শিক্ষকদের বেতন দিতে নৈরাজ্য কেন?

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

মোস্তফা মল্লিক | 2023-09-01 20:47:13

করোনাভাইরাসের আক্রমণে পুরো বিশ্বের যখন তছনছ অবস্থা তখন খুব স্বাভাবিকভাবে ভালো নেই আমরাও। রাস্তায় মানুষের ঢল, ব্যক্তিগত যানবাহন-রিকশার বাড়াবাড়ি রকম চলাচল আর পোশাক কারখানায় কর্মীর উপস্থিতি বলে দেয়-উপার্জনের জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে মানুষ।

ভালো অবস্থায় আছে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে প্রকাশিত ‘স্ট্যাটিসটিকস অব সিভিল অফিসার্স অ্যান্ড স্টাফ ২০১৮’ অনুযায়ী সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর মোট সংখ্যা ১৩ লাখ ৯১ হাজার ৫৫ জন। ভালো অবস্থা বলতে, নিয়মিত বেতন পাচ্ছেন তারা।

এর বাইরে কর্মক্ষম মানুষ যারা এই বাংলাদেশকে টিকিয়ে রেখেছেন তাহলে তারা কি ভালো নেই? গণমাধ্যমে বেশ কিছু বড় বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের খবর এসেছে-যাদের গত দুই থেকে তিন মাস কোনো উপার্জন না থাকলেও তাদের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন পরিশোধ করেছে। এমন সংবাদ আমাদের আশা জাগায়। সমাজের বিত্তবান কিছু মানুষ, সেনাবাহিনী, পুলিশ, বিজিবিসহ আরো অনেক প্রতিষ্ঠান প্রায় প্রতিদিনই কারো না কারো কাছে খাবার পৌঁছে দিচ্ছে। করোনার কারণে সারাদেশের ক্ষতিগ্রস্ত ৫০ লাখ দরিদ্র পরিবারকে এককালীন আড়াই হাজার টাকা দেয়ার জন্য এক হাজার ২শ’ ৫৭ কোটি টাকা এরই মধ্যে ছাড় করেছে অর্থমন্ত্রণালয়। এমন সব সংবাদ আমাদের মনকে আরো চাঙ্গা করে, ভালো করে দেয়।

কিন্তু হতাশার খবরও কম নয়। দেশের প্রায় ডজন খানেক শিক্ষক সংগঠন লাগাতার সংবাদ সম্মেলন করে জানিয়ে দিয়েছে ভালো নেই তারা। কারণ হিসেবে বলছে, গত ১৭ মার্চ থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ থাকার কারণে শিক্ষার্থীর কাছ থেকে বেতন নিতে পারছে না প্রতিষ্ঠানগুলো। সে কারণে বন্ধ শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারীদের বেতন। তবে এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা যেহেতু সরকারি কোষাগার থেকে বেতন পান সেজন্য তাদেরও খুব একটা চিন্তা নেই। তবে চিন্তায় আছেন এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠানের নন এমপিও শিক্ষকরাও। কারণ তাদের বেতন হয় স্কুল-কলেজের নিজস্ব ফান্ড থেকে। শিক্ষার্থীরা বেতন দেয় না বলে এরকম প্রতিষ্ঠানের প্রায় দু লাখ শিক্ষকের বেতন বন্ধ। এর মধ্যে ঐতিহ্যবাহী এবং দেশ সেরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও আছে।

গত ১৭ মে রোববার একই আবেদনে ৬ লাখ শিক্ষক একই সময়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে স্ট্যাটাস দিয়েছেন। দেশের ৪০ হাজার কিন্ডারগার্টেন স্কুলের এই ৬ লাখ শিক্ষকের সংগঠন বাংলাদেশ কিন্ডারগার্টেন এসোসিয়েশন এমন ব্যতিক্রমী আয়োজন করে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে একটি খোলা চিঠি লেখেন শিক্ষকরা। ঠিক বেলা ১১টার সময় ৬ লাখ শিক্ষক স্ট্যাটাস দেন। তারা বলেছেন, ‘আজকের শিশু আগামী সম্পদ। দেশের আগামী নেতৃত্ব ন্যস্ত হবে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিশুদের হাতেই।

শিক্ষায় দৃশ্যমান সাফল্য বাংলাদেশের একটি বড় অর্জন। সারা বিশ্বে এই অর্জন স্বীকৃত। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আপনার নেতৃত্বেই সম্ভব হয়েছে এমন অর্জন। আমরা বাংলাদেশ কিন্ডারগার্টেন স্কুলের ৬ লাখ শিক্ষক গর্বিত এই জন্য যে, এই অর্জনের অংশীদার আমরাও। করোনাভাইরাসের এমন সংকটময় মুহূর্তে আমরা তাকিয়ে আছি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আপনার দিকে। এই মুহূর্তে আমরা আপনার প্রণোদনা প্রত্যাশী।’ খোঁজ নিয়ে জানতে পেরেছি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকে শিক্ষকদের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাদের কি প্রয়োজন সেটা জানতে চাওয়া হয়েছে। একাধিক শিক্ষক সংগঠনের নেতারা প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ে তাদের আবেদনের কথা জানিয়েছেন।

শিক্ষকদের বেতন নেই-এমন সংবাদ যখন শিরোনাম হয় তখন মন খারাপ হওয়ারই কথা। কিন্তু শিক্ষা নিয়ে যারা কিছুটা ঘাটাঘাটি করেন তারা আবার অন্য প্রশ্নও দাঁড় করান। এমন তো হওয়ার কথা নয়! বছরের শুরুর দিকে গণমাধ্যমের প্রতিবেদন, মন্ত্রণালয়ের কঠোর হুঁশিয়ারি, তদন্ত কমিটি গঠন-এসব বলে দেয় বিপরীতে অন্য চিত্রও আছে। সেই চিত্র হচ্ছে অন্যকে ঠকানোর প্রবণতা। দেশের নানা প্রান্তে গড়ে ওঠা কয়েক হাজার কিন্ডারগার্টেন আর খুবই ছোট পরিসরে পরিচালিত কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছাড়া সবার তো কষ্টে থাকার কথা নয়।

‘গলাকাটা টিউশন ফি আদায়’- বছর জুড়ে পত্রিকাগুলোর শিরোনাম থাকে এরকম। প্রায় প্রতি বছরই করা হয় ‘টিউশন ফি নীতিমালা’। শিক্ষা মন্ত্রণালয় সংবাদ সম্মেলন করে ঘোষণা দেন, অতিরিক্ত অর্থ আদায় করা যাবে না। কিন্তু মাঠের চিত্র ভিন্ন। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশ আমলে নেয় না অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান।

স্কুলগুলোতে ভর্তির ওপর শিক্ষা মন্ত্রণালয় সর্বশেষ (২০১৯) যে নীতিমালা তৈরি করেছে, সেখানে বলা হয়েছে ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকায় অবস্থিত এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো শিক্ষার্থী ভর্তির ক্ষেত্রে পাঁচ হাজার টাকার অতিরিক্ত অর্থ আদায় করতে পারবে না। ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকার আংশিক এমপিওভুক্ত স্কুলগুলো উন্নয়ন এবং এমপিও বহির্ভূত শিক্ষকদের বেতন-ভাতা প্রদানের জন্য শিক্ষার্থী ভর্তির সময় মাসিক বেতন, সেশন চার্জ ও উন্নয়ন ফি’সহ বাংলা মাধ্যমে সর্বোচ্চ আট হাজার টাকা এবং ইংরেজি মাধ্যমে সর্বোচ্চ দশ হাজার টাকা গ্রহণ করতে পারবে। উন্নয়ন খাতে কোন প্রতিষ্ঠান তিন হাজার টাকার বেশি আদায় করতে পারবে না।

আমরা ঢাকার ক’জন অভিভাবক বুকে হাত দিয়ে বলতে পারব-এই নিয়ম মান্য করা হয়েছে? হয়নি। ৯৫ ভাগ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অভিভাবকদের ‘গলা কেটে’ ভর্তি ফি, উন্নয়ন ফি এবং টিউশন ফি নিয়ে থাকে।

শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলোর আয়-রোজগারের দিকে একটু নজর দেই। বড় বড় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, যেগুলো পরীক্ষার ফল, শিক্ষার্থী, মান সবদিক দিয়েই দেশ সেরা-তারা কখনোই মন্ত্রণালয়ের কাছে তাদের হিসাব জমা দেয়নি। দফায় দফায় নির্দেশ দেয়া হলেও কাজ হয়নি। বেসরকারি এমপিওভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সরকারি স্কুলের মতোই কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে ভবন নির্মাণ করে দেয় সরকার। শিক্ষকদের বেতনও দেয়া হয় সরকারি অর্থে। এর বাইরে শিক্ষার্থীর কাছ থেকেও নেয়া হয় চড়া টিউশন ফি। শতভাগ বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কথা বলছি না, যেসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সরকারের ব্যয় আছে-ওইসব প্রতিষ্ঠানের আয়-ব্যয় দু’টোরই হিসাব সরকারের জানা উচিত বলে মনে হয়। কিন্তু আমরা দেখছি উপার্জিত টাকার ওপর সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণই নেই।

২০১৫ সালের ১০ জুন জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাপনা একাডেমি (নায়েম) মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত এক আলোচনা সভায় তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেছিলেন, ‘১৯৮১ সালে ৭ হাজার ৫০৩টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিদর্শনে সরকারের প্রায় আড়াই শ’কোটি টাকা ব্যয় হতো। বর্তমানে ৩৩ হাজার প্রতিষ্ঠান পরিদর্শনে ব্যয় হয় সাড়ে সাত হাজার কোটি টাকা’। তার মানে দাঁড়াচ্ছে সাড়ে সাত হাজার কোটি টাকা ব্যয় করেও আমরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর তথ্য ঠিক মতো জানতে পারছি না। আর জানতে পারছি না বলেই, করোনার মতো এমন তছনছ হওয়া পরিস্থিতি তৈরির কারণে শিক্ষার্থীর টিউশন ফি আদায় বন্ধ থাকায় (যদিও পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে শিক্ষার্থী বেতন আদায় হয়ে যাবে) শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারীদের বেতন বন্ধ করে দেয়ার সাহস দেখায় স্কুল-কলেজ কর্তৃপক্ষ। যদি সরকারের কাছে পূর্ণাঙ্গ তথ্য থাকতো তাহলে শিক্ষকদের বেতন দেয়ার ক্ষেত্রে এমন নৈরাজ্য সম্ভব হতো না।

সরকারের ব্যয় রয়েছে এমন প্রত্যেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে টিউশন ফি’র বাইরেও রয়েছে বিশাল অনুদান। প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা এই অনুদান দিয়ে থাকে। এছাড়া প্রতিষ্ঠানের জমি, স্কুল-কলেজ ক্যাম্পাসের বাইরে জায়গা, পুকুর, গাছ থেকে প্রচুর পরিমাণে আয় হয়ে থাকে। স্কুল-কলেজে যেমন উপার্জন হয় মাদ্রাসায় এর বাইরেও বাড়তি কিছু আয় আছে। ওয়াজ-মাহফিল থেকে মাদ্রাসাতে আয় হয় মোটা অংকের অর্থ। এসব আয়ের হিসাব নেই সরকারের কাছে। আর নেই বলেই খুব সহজে বলে দেয়া যায়, বেতন নেই শিক্ষকদের।

কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নাম বলে সেগুলোর সুনামে আঘাত করাটা ঠিক হবে না। তবে আকারে ইঙ্গিতে পাঠকরা ঠিকই বুঝতে পারবেন। ঢাকার খ্যাতনামা একটি নারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। যাদের মূল শাখা সিদ্ধেশ্বরী। এর বাইরে আজিমপুর, বসুন্ধরায় আরো তিনটি শাখা রয়েছে। ২০১৯ শিক্ষা বর্ষের মার্চ মাসে ‘টিউশন ফি’ (ছাত্রী বেতন) হঠাৎ করেই দুইশ’ টাকা বাড়িয়ে দেয়। স্কুল শাখায় প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত আগে বেতন ছিল এক হাজার একশ’ টাকা। মার্চে এক নোটিশে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তা বাড়িয়ে এক হাজার তিনশ’ টাকা নির্ধারণ করে। ষষ্ঠ থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত ছাত্রী বেতন দুইশ’ টাকা বাড়িয়ে করা হয় এক হাজার চারশ’ টাকা। আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে ছাত্রীদের ওপর নোটিশ কার্যকর করা হয় জানুয়ারি মাস থেকেই। চারটি শাখায় এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রী সংখ্যা ২৮ হাজার। ছাত্রী প্রতি দুইশ’ টাকা অতিরিক্ত গুনতে হয়েছে অভিভাবকদের। এ হিসাবে এক নোটিশেই সারা বছরে ছয় কোটি ৭২ লাখ টাকা বেশি আয় করেছে প্রতিষ্ঠানটি। এখন করোনা প্রভাবে মাত্র দু’মাস বেতন বন্ধ থাকার কারণে এই প্রতিষ্ঠানটি যদি কোনো কোনো শিক্ষকের বেতন বন্ধ রাখে তাহলে এর দায় কে নেবে?

ঢাকার মতিঝিলে আর একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ড্রেস কোড নিয়ে চলতি শিক্ষাবর্ষের শুরুতে কারো কারো ইন্ধনে হৈচৈ হয়েছিল। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির ফল বেশ ভালো। আগে প্রতিটি শিক্ষার্থীর মাথায় ছিল টুপি আর মেয়েদের বড় ওড়না। তবে এখন দেশের অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মতোই এই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের ইউনিফর্ম। গত বছরের জানুয়ারিতে দশম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থী প্রতি দুইশ’ টাকা করে বেতন বাড়িয়ে দেয়া হয়। কয়েকটি শাখা মিলে এই বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সংখ্যা ৩০ হাজার। শুধু এক নোটিশেই শিক্ষার্থীদের প্রতি মাসে বাড়তি গুনতে হচ্ছে ৬০ লাখ টাকা। এই প্রতিষ্ঠানের ননএমপিও শিক্ষকদের যদি করোনার অজুহাতে বিলম্বে কিংবা আংশিক বেতন অথবা কোনো কোনো ক্ষেত্রে বেতনই দেয়া না হয়-তাহলে কি করার আছে বঞ্চিত শিক্ষকদের?

দেশে বিভিন্ন ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছ। প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে কয়েক ধারার। মাধ্যমিক, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় নানাভাবে বিভক্ত শিক্ষা। এসবের পূর্ণাঙ্গ তথ্য পাওয়া খুবই কষ্টকর। তাই কয়েক বছর পেছনে নিয়ে যেতে চাই আপনাদের। ২০১৬ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর যেসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত অর্থ আদায় করেছে তার একটি প্রতিবেদন মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়। ওই প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, রাজধানীর ১৩টি বড় স্কুলে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত অর্থ আদায়ের তথ্য পেয়েছে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর-মাউশি। এর মধ্যে শ্রেণিভেদে শতভাগ পর্যন্ত বেতন বাড়িয়েছে বেশ কয়েকটি স্কুল। ওই সময় মাউশির মাধ্যমিকের পরিচালক ছিলে এলিয়াছ হোসাইন। তাকে প্রশ্ন করেছিলাম এতো কম স্কুল অতিরিক্ত অর্থ নিয়েছে? তিনি বলেছিলেন, সবাই সাড়া দেয়নি। এমনকি অনেক বড় বড় প্রতিষ্ঠান মাউশিকে সহায়তা পর্যন্ত করেনি। এই ১৩টি প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করে ৮০ হাজার শিক্ষার্থী। ভাবা যায় একশ’ টাকা করেও বৃদ্ধি করলে কি পরিমাণ অর্থ আদায় হয় প্রতি মাসে? যদিও এই ১৩টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নাম জানানো হয়নি প্রতিবেদনে। বলে রাখা ভালো যে, ২০১৬ সালে অতিরিক্ত অর্থ আদায়ের প্রতিবাদে ঢাকার শীর্ষ বেশ কয়েকটি স্কুলের অভিভাবকরা আন্দোলনে নামেন। লাগাতার আন্দোলনের কারণে তদন্ত কমিটি করতে বাধ্য হয় মাউশি। মাউশির এক আদেশে, সাত দিনের মধ্যে শিক্ষার্থীদের অতিরিক্ত নেয়া অর্থ ফেরত দেয়ার নির্দেশ দিলেও কাজ হয়নি কিছুই।

শুধু টিউশন ফি’ই নয়, এসএসসি পরীক্ষার আগে ফরম পূরণে অতিরিক্ত অর্থ আদায় করা হয়। ২০১৬ সালে ঢাকা শিক্ষা বোর্ড ওয়েবসাইটে ৮৬০টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের তালিকা ঝুলিয়ে রাখে যেসব প্রতিষ্ঠান ফরম পূরণের নামে তিন হাজার থেকে প্রায় ১৪ হাজার টাকা পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের থেকে বেশি আদায় করে।

একই বছর অর্থাৎ ২০১৬ সালে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের আরেকটি তদন্ত প্রতিবেদনে দেখা যায়, কাকরাইলে (ইচ্ছে করেই নাম প্রকাশ করা হলো না) অবস্থিত একটি শীর্ষ প্রতিষ্ঠানের ৩২ কোটি টাকা উদ্বৃত্ত থাকার পরও শিক্ষার্থীদের টিউশন ফি শতভাগ বৃদ্ধি করে। একটি নারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বৃদ্ধি করে ