করোনা সারা বিশ্বকে এক অস্বস্তিকর পরিবেশের মধ্যে ফেলে দিয়েছে। করোনার কারণে পৃথিবীর প্রকৃত চিত্র সবার কাছে প্রকাশ পাচ্ছে। ভবিষ্যৎ পৃথিবী নতুন করে ঢেলে সাজানোর বিষয়ে অনেকে চিন্তা ভাবনা শুরু করে দিয়েছে।
পৃথিবী পরিবর্তনশীল। প্রাচীন যুগে মানুষ অভিযোজনের জন্য প্রকৃতির সাথে তাল মিলিয়ে নিজস্ব কর্মপদ্ধতি ও পরিকল্পনা গ্রহণ করতে বাধ্য হত। হয়তো ভবিষ্যৎ পৃথিবীর মানুষকেও বেঁচে থাকার জন্য নতুন নতুন কর্মপরিকল্পনা ও কার্যপদ্ধতি গ্রহণ করতে হবে।
পৃথিবীর ওপর মানুষের অত্যাচার অনেক হয়েছে। হয়ত আমরা নিজেদের স্বার্থের জন্য পৃথিবীকে ক্ষত-বিক্ষত করে ভবিষ্যৎ প্রজন্মদেরকেই হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছি। হতে পারে করোনা আগামী পৃথিবীকে সুন্দর করে সাজানোর বার্তাও নিয়ে এসেছে। সে যাই হোক, বর্তমানে করোনার দাপট সারা পৃথিবীর জ্ঞান-বিজ্ঞানকে নাজুক অবস্থায় ফেলে দিয়েছে। বাংলাদেশেও এই অবস্থা থেকে ব্যতিক্রম নয়।
সারা বিশ্বে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিকসহ প্রতিটি ক্ষেত্রেই করোনার প্রভাব পড়েছে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশসহ সারা দুনিয়ায় অগণিত মানুষ চাকরি হারিয়েছে যার প্রকৃত হিসাব আমাদের কাছে হয়ত নেই। শিল্প প্রতিষ্ঠান বিশেষ করে ক্ষুদ্র ও মাঝারি অনেক শিল্প প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাবার উপক্রম হয়েছে বা বন্ধ হয়েছে। ফলে অনেক মানুষ কর্মহীন বা সম্পূর্ণরূপে বেকার হয়ে পড়েছে। খোদ যুক্তরাষ্ট্রে ৬৬ লাখ মানুষ বেকার হয়ে পড়েছে। কাতারে বেশির ভাগ শ্রমিক বিদেশি হওয়ায় সেখানেও অনেক শ্রমিকের বেতন এমনকি খাবার জুটছে না।
সৌদি সরকার ইতোমধ্যে গাইডলাইন তৈরি করছে, যাতে সাধারণ লোকজনকে তৎক্ষণাৎ কর্মচ্যুতি না ঘটানো যেতে পারে। কিন্তু পরিস্থিতি বিবেচনায় শতকরা ৪০ ভাগ বেতন কর্তন করার বিষয়ে প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ কর্মজীবীদের সাথে চুক্তি করতে পারে। ইতোমধ্যে বিশ্বে তেলের বাজার মন্দা, যার দাম ব্যারেল প্রতি মাইনাস ১৩৭ ডলারে চলে যায়। ফলে ওপেকভুক্ত দেশগুলো বিশেষ করে সৌদি আরবে অর্থনৈতিক অবস্থা মন্দার দিকে ধাবিত হচ্ছে। সেখানে অনেক ক্ষেত্রেই রাজস্ব কর বৃদ্ধি করা প্রয়োজন হয়ে পড়েছে এবং কর আরোপ শুরু হয়ে গিয়েছে। ফলে মধ্যপ্রাচ্যে বেশির ভাগ দেশে মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়েছে। যার কারণে সেখান হতে বৈধ ও অবৈধ প্রবাসীদেরকে দেশে ফেরত পাঠাচ্ছে। বিশ্বের অর্থনৈতিক অবস্থা সুদৃঢ় না হলে অদূর ভবিষ্যতে আরও প্রবাসীদেরকে বাংলাদেশে স্থায়ীভাবে পাওয়া যাবে। বহু প্রবাসী ফিরে আসায় জনবহুল বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে বিরূপ প্রভাব পড়বে বলে অনেকে ধারণা করছে। কারণ প্রবাসীদের ফেরত আসায় রেমিট্যান্স চিত্র নিম্নমুখী দেখা যাচ্ছে।
