সংস্কৃতি বলতে আমরা সাধারণত বুঝি ঐতিহ্যগতভাবে চলে এসেছে এমন সব আচার-অনুষ্ঠান। যেমন, বাংলা বা বাঙ্গালি সংস্কৃতি বলতে সরলভাবে আমরা বুঝি গ্রামীণ সমাজের প্রেক্ষাপটে বিকশিত হওয়া পল্লীগীতি, ভাটিয়ালি, লালনগীতি, পালাগান, নবান্নের উৎসব, ধর্মীয় উৎসব, কৃষি-নির্ভর অর্থনীতি ও নানারকম প্রথাগত উৎসব। এগুলো এখনও বেঁচে আছে। কারণ, এগুলো প্রজন্ম ধরে হাতবদল হয়েছে। আগের প্রজন্ম লালন করেছে বলেই পরবর্তী প্রজন্মে তা বেঁচে আছে। মানুষ এখনও তা চর্চা করছে। এই চর্চার সাথে মিশে আছে আবেগ ও ভালোবাসার অনুভূতি। সময়ের অগ্রগতির সাথে সাথে এগুলোও কিছু মাত্রায় পরিবর্তন হয় অবশ্যই। কিন্তু, মূল ভাব থেকে যায়।
নৃবিজ্ঞানে সংস্কৃতি বলতে বোঝায় মানুষের যাবতীয় আচরণ বা আচরণের সমষ্টিকে। আচরণগুলোকে মানুষ বেঁচে থাকার তাগিদে ও নিজেকে বিকশিত করার জন্য দৈনন্দিন জীবনে চর্চা করে। মানুষের আচরণগুলোকে যদি বিভিন্ন খাতে বণ্টন করি তাহলে দেখা যাবে মানুষের রয়েছে জীবিকা অর্জনের সংস্কৃতি, ধর্ম পালনের সংস্কৃতি, পরিবার গঠনের সংস্কৃতি, সামাজিকতা পালনের সংস্কৃতি, শিক্ষার সংস্কৃতি, সিভিক দায়িত্ব পালনের সংস্কৃতি, ইত্যাদি। যেমন, রোজার দিনে মুসলমান পরিবার ইফতারির খাবার আত্মীয় বা প্রতিবেশীর বাড়িতে উপহার হিসেবে দেয়। এটি বাঙ্গালি সংস্কৃতির একটি উল্লেখযোগ্য দিক। বাঙ্গালি সমাজের এই আচরণ একদিনে তৈরি হয়নি। আমাদের নিয়মিত চর্চার কারণেই সামাজিক সম্পর্কের এই উপাদানটি এখনও বেঁচে আছে।
সংস্কৃতি পরিবর্তনযোগ্য। সংস্কৃতি তখনই পরিবর্তন হয় যখন মানুষের আচরণে পরিবর্তন আসে। মানুষ তাঁর আচরণ কেন পরিবর্তন করবে? আচরণ পরিবর্তনের প্রয়োজন হয় যখন দেখা যায় কারও আচরণ কোনো ব্যক্তির বা গোষ্ঠীর জন্য অকল্যাণকর হচ্ছে, সমাজের জন্য অশুভ হচ্ছে। বর্তমানে আমরা করোনাভাইরাসজনিত সংকটের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি। সামাজিক দূরত্বকে গুরুত্বের সঙ্গে পালন না করার কারণেই অন্য মানুষ করোনাভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হচ্ছে। অন্যের জীবনকে সংকটের মুখে ফেলছে।
সরকার সুরক্ষামূলক আদেশ জারি করেছে। যেগুলোর মূল কথা হচ্ছে, আমাদের আচরণ পরিবর্তন করতে হবে। যেমন, খুব জরুরি প্রয়োজন ছাড়া ঘর থেকে বের হবো না। পাবলিক স্থানে সামাজিক বা শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখবো। অর্থাৎ, দুই ব্যক্তির মধ্যে নিদেনপক্ষে তিন ফুট বা ততোধিক দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। দলগতভাবে ঘোরাফেরা বা ভ্রমণ না করা এবং কোথাও জমায়েত হওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে।
এই সুরক্ষামূলক পরামর্শ মেনে চললে এক ব্যক্তির দেহ হতে করোনাভাইরাস অন্য ব্যক্তির দেহে প্রবেশ করবে না। পুলিশ, সেনাবাহিনী, সিভিল সোসাইটি, জনপ্রতিনিধিরা ও মিডিয়া চেষ্টা করছে যেন সাধারণ মানুষ বিশ্বব্যাপী করোনা মহামারি সংকটে তাদের আচরণে পরিবর্তন আনে। এক কথায়, সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে নিজেকে সুস্থ রাখে এবং অন্যকেও সুস্থ রাখতে নিজের সিভিক দায়িত্ব পালন করে।
সুস্থ থাকবার সুরক্ষামূলক উপায়গুলো এত সহজ কিন্তু এগুলি অমান্য করার প্রবণতা এত প্রবল কেন? অনেকেই পাবলিক স্থানে মাস্ক ছাড়াই ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমাদের মনে রাখা জরুরি যে, এই সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা সংশ্লিষ্ট আচরণ পরিবর্তন না করার শিকড় আরও গভীরে। অর্থাৎ, আচরণ পরিবর্তন না করার প্রবণতা আমাদের সিভিক নিয়ম অমান্য করার সংস্কৃতির সাথে জড়িত। এর জন্য শুধু ব্যক্তি এককভাবে দায়ী নয়। আইন না মানার সংস্কৃতি কাঠামোগতভাবেই সৃষ্টি হয়েছে।
উদাহরণস্বরূপ, আমরা কি ফুটপাতে হাঁটি? আমরা কি ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহার করি? আমরা কি রাস্তার আইল্যান্ডের লোহার রেলিং টপকানো থেকে বিরত থাকি? আমরা কি ফুটপাতে মোটর সাইকেল চালানো থেকে বিরত থাকি? নির্দিষ্ট ডাস্টবিনে ময়লা ফেলি? পানের পিক যত্রতত্র ফেলা থেকে বিরত থাকি? স্কুল ও হাসপাতালের আশেপাশে গাড়ীর হর্ন দেওয়া হতে কি বিরত থাকি? রাষ্ট্র কি ফুটপাতের অবৈধ দখল বন্ধ করতে পেরেছে? বাস ও ট্রেনের টিকেটের কালোবাজারি বন্ধ হয়েছে? শিশুদের নোট মুখস্থ করা কি বন্ধ হয়েছে? এতগুলি অপ্রত্যাশিত সাংস্কৃতিক আচরণ রাষ্ট্রের চোখের সামনেই দিনের পর দিন ঘটে চলেছে। যা সার্বিক কল্যাণের জন্য ক্ষতিকর।
রাস্তায় সিভিক দায়িত্ব অমান্য করার একটি উদাহরণ দেই। ঢাকার ব্যস্ততম একটি জায়গা হলো সেনানিবাস সংলগ্ন সৈনিক ক্লাবের মোড়। এই মোড় থেকে যদি কেউ বনানী এগার নম্বর রাস্তার দিকে হেঁটে যেতে চায় তাহলে তাকে কাকলী বাসস্ট্যান্ডের দিকে মুখ করে হাঁটতে হবে। দুই থেকে তিন মিনিট হাঁটার পরই সে পাবে একটি অত্যাধুনিক ফুটওভার ব্রিজ। অত্যাধুনিক বলছি এই কারণে যে ব্রিজটির দুই মাথাতেই চলন্ত সিঁড়ি আছে। রাস্তার ওপারেই বনানী এগার নম্বর রাস্তাটি। এতসব আয়োজন থাকার পরও দেখা যায় যে বহু মানুষ এই ব্রিজটি ব্যবহার না করে রাস্তার মাঝখান দিয়ে, ট্রাফিক পুলিশের চোখের সামনে দিয়ে এবং নিজ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রাস্তা পার হচ্ছে। এই ধরণের চিত্র ঢাকা শহরের বহু জায়গায় দেখা যাবে।
রাস্তার নিয়ম পালন না করার সংস্কৃতি একটি কেইস যা প্রমাণ করে যে সিভিক দায়িত্ব পালন না করার অভ্যাস বা সংস্কৃতি বহুদিনের পুরনো। এর জন্য পথচারীরা এককভাবে দায়ী নয়। রাষ্ট্রের আইন প্রয়োগের নমনীয়তাও আমাদের আইন অমান্য করার সংস্কৃতির জন্য অনেকাংশে দায়ী।
কীভাবে অমান্য করার সংস্কৃতির পরিবর্তন আনা যায়। এক সপ্তাহের বা এক মাসের অভিযান দিয়ে কোনো সংস্কৃতি গড়া যায় না বা বিদ্যমান সংস্কৃতিকে উল্লেখযোগ্যভাবে পরিবর্তনও করা যায় না। আইন মানার সংস্কৃতি গড়তে হয়; লালন করতে হয়। অমান্য করার সংস্কৃতিও ঐতিহ্যবাহী আচার অনুষ্ঠানের মতোই, এক প্রজন্ম হতে অন্য প্রজন্ম শিখে। ছোটবেলা হতেই শিশুকে সিভিক নিয়ম ও দায়িত্ব পালনের শিক্ষা দেওয়া প্রয়োজন। শিক্ষা দেওয়াটাই শেষ কথা নয়। শিশুরা বড় হয়ে তাদের অর্জিত শিক্ষা যেন প্রয়োগ করতে পারে তার জন্য পরিবেশ তৈরি করতে হবে। পরিবেশ তৈরি করার দায়িত্বটি রাষ্ট্রের ও সকল নাগরিকের। তবে, প্রাতিষ্ঠানিক ও আনুষ্ঠানিক দায়িত্বটি অবশ্যই রাষ্ট্রের। আজকে আমরা দেখছি যে বহু মানুষ সামাজিক দূরত্বসংক্রান্ত আদেশ মানছে না। মনে রাখতে হবে যে, না মানার সংস্কৃতি বহুদিন ধরে চর্চিত হতে হতে আজকে প্রবল আকার ধারণ করেছে। সুতরাং, রাষ্ট্রের যেমন দায়িত্ব আইন প্রয়োগের সংস্কৃতি গড়ে তোলা, তেমনি জনগণের উচিত রাষ্ট্র-নির্ধারিত সিভিক দায়িত্ব পালনের সংস্কৃতি নিজের জীবনের অন্যান্য আচরণের মতোই লালন-পালন করা। এতে করে, নিজের জীবনের সুরক্ষাও নিশ্চিত করা যায়, অন্যকেও নিরাপদে রাখা যায় এবং রাষ্ট্রের প্রতিও দায়িত্ব পালন করা হয়। যেটি, এই মুহূর্তে করোনা বিপর্যয় কাটিয়ে উঠতে খুবই প্রয়োজন।
ড. মোহাম্মদ আলতাফ হোসেন: সহযোগী অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।