করোনাভাইরাস সংক্রমণ বিশ্বব্যাপী ক্রমবর্ধমান সামাজিক-অর্থনৈতিক ফাটল প্রকাশ করছে। অতিরিক্ত রোগীর চাপে দুর্বল স্বাস্থ্য কাঠামো ভেঙে পড়ছে। অপ্রতুল সামাজিক সুরক্ষা জাল অভাবগ্রস্তদের প্রয়োজন মেটাতে পারছে না। যথাযথ শ্রম সুরক্ষার অভাবে বিশ্বের কোটি কোটি লোক বেকার হয়ে পড়েছে। এমনকি বিশ্ব অর্থনীতি নগদ অর্থের সংকটে পড়তে চলেছে।
একই সঙ্গে মহামারিটি বিশ্বজুড়ে ক্ষমতাসীন অভিজাতদের অক্ষমতা এবং নেতৃত্বের অভাবের বিষয়গুলো তুলে ধরেছে। এটি স্পষ্ট যে অনেক রাজনৈতিক নেতাই চীনের এই প্রাদুর্ভাবের হুমকিকে অবমূল্যায়ন করেছেন এবং তাদের দেশগুলোকে জরুরি অবস্থার জন্য প্রস্তুত করার পরিবর্তে নিজেদের বাজারগুলো চলমান রাখার কৌশল বেছে নিয়েছিল। দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান, জার্মানি পদক্ষেপ নিয়েছিল। তারা জনসাধারণের সাথে স্বচ্ছভাবে যোগাযোগ করেছে এবং আপাত: দৃষ্টিতে একটি জাতীয় বিপর্যয় অনেকটাই এড়াতে সক্ষম হয়েছে।
মহামারিটির এই প্রকাশ্য বিষয়টি বিশ্বজুড়ে লোকরঞ্জনবাদী (পপুলিস্ট) নেতৃত্বের পক্ষে বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে। এখন তারা নিজেদের অযোগ্যতা প্রকাশিত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছেন। পপুলিস্ট নেতৃত্ব তাদের চারপাশের সংকীর্ণ ব্যবসায়িক বৃত্তের স্বার্থকে প্রাধান্য দিচ্ছেন। ফলে তাদের দেশগুলোকে অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা এবং সামাজিক নিরাপত্তাহীনতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
এই সময়ের জরুরি পরিস্থিতি অস্বীকার করে লোকরঞ্জনবাদী (পপুলিস্ট) নেতৃত্ব জনগণকে প্রভাবিত করতে জাতীয়তাবাদী, সুরক্ষাবাদী এবং ঘৃণাভিত্তিক এজেন্ডার প্রচার করে চলেছে। জলবায়ু পরিবর্তন এবং উদ্বাস্তু সংকট সম্পর্কে তাদের উদাসীনতা এবং চলমান করোনাভাইরাস মহামারি সম্পর্কে তাদের প্রতিক্রিয়াগুলোতে এটি স্পষ্ট। এই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংকটের জন্য বিশ্বব্যাপী যে সহযোগিতা, দায়বদ্ধতা এবং সংহতি প্রয়োজন তাদের অবস্থান ঠিক এর উল্টো।
এমনকি কৌশল হিসেবে লোকরঞ্জনবাদী ক্ষমতাসীনরা তাদের পুরোনো অনেক বহুল চর্চিত বর্ণবাদকে দ্বিগুণ উদ্যমে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছেন। যেখানে মহামারিটির সম্ভাব্য অভিঘাত সম্পর্কে জনগণকে বোঝাতে সরকারি সংস্থা, গণমাধ্যম এবং শিক্ষাবিদদের প্রয়োজন সেখানে লোকরঞ্জনবাদী রাজনীতিবিদের দ্বারা সবাই হরহামেশা আক্রমণ ও প্রশ্নের সম্মুখীন হচ্ছেন। বরং, ভিন্ন রকমের কৌশলের অবতারণা করে চলেছেন। কৌশলটি হলো- রাজনীতিবিদরা তাদের নিষ্ক্রিয়তার বিপর্যয়মূলক পরিণতি থেকে জনগণের দৃষ্টি অন্যদিকে সরানো। এই নেতৃত্ব দুটি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে মহামারিটিকে ব্যবহারের জোর প্রচেষ্টা শুরু করেছে। এক, নিজেদের শক্তি সুসংহতকরণ ও দুই, পুনঃনির্বাচিত হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করা।
চলমান এই সংকটের পরিপ্রেক্ষিতে কয়েকটি উদাহরণের দিকে তাকালে বিষয়টি বোধগম্য হবে। যেমন হাঙ্গেরিতে, প্রধানমন্ত্রী ভিক্টর অরবান ১১ই মার্চ জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছিলেন। তিন সপ্তাহেরও কম সময় পরে সংসদ একটি আইন পাশ করে ডিক্রি জারি করে অরবানকে করোনাভাইরাস মোকাবেলার নামে অনির্দিষ্টকালের জন্য শাসন করার অনুমতি দেয়। তবে, সবচেয়ে বড় সমালোচনা হচ্ছে ডিক্রিতে কোনও ব্যক্তি মহামারিবিরোধী মিথ্যা তথ্য ছড়িয়ে দিলে কারাদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। অথচ, ডিক্রিতে প্রাদুর্ভাবের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য যে প্রয়োজনীয় বিষয়গুলোর ওপর জোর দেয়া প্রয়োজন সেখানে ফোকাসটি নেই।
স্পষ্টত, অরবান নতুন আইনে জনগণকে ভয়ের সংস্কৃতিতে ঠেলে দিয়েছেন। এমনকি, মহামারির আগেও হাঙ্গেরিয়ান স্বাস্থ্য ব্যবস্থা খারাপ অবস্থায় ছিল। কোভিড-১৯ রোগীদের জন্য শয্যামুক্ত করার জন্য নেওয়া বিতর্কিত পদক্ষেপ এবং হাসপাতালের জন্য সুরক্ষামূলক গিয়ার এবং সরঞ্জামের অপর্যাপ্ত সরবরাহ সংকটটি পরিচালনা করার জন্য হাঙ্গেরিয়ান সরকারের কৌশল নিয়ে জোর সমালোচনা আছে। এছাড়া, স্বাস্থ্যখাতকে পাশ কাটিয়ে খেলাধুলাসহ অপ্রয়োজনীয় খাতে সরকারি ব্যয়ের সমালোচনাও হয়েছে।
এদিকে, ব্রাজিলে রাষ্ট্রপতি জায়ের বলসোনারো মহামারি বিরোধী যে কোনও পদক্ষেপের সক্রিয়ভাবে বিরোধিতা করেছেন। তিনি দাবি করেছেন যে ভাইরাসটি কেবল "একটি কল্পনা (ফ্যান্টাসি)", "একটি" মারাত্মক ঠান্ডা "এবং আক্রান্ত হলে তিনি কিছুতেই অনুভব করবেন না "। তিনি স্থানীয় সরকারের দ্বারা আরোপিত লকডাউনগুলোর বিরুদ্ধে সমাবেশে অংশ নিয়েছেন। তিনি কেবলমাত্র গণমাধ্যমকে বারবার আক্রমণ করে এবং বিজ্ঞানী ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা'র পরামর্শ নিয়ে প্রশ্ন তুলে ক্ষান্ত থাকেননি বরং সক্রিয়ভাবে ভুলভাল তথ্য পরিবেশন করেছেন।
এমনকি ব্রাজিলের ২৭ জন গভর্নরের মধ্যে ২৫ জন গভর্নর যখন বলসোনারোকে প্রাদুর্ভাবের বিরোধী কঠোর পদক্ষেপ ফিরিয়ে দেওয়ার দাবিতে একটি যৌথ চিঠিতে স্বাক্ষর করেছিল, তখন তিনি তাদেরকে ‘চাকরিজীবী’ বলে অভিযুক্ত করেছিল। এমনকি তার পুনঃনির্বাচনে নাশকতাকারী সাব্যস্ত করতে কুণ্ঠাবোধ করেননি। সুতরাং, মহামারিটির প্রতিক্রিয়ায় নেতৃত্ব দেওয়ার পরিবর্তে, ব্রাজিলিয়ান এই শক্তিশালী ব্যক্তির কৌশলটি হল ব্রাজিলের সমৃদ্ধি আনতে তার ডানপন্থী কৌশলের বিপর্যয় ঢাকা। সেটি করার জন্য স্থানীয় সরকারের বিরুদ্ধে জনগণকে উস্কে দেওয়া এবং সর্বশেষ ব্রাজিলের ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক সঙ্কটের জন্য স্থানীয় সরকারকে দোষারোপ করা।
