ড. আনিসুজ্জামানের মৃত্যুতে গভীরভাবে শোকাহত স্বজন, অনুরাগী, অনুগামীরা। নানাভাবে তাঁকে চিহ্নিত করা হচ্ছে: তিনি ছিলেন বাংলা সাহিত্যের অভিভাবক। সমাজ ও সংস্কৃতি মনস্ক নাগরিকবৃন্দের অগ্রণী৷ মুক্তবুদ্ধির প্রতীক। বিবেকের কণ্ঠস্বর। মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব। ধর্মনিরপেক্ষতার পক্ষে দাঁড়িয়ে তিনি লড়েছেন জীবনভর।
তাঁর চিরপ্রস্থানের সময় তাঁর সম্পর্কে আরেকটি উপমা মনে পড়ে, 'লাস্ট মুঘল' বা 'শেষ মুঘল'। কথাটা ব্যবহার করা হয় একটা ঐতিহ্য, একটা যুগ, একটা ঘরানা, একটা পরম্পরাগত শেষ ঐতিহ্যবাহী একজনকে বোঝাতে। তিনি ছিলেন তেমন একজন। ব্যক্তিত্বে, পেশায়, চিন্তায়, কর্মে মুঘলের মতো অভিজাত, যে ধরনের নিষ্ঠা ও সততার মানুষ ক্রমহ্রাসমান। তিনি ছিলেন তেমনই শেষ একজন।
কর্ম ও পেশায় তিনি চট্টগ্রাম, ঢাকা ও দেশ-বিদেশে বিভিন্ন স্থানে কাজ করেছেন। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ছিলেন। ভিন্নমতের সঙ্গে থেকেছেন। কিন্তু সর্বাবস্থায় তিনি ভব্যতা, পারস্পরিক মর্যাদা ও সুসম্পর্কের একটি আবহ বজায় রেখেছেন। মানুষ হিসেবে নিজের ও সহনাগরিকের সম্মান সমুন্নত রেখেছেন সর্বদা। প্রয়োজনে ত্যাগ স্বীকার করতেও কুণ্ঠিত হননি।
আরো পড়ুন: জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান আর নেই
বহু দৃষ্টান্ত দেওয়া যায়। একটি হলো, সুযোগ থাকার পরেও তিনি উপাচার্য পদ গ্রহণের জন্য অবনত হননি। উপাচার্য না হয়েও যে বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারে সর্বজন শ্রদ্ধেয় হওয়া যায়, সে প্রমাণ তিনি রেখেছেন।
কাজের প্রয়োজনে ইচ্ছায় বা সরকারের আগ্রহে তিনি বহু প্রতিষ্ঠান ও কমিটিতে যুক্ত হয়েছেন। কিন্তু কোনো অবস্থাতেই নিজের স্বকীয়তা ও ব্যক্তিত্ব বিসর্জন দেননি। কোনো মতাদর্শের প্রতি সমর্থন থাকলেও তিনি দলীয় অবস্থান গ্রহণ করেননি। নিজের নিরপেক্ষতা, বিবেক ও অনুভূতিই ছিল তাঁর চালিকা শক্তি।
বর্তমান পরিস্থিতিতে দলীয় বশংবদ ও অনুগতদের যে কুৎসিত প্রতিযোগিতা দেখা যায়, সেখানে তিনি এক উজ্জ্বল ব্যতিক্রম। দল বা গোষ্ঠী তার কাছে এলেও তিনি কারো কাছে গিয়ে কদাচ ধর্ণা দেননি। এমন সুদৃঢ় ব্যক্তিত্বের জন্য দলমত নির্বিশেষে সবার কাছেই তিনি শ্রদ্ধাভাজন ও গ্রহণযোগ্য।
পেশাগত দক্ষতা, মানবিক মর্যাদা, আত্মসম্মান, সৌজন্য তাঁর ব্যক্তিত্বের অন্যতম উপাদান। তাঁর সম্পর্কে শক্রুর পক্ষেও সমালোচনা করার মতো কোনো কারণ কখনো সৃষ্টি হয়নি। পরিমিতিবোধের কারণে এমন ভারসাম্যপূর্ণ জীবন তিনি যাপন করতে সক্ষম হয়েছেন, যা বর্তমানে শুধু বিরলই নয়, দুষ্প্রাপ্যও বটে।
বছর কুড়ি আগে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে ডাসের সামনে এক দুপুরে আমি ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের প্রফেসর ড. মুস্তাফিজুর রহমান ফিজু আড্ডা দিচ্ছিলাম। হঠাৎ চলন্ত একটি প্রাইভেট কারকে ধাক্কা দিয়ে একটি বেপরোয়া মোটরসাইকেল ভূপাতিত হয়। প্রাইভেট কারটিও সামান্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থেমে যায়।
ততক্ষণে একটি জটলা জমে ওঠে সেখানে। আমরা ছুটে গিয়ে দেখি, ড. আনিসুজ্জামান স্যার নিজের কিঞ্চিত ক্ষতিকর গাড়ি থেকে নামছেন। আমরা বেপরোয়া মোটরসাইকেল চালকে পাকড়াও করে ভৎসনা করতে থাকি। স্যার আমাদের কাছে এসে হাসলেন। বললেন, তোমরা এতো উতলা হচ্ছো কেন? আমাদের অবাক করে ছেলেটিকে সাবধানে চালনার পরামর্শ দিয়ে তিনি নির্বিঘ্নে চলে যেতে দিলেন। আর আমাদের সঙ্গে সৌজন্যসূচক কিছু কথাবার্তা বলে নিজেও চলে গেলেন। একটি দুর্ঘটনাকে ও নিজের কিছু ক্ষতিকে 'কিছুই হয়নি'র মতো এমন সহজে সামলাতে আমি আর কাউকে কখনো দেখিনি।
ড. আনিসুজ্জামানের মতো বড় মাপের মানুষ সমাজে সব সময় দেখা যায় না। সংখ্যায়ও এমন মানুষ খুব বেশি থাকেন না। আমাদের জন্য দুঃখ এটাই যে একটি আলোকিত, নান্দনিক, পরমতসহিষ্ণু সমাজের নেতৃত্ব দেওয়ার মতো উপযুক্ত মানুষ খুবই দ্রুত কমে যাচ্ছেন। তাঁর চিরপ্রস্থানের ফলে যে ক্ষতি হলো, তা অপূরণীয়। তাঁর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা।
ড. মাহফুজ পারভেজ: অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম