ধীরে ধীরে চালু হচ্ছে শিল্প প্রতিষ্ঠান; খুলছে অফিস, কারখানা, দোকান পাট। তবে দীর্ঘদিন লকডাউনে থাকা প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের কাজে ফেরা নিয়ে সংশয় কাটছে না। চাকরি হারানোর শঙ্কাও বাড়ছে। বিশেষ করে আবাসন ও খাদ্যের পাশাপাশি নির্মাণ, খুচরা বিক্রি, ব্যবসা এবং প্রশাসনিক খাতগুলো বিশেষ ঝুঁকিতে রয়েছে। করোনার কারণে কর্মসংস্থানের এ সংকট বৈশ্বিক; সর্বব্যাপী। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) এর প্রতিবেদন অনুযায়ী কোভিড-১৯ এর কারণে এই বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে এসে আগামী তিন মাসের মধ্যে সারাবিশ্বে সাড়ে ১৯ কোটি মানুষ তাদের পূর্ণকালীন চাকরি হারাতে পারে।
আমেরিকার দুই কোটি ৪০ লাখ কর্মী, ইউরোপ ও মধ্য এশিয়ায় দুই কোটি, আরব দেশগুলোয় প্রায় ৫০ লাখ ও আফ্রিকায় এক কোটি ৯০ লাখ কর্মী চাকরি হারানোর আশঙ্কায় রয়েছে। আইএলও-র ভাষ্যমতে ২০০৮-২০০৯ সালের বিশ্ব মন্দার সময় যত মানুষ চাকরি হারিয়েছেন, এই হার তার চেয়েও বেশি। সে সময়ে বৈশ্বিক মন্দার সময়ে ওবামা প্রশাসনের একজন সক্রিয় কর্মী ক্যারেন জি মিলস মনে করেন ‘‘অনেকগুলো ক্ষুদ্র ব্যবসা একমাসের বেশি টিকতে পারবে না। এটি আর্থিক সংকটের চেয়েও আরও অধিকতর মন্দ অবস্থা হতে যাচ্ছে এবং দোকানগুলো শীঘ্রই তাদের কর্মীদের ছাঁটাই করতে হবে অথবা ভালোর জন্যে বন্ধ করতে হবে।’’
বাস্তবে বাংলাদেশে আমরা সেই পরিস্থিতি লক্ষ্য করছি। গত ২৬শে মার্চ থেকে লকডাউন শুরু হওয়ার পর থেকে হোটেল-রেস্তোরা, পরিবহন ও নির্মাণ খাতের মতো অনেক অনানুষ্ঠানিক খাতে কর্মরত শ্রমিকরা দীর্ঘদিন কর্মহীন হয়ে আছে। অনেকেই বেতন ভাতা পাচ্ছেন না। অনেক প্রতিষ্ঠানের শ্রমিকদের বেতনের দাবিতে রাস্তায় বের হয়ে রাস্তা অবরোধ করে বিক্ষোভ করতে দেখা গেছে। বিশেষ করে পোশাক ও বস্ত্রখাতের ৪৫ লাখ মানুষের কর্মহীন হওয়ার শঙ্কা, কর্মসংস্থানের সংকট প্রকট হতে পারে।
কারণ গত বছরের মার্চ মাসের তুলনায় এবছর মার্চ মাসে রপ্তানি হয়েছে ৩০ শতাংশ কম। বাংলাদেশ থেকে যে তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়, তার ৬৩ শতাংশ ইউরোপে যায়, বাকি ১৫ শতাংশ যায় আমেরিকায়। এসকল দেশগুলোর শিল্প বাণিজ্যে করোনার কারণে যে বড় ধরনের ধাক্কা লেগেছে তার ঢেউ বাংলাদেশে প্রবলভাবে আঁচড়ে পড়েছে।
দেশীয় বাজারেও এ খাতের ক্ষুদ্র ও খুচরা বিক্রেতারা ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। বিশেষ করে মার্চ ও এপ্রিল মাসে বাংলাদেশে স্বাধীনতা দিবস ও নববর্ষ উপলক্ষে যে বিপুল বেচাকেনা হয়, তা এবার শূন্যের কোঠায়। আবার রমজান শেষে আসন্ন ঈদেও বিক্রির আশা ক্ষীণ। তার মানে এই তিন-চার মাসের ধাক্কায় প্রায় বিপর্যস্ত বস্ত্র খাত, পোশাক শিল্পসহ অন্যান্য ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, ক্ষুদ্র শিল্প, খুচরা বিক্রেতারা। যার কারণে কর্মসংস্থান সংকট কিংবা কর্মী ছাঁটাইয়ের শঙ্কা অমূলক নয়। তাই বলে বিনা নোটিশে একতরফা কর্মী ছাটাই কাম্য নয়। এতে ভয়াবহতা আরও বাড়বে; সমস্যা ঘনীভূত হবে। বরং সবাইকে নিয়ে কীভাবে সংকট কাটিয়ে ওঠা যায় সেটাই বিবেচনা করা উচিৎ।
তাছাড়া, অর্থনীতির এই ঝুঁকি মোকাবেলা ও চলমান সংকট কাটিয়ে ওঠার জন্য সরকারের নির্দেশনায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে ইতোমধ্যে ৭২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা প্রণোদনা প্যাকেজসহ খাতওয়ারী নানা সুযোগ সুবিধা প্রদানের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পুনরুজ্জীবিত করা, শ্রমিক-কর্মচারীদের কাজে বহাল রাখা এবং উদ্যোক্তাদের প্রতিযোগিতার সক্ষমতা অক্ষুণ্ন রাখা- এসব আর্থিক সহায়তা প্যাকেজের মূল উদ্দেশ্য।
সম্ভাব্য পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য সরকারের উল্লেখযোগ্য চারটি আর্থিক সহায়তা প্যাকেজের মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্ত শিল্প ও সার্ভিস সেক্টরের প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল সুবিধা দেয়া; ক্ষুদ্র (কুটির শিল্পসহ) ও মাঝারি শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল সুবিধা দেয়া; বাংলাদেশ ব্যাংক প্রবর্তিত এক্সপোর্ট ডেভেলপমেন্ট ফান্ডের (ইডিএফ) সুবিধা বাড়ানো ও প্রি-শিপমেন্ট ক্রেডিট রিফাইন্যান্স স্কিম প্রণয়ন করার কাজ শুরু হয়েছে। ইতোপূর্বে রপ্তানিমুখী শিল্প প্রতিষ্ঠানসমূহের শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন/ভাতা পরিশোধ করার জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ৫ হাজার কোটি টাকার একটি আপৎকালীন প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছিলেন যা বাস্তবায়নের পথে। এগুলো যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হলে চলমান সংকট অনেকখানিই কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে। তাই করোনার এই ক্রান্তিকালে আতঙ্ক ও আশঙ্কায় বিচলিত হয়ে প্রতিষ্ঠানের কর্মী ছাটায়ের মত হটকারি সিদ্ধান্ত কখনোই কাম্য নয়।
নাজমুল হুদা: প্রাবন্ধিক, গবেষক ও উপপরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক