বাংলাদেশে করোনা আঘাতের শুরুতে মানুষ যেমন আতঙ্কে ছিলো এখন আস্তে আস্তে তা শিথিলের পথে। শুরুতে বিশেষজ্ঞরা বলেছিলেন, করোনায় আতঙ্কের কিছু নেই। হয়তোবা সে কারণেই করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা বাড়লেও মানুষ ভীত নয়। আতঙ্কতো দূরের কথা ঘর থেকে বেড়িয়ে মানুষ ধীরে ধীরে যার যার কর্মস্থলে যোগদান করতে শুরু করেছে। কিছুই করার নাই। কারো পেটে ভাত না থাকায় পেটের দায়ে কাজ করছে, আবার কেউ কেউ নিজের গাড়ি নিয়ে ড্রাইভে বের হচ্ছে। বাসায় তাদের অসহ্য কোয়ারেন্টিনে মন খুসখুস করছে কখন দামি রেস্টুরেন্টে গিয়ে আড্ডা দিতে পারবে। পত্রিকায় ইতোমধ্যে দেখলাম ভারতে লকডাউন শিথিল করাতে মদের ওপর করোনা ট্যাক্স ধার্য করেছে। তারপরেও মদ কেনার জন্য বিশাল লাইন।
আমাদের দেশে মদ কেনাবেচার রেস্ট্রিকশন থাকলেও জিনিসপত্র কেনাবেচায় হুজুগটা কিন্তু ঠিকই আছে। শর্ত সাপেক্ষে একে একে খুলে দেয়া হচ্ছে শপিংমল। কিন্তু বাঙালি কি আর শর্ত মানে। আনন্দে আত্মহারা হয়ে হয়তো হুমড়ি খেয়ে পরবে কেনাকাটা করতে। সমস্যা ঐখানে, কারণ আমরা শর্ত বা আইন মানতে অভ্যস্ত নই। সচেতন ব্যক্তির অচেতন হতে সময় লাগবে না। আতঙ্কের ধার কেউ ধারে না।
প্রশাসন থেকে বলা হয়েছিলো ঢাকা থেকে কেউ বাইরে যেতে পারবে না না আবার বাইরে থেকে কেউ ঢাকায় ঢুকতে পারবে না। পোশাক শিল্পের মালিকদের আদেশে লকডাউনের মাঝেও শ্রমিকরা পায়ে হেঁটেই কর্মস্থলে পৌঁছেছে যা কঠিন মনোবলের বহিঃপ্রকাশ। যারা দূর দূরান্তের পথ পাড়ি দিতে সক্ষম তাদের ইমিউনিটি অবশ্যই হার্ড। প্রয়োজনই তাদের ইমিউনিটিকে হার্ড করেছে। যাদের একমাস কাজ না করতে পারলে পরিবার চলানো কঠিন তাদের কাছে করোনা কোনো যন্ত্রণা নয়। বেঁচে থাকার তাগিদে খাদ্য, বস্ত্র, আশ্রয় এই তিনটি চাহিদা অন্তত তাদের কাছে অপরিহার্য। সচেতনতার জ্ঞান তাদের কাছে শুধুই কথার কথা।
কিন্তু যারা বিত্তবান বা সমাজে সুশীল বলে পরিচয় দেন তাদের আগে সচেতন হওয়া দরকার। তাদের অনেককেই আজ দেখা যাচ্ছে না।কোথায় সেই ব্যক্তিরা। তাছাড়া সরকার কর্তৃক এতো করে বার বার বলছেন কর্মীদের জন্য যথেষ্ট নিরাপদ ব্যবস্থা গ্রহণ করে শিল্প প্রতিষ্ঠান চালু করতে কিন্তু আমাদের সমাজপতিরা কি তা করছেন? করছেন না।
অর্থনীতির চাকা যাদের দিয়ে ঘুরাবেন তাদের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করবেন না আবার দেশের জনসাধারণকে বড় বড় লেকচার দিবেন। বিভিন্ন ইলেকট্রনিক মিডিয়া বা পত্রিকা খুললে দেখা যায় কারখানার অবস্থার চিত্র। করোনার বিশেষ নিরাপত্তার কোনো বালাই নাই। যে শ্রমিকদের দিয়ে আমরা অর্থ অর্জন করি তাদের জীবন নিয়ে বিন্দুমাত্র চিন্তা কেউ করে না।
আমরা বর্তমানে যে অবস্থায় আছি তাতে করোনার ভয় এখন আমাদের মাঝে আর নেই। অনেকে ভাবছে যেহেতু করোনার কোনো প্রতিষেধক নেই, শরীরের ভেতরের শক্তিই বড় শক্তি তাই কিসের লকডাউন কিসের আবার সামাজিক দূরত্ব। লকডাউনের বিষয়ে সরকারকে দোষারোপ করে লাভ নেই। অর্থনৈতিক কারণেই হোক আর আমাদের চারিত্রিক কারণেই হোক উচ্চমানের লকডাউন আমাদের দেশে আরোপ সম্ভব নয়। আমরা যতটুকু দেখেছি পুলিশ, সেনাবাহিনীসহ অন্যান্য ভলান্টিয়ার ভাইয়েরা অনেক চেষ্টা করেছে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার জন্য কিন্তু কতটুকুইবা মানুষ শুনেছে।
এই সংযমের মাসে কিছু কিছু রেস্টুরেন্ট শর্ত সাপেক্ষে খোলার নির্দেশ দিয়েছে সরকার- হয়তোবা এই চিন্তা করে যাতে রেস্টুরেন্ট ব্যবসায়ীরা আর্থিক ক্ষতি কিছুটা পুষিয়ে নিতে পারেন। কিন্তু এ সুযোগে দেখবেন অনেক দুলালরা এখন শুধু ইফতার না সেহরি পার্টিও করবে।
করোনা পরিস্থিতিতে কত কথা বা উপদেশই না শুনছি, লাভ হচ্ছে কতটুকু। ফেসবুক, মেসেঞ্জারসহ সোশ্যাল মিডিয়াতে করোনা নিয়ে হরহামেশাই বিভিন্ন ধরনের বার্তা পাচ্ছি।
করোনার প্রতিরোধের অন্যতম প্রধান উপায় হচ্ছে নিজে পরিষ্কার থাকা এবং নিরাপদ দূরত্বে থাকা। শিক্ষিত আর অশিক্ষিত যেই হোক আমরা সামাজিক দূরত্ব কথাটির সঙ্গে কেউ পরিচিত হতে পারছি না। বাজারের দোকানের সামনে দূরত্ব বজার রাখার জন্য রঙ দিয়ে দাগসহ সামনে রশি টেনে দেয়া হয়েছে। আপনি বাজার করতে গিয়ে দেখবেন অনেক ভদ্রলোক মাস্কখানা থুতনিতে রেখে আপনার ঘাড়ের উপর দাঁড়িয়ে বাজার করছে। আপনি যতই দূরে সরতে চেষ্টা করছেন উনি যেন আপনার পাশেই থাকছেন। সামাজিক দূরত্বতো মানছেন না আবার মাস্কখানা যেন ফ্যাশন হিসেবে ব্যবহার করছেন। অথচ তিনি হাতে ত্রিশ সেকেন্ড পরপর স্যানিটাইজার ব্যবহার করছেন। আমরা যা অত্যাবশ্যক তা নিয়ে ভাবি না। সামাজিক দূরত্ব কি জিনিস বুঝলাম না। অথচ প্রতিটা দিনেই ঘোষণা করা হচ্ছে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখুন।
পরিবেশগত কারণে অন্যান্য দেশের তুলনায় হয়তোবা আক্রান্তে আমরা কিছুটা সুবিধা পেলেও যদি আমরা অতি সাধারণ কিছু সতর্কতা অবলম্বন করি তাহলে এর বিস্তার বা ঝুঁকি কমিয়ে আনা খুব একটা কঠিন কাজ না। ইতোমধ্যে আমরা অনেকটাই WHO এর সেই সহজ সতর্কতা অবলম্বন করতে অনেকটাই ব্যর্থ হয়েছি শুধুই আমাদের অসর্তকতার জন্য। আসলে বাংলাদেশের মানুষের প্রকৃতিগতভাবে ব্যবহার বা আচরণের যে ধরণ তাতে সরকার যত ব্যবস্থাই গ্রহণ করুক না কেন পুরোপুরিভাবে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব বলে মনে হয় না।দেশের ভাইরাস বিশেষজ্ঞরাও তাই বলছেন। ইতোমধ্যে সরকারও হয়তোবা তা অনুধাবন করতে পেরেছে। তাই আস্তে আস্তে সীমিত পরিসরে খুলে দিচ্ছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। এখন আমাদের দেহের ইমিউনিটির ওপর নির্ভর করা ছাড়া উপায় নাই। করোনা প্রতিরোধে ইমিউনিটি এখন একমাত্র অস্ত্র।
মুত্তাকিন হাসান: কবি, প্রাবন্ধিক ও মানব সম্পদ পেশাজীবী