আমরা মোটেই প্রস্তুত ছিলাম না এমন পরিস্থিতির জন্য। না আমাদের সরকার, না, আমাদের জনগণ। কেউই না। গোটা পৃথিবীও না। মাত্র দুই মাস আগেও আমাদের শহরগুলো ছিল ব্যস্ত। মানুষ ছিল কর্মচঞ্চল। রাস্তা জুড়ে ছিল কর্মজীবী মানুষের অবাধ বিচরণ। যানবাহনে ঠাসা ছিল রাজধানী ঢাকার প্রতিটি সড়ক। অধিক জনসংখ্যার দেশে গায়ে গা লাগিয়ে চলতো মানুষ। সব কিছু যেন হঠাৎ করেই থমকে গেছে। উলট-পালট হয়ে গেছে ছকে বাঁধা জীবন। মানুষের স্বাভাবিক জীবন আটকে গেছে চার দেয়ালের মধ্যে। যেন প্রতিটি শহর, পুরো দেশটা কারাগারে পরিণত হয়েছে।
এই ভাইরাস সহসা নির্মূল হচ্ছে না। তবে করোনাভাইরাস আপাতত নির্মূল হোক বা না হোক- এই মহামারি বিশ্ব অর্থনীতিতে যে ধাক্কা দিয়েছে সেটি কাটিয়ে উঠতে অনেক দীর্ঘ সময় লাগবে। আর এর ব্যাপক প্রভাব পড়বে খাদ্যের ওপর। বিশেষ করে স্বল্প আয়ের এবং আমাদের মত উন্নয়নশীল দেশগুলোকে এই ধাক্কা সামাল দিতে হিমশিম খেতে হবে তাতে কোন সন্দেহ নেই।
বিশ্বে খাদ্যের সংকট দেখা দেবে- করোনাভাইরাস মহামারি আকার ধারণ করার আগেই এমন সতর্কবার্তা দিয়েছিল বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি)। প্রতিষ্ঠানটির নির্বাহী পরিচালক ডেভিড বিসলে সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, করোনাভাইরাসের কারণে দেখা দেওয়া মহামারিকেও ছাড়িয়ে যাবে খাদ্যের সংকট, দুর্ভিক্ষও দেখা দেবে।
খাদ্যের এই সংকট মোকাবেলায় এখনই প্রস্তুতি না নিলে প্রতিদিন প্রাণ যেতে পারে বহু মানুষের। বিশ্বকে সতর্ক করে দেয়া ডব্লিউএফপি’র প্রতিবেদনে আফ্রিকার দেশ কঙ্গো, সুদান, ইথিওপিয়া, মধ্যপ্রাচ্যের ইয়েমেন, সিরিয়া, লেবাননসহ বিশ্বের কয়েকটি দেশের কথা উল্লেখ করলেও বাংলাদেশের কথা সেখানে নেই। এটা আমাদের জন্য খুবই স্বস্তির খবর। এর কারণও আছে। খাদ্য সংকট নিয়ে ডব্লিউএফপি তাদের সতর্ক বার্তায় যেসব দেশের কথা উল্লেখ করেছে, সেসব দেশে যুদ্ধ, সহিংসতা, খরা, পঙ্গপালের আক্রমণসহ নানা সমস্যা রয়েছে। তবে করোনাভাইরাসের ফলে এখন দেশে দেশে লকডাউনের কারণে যে সংকট তৈরি হয়েছে তার সুদূর প্রসারী প্রভাব পড়বে অর্থনীতিতে। ইতোমধ্যে বহু প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে, বহু প্রতিষ্ঠান কর্মী ছাঁটাই করছে। কর্মহীন ও বেকার হয়ে পড়ছেন লাখ লাখ মানুষ।
আমাদের দেশও এর বাইরে নয়। গত দুই মাস ধরে চলছে লকডাউন। সাধারণ ছুটির মেয়াদ আরও ১৪ দিন বাড়িয়ে ৩০ মে পর্যন্ত করা হয়েছে। গণপরিবহণ ব্যবস্থা এখনও বন্ধ রয়েছে। এই অবস্থায় বেকারত্বও বাড়ছে। ফলে এর প্রভাব গিয়ে পড়ছে অর্থনীতিতে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, দেশে এখন দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সংখ্যা চার কোটি ৫০ লাখ। আর বেসরকারি ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর তথ্য অনুযায়ী, এই সংখ্যা সাড়ে ছয় কোটি। দিন মজুর, দরিদ্র, দিন আনে দিন খায়, নিম্ন আয়ের মানুষগুলোর সংকট দিনে দিনে বাড়ছে। আয়ের উৎস বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এই শ্রেণীর মানুষের খাদ্যের সংকটও বাড়ছে। কঠিন হয়ে পড়ছে তাদের জীবনযাপন। যদিও সরকার নিম্ন আয়ের এসব মানুষকে খাদ্য সহায়তা দিচ্ছে। কিন্তু সেটা পর্যাপ্ত নয়।
এই সংকটময় পরিস্থিতিতে এখন আলোচনা হচ্ছে খাদ্য নিয়ে। করোনা পরবর্তী বাংলাদেশে যেন খাদ্যের কোন রকম সংকট না হয় সেদিকেই বেশি মনোযোগ দেয়া জরুরি। বাংলাদেশ গত কয়েক বছর ধরেই খাদ্যশস্য উৎপাদনে স্বয়ং সম্পূর্ণ। দানাদার খাদ্যশস্যের পাশাপাশি পুষ্টিকর খাবার উৎপাদনে বাংলাদেশ অনেক ক্ষেত্রে রেকর্ড সৃষ্টি করেছে। দানাদার খাদ্যশস্যের মধ্যে চাল উৎপানে আমরা এখন আগের চেয়ে অনেক এগিয়েছি। গত বছরে দেশে উৎপাদিত চালের পরিমাণ ৩ কোটি ৮০ লক্ষ মেট্রিক টন। এর বিপরীতে আমাদের বার্ষিক চাহিদা হচ্ছে কমবেশি প্রায় তিন কোটি মেট্রিক টন। অর্থাৎ চাহিদা পূরণের পর প্রায় ৭০ লাখ মেট্রিক টন উদ্বৃত্ত ছিল। আর গমের ক্ষেত্রে আমাদের বার্ষিক চাহিদা হচ্ছে ৪৫ থেকে ৫০ লাখ মেট্রিক টন। এর বিপরীতে আমাদের উৎপাদন হয় মাত্র ১৩ থেকে ১৪ লাখ মেট্রিক টন। গত বছর হয়েছিল ১৪ লাখ মেট্রিক টন। আমাদেরকে বছরে আমদানি করতে হয় ৫০ থেকে ৫৫ লাখ মেট্রিক টন। একইভাবে আমরা প্রতি বছরই রেকর্ড পরিমাণ আলু উৎপাদন করছি। চাহিদা যেখানে প্রায় ৫০ থেকে ৬০ লাখ মেট্রিক টন, সেখানে আমাদের উৎপাদন হচ্ছে ৮০ থেকে ৯০ লাখ মেট্রিক টন। এর বাইরে আমাদের মসুর ডালের বার্ষিক চাহিদা হচ্ছে প্রায় ৫ লাখ মেট্রিক টন। যেখানে আমাদের উৎপাদন হয় মাত্র দুই লাখ থেকে আড়াই লাখ মেট্রিক টন।
মাছ, মাংস, শাকসবজি, ডিম উৎপাদনের আমরা স্বয়ং সম্পূর্ণ। বিশেষ করে মাছ উৎপাদনে আমরা বিশ্বের চতুর্থ শীর্ষ দেশ। গত অর্থ বছরে দেশে মাছের উৎপাদন হয়েছে প্রায় ৪৪ লাখ মেট্রিক টন। মাংস উৎপাদনেও আমরা পিছিয়ে নেই। গত অর্থ বছরে মাংসের উৎপাদন ছিল প্রায় ৭৫ লাখ মেট্রিক টন। চাহিদার তুলনায় অন্তত তিন লাখ মেট্রিক টন বেশি। গত অর্থ বছরে আমাদের ডিম উৎপাদনের পরিমাণ ছিল এক হাজার ৭১১ কোটি পিস। দুধ উৎপাদনও হয়েছে প্রায় ৯৯ লাখ মেট্রিক টন।
সব মিলিয়ে বাংলাদেশে বর্তমানে খাদ্যের কোন সংকট নেই। এটা যেমন সত্য তেমনি বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতিতে অর্থাৎ করোনা পরবর্তী বিশ্বে আমাদের খাদ্যের সংকট হবে না- তা এখনই বলা যায় না। খাদ্য সামগ্রী উৎপাদনে আমরা ভালো অবস্থানে আছি নি:সন্দেহে। আমাদের কৃষিমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক বলেছেন, আগামী সাত-আট মাস আমাদের দেশে খাদ্যের কোন সংকট হবে না। আমরাও মাননীয় মন্ত্রীর কথায় আশ্বস্ত হতে চাই। সংকট যেন কখনই না হয়, মানুষ যেন সংকটের মুখোমুখি না হয় সেটাই প্রত্যাশা করি।
কিন্তু শুধু প্রত্যাশা করলেই কী সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে? আমার মনে হয় না। খাদ্যের উৎপাদন ও মজুদ বৃদ্ধি করাই হচ্ছে সবচেয়ে নিরাপদ পন্থা। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা করোনা সংকট সৃষ্টি হওয়ার পর থেকেই বার বার বলছেন, খাদ্যের উৎপাদন বাড়াতে হবে। এক ইঞ্চি জমিও পতিত রাখা যাবে না। সরকার কৃষককে সব ধরণের সহযোগিতা করবে সেই প্রতিশ্রুতিও দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।
হ্যাঁ, আমাদের উৎপাদন বাড়ানোর কোন বিকল্প নাই। আমাদের সামনে এখন আউশ ও আমন মওসুম। এরপরই রবি শস্যের মওসুম। এই তিন মওসুমকে সামনে রেখে বিশেষ করে আউশ ও আমন মওসুমে চালের উৎপাদন বাড়াতে হবে। এক সময় আমন মওসুম ছিল আমাদের প্রধান চাল উৎপাদনকারী মওসুম। এখন বোরো ফসল সেই স্থানটি দখল করেছে। অতীতে যেভাবে আমন উৎপাদন হতো সেভাবে এখন আবারও আমনের উৎপাদন বাড়াতে হবে। কোন জমি পতিত রাখা যাবে না। একইভাবে কৃষি জমি নষ্টও করা যাবে না। পাশাপাশি উৎপাদনের ক্ষেত্রে কৃষককে আর্থিক ও মানসিক সমর্থন দিতে হবে। বিনামূল্যে সার, বীজ, কীটনাশক সরবরাহ করতে হবে। বিশেষ করে সঠিক সময়ে সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে উৎপাদিত পণ্যের বাজারজাতকরণ নিশ্চিত করে কৃষকের ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে হবে। কৃষক যাতে কোথাও না ঠকে, প্রতারণার শিকার না হয়, সে দিকে বিশেষ নজর দিতে হবে। ৪ শতাংশ সুদে কৃষককে যে ঋণ দেয়ার কথা সরকার বলছে, সেটি যেন প্রকৃত কৃষক, চাষিরা পায় সেটা শতভাগ নিশ্চিত করতে হবে। কৃষক নাম দিয়ে যেন প্রভাবশালীরা সেই ঋণের টাকা নিজেদের পকেটে না নিতে পারে সেদিকে দৃষ্টি দিতে হবে এবং কঠোর হতে হবে।
মনে রাখতে হবে, কৃষি নির্ভর বাংলাদেশে কৃষক-ই প্রধান শক্তি। সামনে যে কঠিন দিন আসছে অর্থাৎ খাদ্য সংকটের যে ধ্বনি শোনা যাচ্ছে- তা থেকে মুক্তি পেতে হলে আমদানি নির্ভরশীলতা কমাতে হবে। উৎপাদনেই জোর দিতে হবে। আর আগামীর এই সংকট মোকাবেলায় কৃষকের শক্তিকেই কাজে লাগাতে হবে। একমাত্র কৃষকই পারবে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে। দরকার শুধু তার পাশে থাকা।
নিজামুল হক বিপুল: সাংবাদিক ও প্রাবন্ধিক