প্রবাসী ফেরত সাথে দেশের বেকার সংখ্যা যোগ হওয়ায় নিট কর্মহীন লোকের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। সেই সাথে দারিদ্র্যতার হারও বৃদ্ধি পাবার সম্ভাবনাও প্রবল রয়েছে। দেশে সরকারি হিসাব মতে, বেকারের সংখ্যা ২৬ লাখ ৭৭ হাজার কিন্তু করোনার পরে হিসাব করলে সংখ্যা বৃদ্ধির সম্ভাবনাই থাকে। বর্তমানে যেখানে যুক্তরাষ্ট্রে বেকারের হার শতকরা ১৪ ভাগ পৌঁছে গেছে। যদিও প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বলেছেন, আগামী ৬ মাসের মধ্যে নতুন যারা বেকার হয়ে পড়েছে, তাদেরকে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হবে।
ইতোমধ্যে অর্থনৈতিক ধাক্কা সামলানোর জন্য বাংলাদেশ সরকার প্রায় ১ লাখ কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়েছে। যাতে শিল্প প্রতিষ্ঠান ও কৃষি খাতে কোন ধরনের সমস্যা সৃষ্টি না হয়। এ ছাড়া মানবিক কর্মসূচির আওতায় সাধারণ কর্মহীন মানুষদেরকে (জন প্রতি ২৫০০ টাকা) নতুন করে আরও ১২৫০ কোটি টাকা প্রদান করেছে। অধিকতর স্বচ্ছতার জন্য সরকার সরাসরি গ্রাহকের মোবাইল অ্যাকাউন্টে টাকা দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যার কার্যক্রম কার্যত দৃশ্যমান রয়েছে।
সম্প্রতি ভারত সরকার প্রায় ৩০০০০ হাজার কোটি ডলার বিশাল প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। যুক্তরাষ্ট্র, জাপান সহ বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্র তাঁদের অর্থনৈতিক বিবেচনায় বিভিন্ন রকমের প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। সকল রাষ্ট্র চাচ্ছে, নিজ নিজ অর্থনৈতিক ব্যবস্থা সুদৃঢ় থাকে। বাংলাদেশও তার ব্যতিক্রম কিছু করেনি। আবার অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি বা অর্থনৈতিক চাকা সচল রাখার জন্য দেশের খাদ্য উৎপাদন ব্যবস্থা, কর্মসংস্থান, প্রাকৃতিক পরিবেশ, তথ্য, প্রযুক্তি ও বিজ্ঞানের যথাযথ ব্যবহার, যোগাযোগ ব্যবস্থা ও আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিককরণ ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
বাংলাদেশের মাটি খাদ্য শস্য উৎপাদনের জন্য খুবই সহায়ক। আমাদের কৃষি সেক্টরের সফলতা অনস্বীকার্য। প্রতি বৎসর যে পরিমাণ জমি কমেছে বিপরীতভাবে আমাদের খাদ্য উৎপাদন কিন্তু বৃদ্ধি পাচ্ছে। বর্তমানে আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ ৮৫.৭৭ লক্ষ হেক্টর (বিশ্ব ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী প্রায় ৮০ লক্ষ হেক্টর) হলেও প্রতি বছর আবাদযোগ্য জমি কমছে প্রায় ৬৮ হাজার হেক্টরের মত, যা রীতিমত ভয়াবহ। আবাদযোগ্য ফসলি জমি ধ্বংসের অন্যতম কারণ একক পরিবার ও জনসংখ্যা বৃদ্ধি। এ ছাড়া যারা প্রবাসী অথবা অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হয়, তারা অনেকেই ঘর তৈরির জন্য কৃষি জমি ধ্বংস করে অনু্ৎপাদনশীল খাতে অর্থ বিনিয়োগ করে।
এ দেশের যারা বিত্তশালী আছে, তারা প্রয়োজনের তুলনায় একাধিক গাড়ী ব্যবহার করে একপ্রকার অনুৎপাদনশীল খাতেই বিপুল অর্থ অপচয় করছে। অথচ, দেশের অনেক মানুষ, না খেয়ে বা দরিদ্রতার কষাঘাতে মানবেতর জীবন যাপন করছে। বিশ্বের শীর্ষ ধনী বিল গেটস অথবা আজিম প্রেমজীর মতো দানশীল লোক বাংলাদেশে সৃষ্টি হচ্ছে না। যারা মানুষের জন্য এবং মানুষের তরে অকাতরে জীবন বিসর্জন দিয়ে গেছেন, শুধু তাঁরাই পৃথিবীতে স্মরণীয় হয়ে আছেন। সুতরাং বিত্তশীলদের বিলাসিতা ও অপরিকল্পিত শিল্প কারখানা গড়াও আমাদের কৃষি জমি হ্রাসের অন্যতম কারণ। এ ছাড়া ভূমিদস্যু কর্তৃক জমি দখলের বিষয়টি সর্বজন স্বীকৃত।
একথা স্বীকার করতে দ্বিধা নাই যে, কৃষকরা উৎপাদিত দ্রব্য থেকে ন্যায্য দাম না পাওয়া অথবা কৃষিতে লাভবান না হওয়ায় কৃষি জমি হ্রাস ও অনাবাদী হওয়ার অন্যতম কারণ। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, কৃষকরা ধান উৎপাদন করতে যে টাকা বিনিয়োগ করে, বিক্রি করে অনেকক্ষেত্রেই লোকসান হওয়ায় কৃষকরা কৃষি ক্ষেত্রে বিনিয়োগ বা কৃষি চাষে আগ্রহ হারিয়ে কৃষি জমি পরিবর্তন বা অনাবাদী অবস্থায় ফেলে রাখে।
কৃষকরা কেন লাভবান হয় না, কম-বেশি সবাই জ্ঞান রাখে কিন্ত সমাধান নাই!!! বাস্তবে করোনা কিন্ত আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে এর সমাধান। কিভাবে সমাধান সম্ভব???
আবার দেখা যাক, সরকার সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে বিভিন্ন ক্যাটাগরি মানুষের মধ্যে ভাতার ব্যবস্থা চালু রেখেছে। যার মাধ্যমে সাধারণ অসহায় মানুষ ন্যূনতম জীবন ধারণ করতে পারে। এই কার্যক্রমের প্রধান সমস্যা ছিল ঐ অসহায় মানুষদের সঠিক নির্বাচন। কেননা এক্ষেত্রে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা সঠিক মানুষের নির্বাচনে অনীহা ও নির্বাচন পদ্ধতি অনেকটাই দায়ী।
এক্ষেত্রে প্রাপ্যতার তুলনায় উপকারভোগীর সংখ্যার আধিক্য, একজন ব্যক্তির একাধিক উপকারভোগ করা (স্থানীয় জনপ্রতিনিধির ভূমিকাই মুখ্য), অযোগ্য ব্যক্তিবর্গের অন্তর্ভুক্তি, উপকারভোগী নিজেই জানে না তিনি কার্ডধারী কি না? (অর্থাৎ স্থানীয় জনপ্রতিনিধি কর্তৃক উপকারভোগীদের কার্ড প্রদান না করা) অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় উপকারভোগী নির্বাচন, মৃত ব্যক্তিদের উপকারভোগীদের তথ্য হালনাগাদ না করা এবং বিভিন্ন মন্ত্রণালয় কর্তৃক উপকারভোগী নির্বাচন বা ভাতা প্রদান নিশ্চিতকরণ।
একজন ব্যক্তি একটি সুবিধার পাওয়ার কথা বলা থাকলেও ক্রসচেকিং সিস্টেম উদ্ভব না হওয়ায় বরঞ্চ সমস্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। সুতরাং করোনার পরবর্তী সময়ে এই সমস্যা শীঘ্রই সমাধান হওয়া একান্ত আবশ্যক। এক্ষেত্রে উপজেলা প্রশাসন কর্তৃক যুগোপযোগী প্রস্তাবনা মন্ত্রণালয় প্রেরণ করতে পারে। তাহলে স্বচ্ছ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যোগ্য উপকারভোগী নির্বাচন করা সম্ভব হবে এবং দুর্নীতি হ্রাস পাবে।
আবার আমাদের দেশে বন উজাড় একটি নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা। পেশী আর অবৈধ অর্থ সরবরাহের কারণে বনজ জমির পরিমাণ খুবই কম। আবার নদী, খাল দখল আর পুকুর ভরাটের কারণে আমাদের মৎস্যখাতে সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে। ইটের ভাটার (বৈধ হোক অথবা অবৈধ হোক) কারণে মাটি কাটা অব্যাহত রয়েছে। এ ছাড়া পাহাড় কাটা অব্যাহত রয়েছে বহুকাল ধরেই। শিল্প কল-কারখানার বর্জ্য অব্যবস্থাপনা পানিকে করেছে বিষাক্ত। অস্বাভাবিক অনিয়ম আর অন্যায়ের কারণে পরিবেশ আর প্রকৃতির জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলছি।
এ সকল অব্যবস্থাপনা থেকে মুক্তি পেতে আমাদেরকে এগিয়ে আসতে হবে। সরকারকে সহযোগিতা করতে হবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, কৃষি জমির ব্যবহার বৃদ্ধি করতে। কোন জমি যেন অনাবাদী না থাকে। এজন্য প্রত্যেক উপজেলায় জমির প্রকৃতির ওপর নির্ভর করে বিভিন্ন কৃষিদ্রব্য ব্যবহার করতে হবে। বাড়ির আঙ্গিনায় শাক-সবজির চাষ করা যেতে পারে। পুকুর ভরাট বন্ধ করে সেখানে মৎস্য চাষ ও সমন্বিত হাঁস-মুরগী-মৎস্য চাষ করা যায়। যেখানে কৃষি, মৎস্য ও পশু-সম্পদ খাতের গবেষণায় বাংলাদেশ অগ্রগামী সেখানে উপজেলা ভিত্তিক উপজেলা প্রশাসন সমন্বিত সঠিক পরিকল্পনার মাধ্যমে ব্যবস্থা গ্রহণ করলে ইনশাল্লাহ বাংলাদেশে খাদ্যে সমৃদ্ধি আসবেই।
করোনায় অনেক মানুষ বেকার হয়েছে। আবার বিদেশফেরত প্রবাসীরা দেশে এসে অনেকে বেকার জীবন যাপন করছে। ফলে দেশের অর্থনীতিতে বিরাট চাপ পড়েছে। এ সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসতে হলে আমাদের দরকার কর্মসংস্থান। করোনা পরবর্তী সময়ে সমগ্র বিশ্বে খাদ্য ও কর্মসংস্থান গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রাখবে। অনেক দেশের অর্থ থাকবে কিন্তু খাদ্য থাকবে না। তখন অর্থের কোন মূল্য থাকবে না, সেই সাথে থাকবে না মানুষের জীবনের মূল্য। প্রয়োজনীয় দ্রব্য পাওয়া না গেলে, অর্থই বা কী ভূমিকা রাখবে? কারণ করোনার ভ্যাকসিন আমরা এখন পর্যন্ত আবিষ্কার করতে পারিনি। বিশ্বের সকল সম্পদশালী রাষ্ট্রই সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত ও অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। তাই এখন থেকে বাংলাদেশের জন্য দরকার উপজেলাভিত্তিক সঠিক পরিকল্পনা, ন্যায়-নিষ্ঠার আচরণ আর সরকারের প্রতি আস্থা।
মো. আমিনুর রহমান: সিনিয়র সহকারী সচিব, ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ সচিবালয়, ঢাকা ও প্রাক্তন উপজেলা নির্বাহী অফিসার, সখিপুর, টাঙ্গাইল।