া রত্নাগর্ভা অ্যাওয়ার্ড পেয়েছিল অনুভূতিতে আমাকে বলেছিলে, ‘আমি তো অ্যাওয়ার্ডের জন্য তোদেরকে মানুষ করিনি’। আসলে তাই।
'মা' যখন অতীত
'মা' আমার বেঁচে নেই। না ফেরার দেশে চলে গেছেন গত বছর ২১ জুলাই। আমরা আর কোনোদিন মা ডাকতে পারব না। আল্লাহ তোমাদেরকে বেহেশতবাসী করুক। কারও কারও মতে মায়েদের জন্য আলাদা কোন দিবসের প্রয়োজন নেই। বছরের প্রতিটা দিনই মায়েদের জন্য।
মাকে হারাব, মা হারানোর বেদনা সহ্য করতে পারব এমন কখনোই ভাবতে পারিনি। আজ সেই মাকে ছাড়া বেঁচে আছি প্রায় ১ বছর। মা যখন বেঁচে ছিলেন, শেষের দিকে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন, তাকে দেখতে গিয়েছিলাম এবং হাসপাতালে মা'র পাশে ছিলাম সাত দিন। আমাকে দেখে মা'র চোখে পানি।
হাসপাতালে একা একা বসে মনে মনে ভাবতাম একদিন এই মা হয়তো থাকবেন না। তখন কত ইচ্ছা করবে তাকে জড়িয়ে ধরতে। মাথা কুটলেও তাকে ছুঁতে পারব না! এমন ভাবনা যখন মনে আসত তখন মনের অজান্তেই চোখ বেয়ে জল গড়াত। সেই পরম শ্রদ্ধার, পরম ভালোবাসার অতল সমুদ্র আজ আমার শুকিয়ে গেছে। মা নেই। সেই হাসপাতাল, সেই রাস্তা, সেই গলি, সেই বেড, সবই আছে, কিন্তু মা তুমি শুধু নেই। আর কোনো দিন মা ডাকতে পারব না। মা যে এত আদরের এত মমতার, এত স্নেহের, এত আবদারের, এত ভালোবাসার- মাকে হারিয়ে আজ তা বুঝি। মা তো মাই। তার কোনো বিকল্প নেই।
কিছু স্মৃতি
মায়ের ছায়ার পরিধি মাপার যন্ত্র পৃথিবীতে আবিষ্কৃত হয়নি। হবে না কোনো দিন। ভাইবোনদের সঙ্গে মায়ের নিয়মিত কথাবার্তা হতো। কিন্তু বয়সের কারণে মা গুছিয়ে কথা বলতে পারতেন না এবং বেশি কথাও বলতেন না। অনেক কথার মাঝে একটি কথা বলবেনই, বাবা তুই কখন আসবি আবার। মার পৃথিবীতে শুধু একটাই চাওয়া—বাবা তুই কখন আসবি আবার এবং তোর সঙ্গে আবার দেখা হবে তো।
মা বটবৃক্ষের মতো বিশাল ছায়া, সেটা আগেও বুঝেছি। এখনো বুঝি, কিন্তু বলা হয়ে ওঠে না। এটা অনুধাবন করতে বিন্দুমাত্র কষ্ট হয় না। এখন আরও বড্ড বেশি বুঝি। মা, সত্যি সত্যি আমি বিশ্বাস ও উপলব্ধি করতে পারি, আমাকে ও আমাদের অন্য ভাইবোনদের ছাড়া তুমি কেমন আছ। তুমি আমাদের দেখতে চাও এটাও উপলব্ধি করি। মা, বাস্তবতার কাছে তোমার সন্তানেরা বড্ড অসহায়। এতটুকু বলতে পারি, সমস্ত পৃথিবী এক করেও তোমার ও বাবার শূন্যতা কোনো দিন পূরণ হবে না। দেখা হয় না কিন্তু কথাতো হয়। মা তুমি আছ বলেই তো এখনো বিশুদ্ধ দোয়া পাই। মা, ছুটে চলে যাই তোমার কাছে কারণ সব পাখিই নীড়ে ফিরতে চায়।
মা, তুমি কি জানো তোমার অতি আদরের বড়ো ছেলে আমাদের বাদশা ভাই আমাদেরকে কাঁদিয়ে গত ১১ মার্চ মারা গেছেন। মা, তুমি যাকে ছাড়া একটি রাত কাটাতে পারোনি, মারা যাবার সময়ও যার উপস্থিতি চেয়েছিলে। আল্লাহ তোমার চাওয়া কবুল করেছে। তোমার বাদশা আমাদের মাঝে নেই এটা বলতে ও নিজেকে বোঝাতে অনেক অনেক কষ্ট হয়। কাউকে বলতে পারি না। মাঝে মাঝে বড্ড ক্লান্ত লাগে। আমরা অনেক প্রিয় মানুষদের হারিয়ে কীভাবে আছি আল্লাহই ভালো জানেন।
সম্ভবত পৃথিবীর সব মা'ই ক্লান্তিহীন, কখনই বিরক্ত হন না। যদি প্রশ্ন করা হয় পৃথিবীতে সবচেয়ে প্রিয় শব্দ কী? মনে হয়, শর্তহীনভাবে সবাই বলবে ‘মা’। সত্যিই তাই। এমনই বলার কথা। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন মাকে নিয়ে বলেছিলেন, ‘আমি যা কিছু পেয়েছি, যা কিছু হয়েছি, যা কিছু হতে আশা করি, এর সবকিছুর জন্য মায়ের কাছে ঋণী।’
সকল মায়ের প্রতি ভালোবাসা ও অনেক শ্রদ্ধা জানাই। আমাদের জীবনে প্রতিদিনই হোক ‘মা’ দিবস এই কামনায়।
ড. মো. আ. ওয়াহাব: গবেষক, অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী