এ দেশে দুর্নীতি আর নতুন কী! দুর্নীতি আমাদের সংস্কৃতিতে রূপান্তরিত। এদেশের অনেকেই মনে করেন দুর্নীতি সমাজে ভালো ভূমিকা রাখে। দুর্নীতি করতে পারলে ব্যক্তিগতভাবে ও সামাজিকভাবে লাভবান হওয়া যায়।
দুর্নীতির সামাজিক লাভের বিষয়টি একটু ব্যাখ্যা করি। দুর্নীতিবাজরা সমাজে অনেক জনপ্রিয় কারণ তারা মসজিদ-মক্তবে চাঁদা দেন, গরিব-দুঃখীর চিকিৎসা করতে সহায়তা করেন, অনেক সমাজসেবামূলক কাজ করেন, বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নির্মাণ করেন, ভালো আলোচক এনে ওয়াজ মাহফিলের আয়োজন করেন ইত্যাদি।
সামাজিকভাবে দানশীল দুর্নীতিপরায়ণ মানুষের অনেক কদর। সমাজের এ ধরনের আচরণ তাদেরকে দুর্নীতিতে দুর্নীতিপরায়ণ উৎসাহিত করে। তাদেরকে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অতিথি হতে দেখা যায়। আমরা হচ্ছি ওনাদের এজেন্ট ও শ্রোতা। আমরা ওনাদেরকে প্রতিষ্ঠার জন্য বিজ্ঞাপনের কাজ করি। বিভিন্ন চমকপ্রদ বিশেষণ যোগ করে সামাজিকভাবে তাদেরকে উপস্থাপন করি, প্রতিষ্ঠিত করি। আর এভাবে আমরা নিজেরাই দুর্নীতির সাথে যুক্ত হয়ে যাই। আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে আমরা দুর্নীতি করি না, কিন্তু আমরা জেনেশুনে দুর্নীতিবাজদের সামাজিকভাবে নেতা বানিয়ে, অনুষ্ঠানে অতিথি করে, তাদের বাহবা দিয়ে, আমরাও কিন্তু পরোক্ষভাবে দুর্নীতিতে যুক্ত হই। আর এ কাজে পিছিয়ে নেই কেউ। একটি ব্যক্তিগত উদাহরণ দিলে বুঝতে সুবিধা হবে। একবার আমি মসজিদ কমিটির অনুরোধে সামান্য দান করি তা হয়তো ওনাদের চাহিদার তুলনায় অনেক কম, অন্যদিকে আমার থেকে অনেক অনেক কম বেতনে চাকরি করা একজন এক মাসে বেতন যে পরিমাণ পান তার থেকে বেশি পরিমাণ দান করলেন। আমি এতে কিছু মনে করিনি। মসজিদের ইমাম সাহেব মোনাজাতে ওনার জন্য যে রকম দোয়া করেছেন মনে হয় ওনার চৌদ্দগোষ্ঠীর কেউ আর জাহান্নামে যাবেন না। আমি হয়তো মসজিদে চাঁদার বিষয়টির কথা বললাম। কিন্তু সমাজের অনেক ক্ষেত্রেই একই চিত্র পরিলক্ষিত।
দুর্নীতি করে শিল্পপ্রতিষ্ঠান করা যায়, অনেককে চাকরি দেয়া যায়, নিজের সন্তানদেরকে ভালো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়ানো যায়, দেশ-বিদেশ বাড়ি কেনা যায়, ঘোরা যায়। দুর্নীতিবাজ তার স্ত্রীর কাছে একজন ভালো হাজব্যান্ড, সুপুরুষ! সন্তানের কাছে একজন আদর্শ বাবা আর সমাজের কাছে একজন আদর্শ মানুষ!
আমাদের দেশে দুর্নীতিপরায়ণ মানুষের অনেক সুনাম। আমি অনেককেই বলতে শুনেছি এই অফিসার খুবই ভালো। আমি কিছু টাকা দিয়েছি উনি আমার কাজটা করে দিয়েছেন। টাকার বিনিময়ে সঠিক সময়ে কাজ করাতে পারলে আমরা খুশি।
আমরা ব্যক্তিগত ও সামাজিকভাবে দুর্নীতিকে অনেক প্রশ্রয় দিয়ে থাকি। দুর্নীতিপরায়ণদের বাড়িতে দাওয়াত অনেক ধরনের মুখরোচক আইটেম দিয়ে ভুরিভোজ করতে পারলে আমরা খুবই খুশি হই। তাদের সন্তানদের বিয়ে-শাদীতে আমরা দাওয়াত না পেলে আফসোস করি, আর দাওয়াত ফেলে নিজেকে ধন্য মনে করি। বিয়ে-শাদীর বাজারে তাদের সন্তানদের চাহিদা অনেক। তাদের সাথে আত্মীয়তার সম্পর্ক করতে পেরে নিজেকে ধন্য মনে করি।
অন্যদিকে দুর্নীতিবাজরাও নিজেদের অবস্থান এবং দুর্নীতি নিয়ে গর্ববোধ করেন। দেশ ও সমাজের জন্য অনেক কিছু করেছেন বলে বুলি আওড়ান। দুর্নীতিপরায়ণরা বলেন আর আমরা শুনি। খুব ভালো লাগে। ওনাদের আতিথেয়তা দারুণ মজার।
আমরা নিজেকে কখনও কি প্রশ্ন করেছি যার সাথে সম্পর্ক রেখেছি, যার বাড়িতে দাওয়াত খাচ্ছি, যার বাড়িতে দাওয়াত না পেলে মন খারাপ হয় তার আয়ের উৎস কী? তার দান দিয়ে মসজিদ বানাচ্ছেন তা কতটুকু স্বচ্ছ? আসলে আমরা জেনে বুঝে সামাজিকভাবে দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দিচ্ছি। আর এরই মাধ্যমে পরোক্ষভাবে আমরাও দুর্নীতিপরায়ণ হচ্ছি।
আমাদের একটি সাধারণ প্রবণতা হচ্ছে দুর্নীতির সাথে শুধু টাকা-পয়সার সম্পর্ক স্থাপন করা। আসলে দুর্নীতি শুধু ঘুষ নয়। কোন সুনির্দিষ্ট পেশার সাথে দুর্নীতির সম্পর্ক করা ঠিক নয়। তবে এও ঠিক অনেক পেশায় তুলনামূলকভাবে অর্থনৈতিক দুর্নীতি করার সুযোগ বেশি থাকে। অনেকেরই চেষ্টা করেও দুর্নীতি থেকে নিজেকে বিরত রাখতে কষ্ট হয়। যেখানে পুরো সমাজেই দুর্নীতি, সেখানে কোনো সুনির্দিষ্ট ব্যক্তি বা পেশাকে দোষ দিয়ে কী লাভ! আসলে মানসিকভাবে আমরা প্রায় সকলেই দুর্নীতিপরায়ণ। দুর্নীতিবাজদের অবস্থান সমাজের উঁচু স্তর থেকে শুরু করে সব জায়গায়। এর যোগসূত্র এত গভীর ও শক্ত সেখানে রাষ্ট্রও অনেকটা অসহায়। সেজন্যই দুর্নীতিবাজদের রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রতিষ্ঠা করার দায়িত্ব রাষ্ট্র নিজেই নিয়ে নেয় কালো টাকা সাদা করার মাধ্যমে।
এবার অর্থনৈতিক দুর্নীতি ছাড়া আরও দুর্নীতির যে ডাইমেনশন রয়েছে তার মধ্যে অন্যতম রাজনৈতিক দুর্নীতি। সে প্রসঙ্গ এখানে না-ই টানলাম। রাজনৈতিক দুর্নীতির অবস্থান বিশ্লেষণ অনেক সময় সাপেক্ষ। অন্যান্য দুর্নীতির কথা বলি। আমরা চিন্তাও করতে পারি না আমরা প্রায় সকলেই কীভাবে দুর্নীতির সাথে জড়িয়ে পড়েছি।
কিছুদিন আগে হঠাৎ করে দুর্নীতির একটি নতুন ধারণা পেলাম। আমার খুব পছন্দ হয়েছে। ধারণাটি আমাদের সমাজেও প্রচলিত। ধারণাটি হলো ,"Noble cause corruption" অর্থাৎ ভালো কাজের উদ্দেশ্যে দুর্নীতি। একটি দুর্নীতিকে দূর করার জন্য আরেকটি দুর্নীতি করাই হচ্ছে Noble cause corruption। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে অনেকেই এধরনের দুর্নীতির সমর্থন দিয়ে থাকেন। এ ধরনের দুর্নীতির মাধ্যমে অনেকে নিজের দুর্নীতিকে পাকাপোক্ত করার চেষ্টা করেন। সত্যিকার অর্থে দুর্নীতির কোন সৎ উদ্দেশ্য থাকে না। দুর্নীতি মানসিকতা ও ধ্যান ধারণাকে সত্যিকারভাবে নষ্ট করে দেয়। আমাদের দেশে দুর্নীতিকে শুধু ব্যক্তিগত পর্যায়ে বিবেচনা করা ঠিক নয়। এটি একটি সামাজিক ব্যাধি হলেও দুর্নীতিই আমাদের সমাজের চাহিদা। এ সমাজে টিকে থাকতে হলে দুর্নীতি সহায়ক ভূমিকা পালন করতে হয়।
অনেক সৎ কর্মকর্তা সৎভাবে জীবন যাপন করার জন্য আত্মীয়-স্বজনের গালি ও ছেলেসন্তানদের তিরস্কার শুনেছেন। এ কথা ঠিক নয় যে শুধু সরকারি চাকরিজীবীরাই দুর্নীতির সাথে জড়িত। অনেকে আবার অর্থনৈতিকভাবে সৎ কিন্তু নিজের দায়িত্বে অবহেলা করেন। আর এই কাজগুলোও যে দুর্নীতি তারা তা ভুলে যান। এ করোনাকালে দুর্নীতির চিত্র দেখে তেমন মন খারাপ হয়নি। কারণ আমাদের জন্য এটি কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়।
ড. মো. কামাল উদ্দিন: প্রফেসর, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।