একইভাবে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সংকট সমাধানের জন্য অঙ্গরাজ্যগুলোর গভর্নরদের সঙ্গে কাজ করার পরিবর্তে জনমতকে প্রভাবিত করার জন্য প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ইতোপূর্বে, ট্রাম্প করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাব আমেরিকার জন্য কোনও হুমকি নয় বলে দাবি করেছিল। যদিও পরে তার তার দাবি থেক সরে আসেন। করোনাভাইরাসে যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিদিনকার মৃত্যুর মিছিল তার প্রশাসনকে লিটমাস টেস্টের উপর রেখেছে।
ট্রাম্প গণমাধ্যমের মুখোমুখি হওয়ার পরে তার ব্যর্থতা ঢাকতে একটা অজুহাত সামনে এনেছেন। সেটি হলো, মহামারিটিকে মোকাবেলায় তার প্রশাসনের বিলম্বে কাজ শুরু করা। এর বাইরে, চীনকে বারংবার দোষারোপ, ওবামা প্রশাসনের পক্ষে কার্যকর পরীক্ষা-নিরীক্ষার অভাব এবং আমেরিকার অঙ্গরাজ্যগুলোতে ভেন্টিলেটরগুলোর অভাবের জন্য বিভিন্ন গভর্নরকে দায়ী করেছেন। এই সমস্যাগুলো সমাধান করার দিকে মনোনিবেশ করার পরিবর্তে চাকরি রক্ষার জন্য তিনি যুক্তরাষ্ট্রে সমস্ত অভিবাসন স্থগিত করার ঘোষণা করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের করোনাভাইরাস টাস্ক ফোর্স এর নিয়মিত ব্রিফিং-এ প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এর দায়িত্বজ্ঞানহীন ও খামখেয়ালি মন্তব্য সুবিদিত। অতি সম্প্রতি, কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত রোগীদের শরীরে জীবাণুনাশক প্রবেশ করিয়ে করোনাভাইরাসের চিকিৎসা করা যায় কিনা মন্তব্য করে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েন ।
মোদ্দাকথা, ডোনাল্ড ট্রাম্পের নজর এখন নভেম্বরের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের দিকে। এমনকি, মহামারির হালনাগাদ তথ্য নিয়ে মাইক পেন্সের করা প্রতিদিনের ব্রিফিংকে নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণার সুযোগে রূপান্তরিত করেছেন। রিপাবলিকান পার্টি বিভিন্ন প্রচারণা ও প্যাকেজগুলোর মাধ্যমে বড় বড় ব্যবসায়ীদের জন্য বেইল আউট (ঋণ সুবিধা) দেওয়ার ওপর জোর দিয়েছে। ব্যবসায়ীদের হাতে রাখতে পারলে তার নির্বাচনী প্রচার অনুদান ফান্ডে কোনো ঘাটতি হবে না। অধিকন্তু, পুনঃনির্বাচনের জন্য ব্যবসায়ীদের সমর্থনও যে জরুরি সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না।
অরবান, বলসোনারো এবং ট্রাম্প মহামারি সম্পর্কে জাতীয় প্রতিক্রিয়া ভুলভাবে ছড়িয়ে দেওয়ার বৈশ্বিক ধারার তিনটি উদাহরণমাত্র। শেষ পর্যন্ত এটি কেবল স্বাস্থ্য সঙ্কট নয়, বরং জাতীয় এবং বৈশ্বিক সংকট বললে অতুক্তি হবে না। বস্তুত: লোকরঞ্জনবাদের (পপুলিজম) ব্যর্থতা চরমভাবে প্রমাণিত হচ্ছে যা দিনশেষে শুধু অসার ও ঘৃণ্য বক্তৃতাই (রেটোরিক) সরবারহ করে চলেছে। জাতীয় ও বৈশ্বিক সমস্যার জন্য কোন ধরণের সামাজিক বা অর্থনৈতিক সমাধানসূত্র এদের কাছে অজানা এবং মহামারিটি সেটাকেই চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখাচ্ছে।
মো. শরীফ হাসান: শিক্ষক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।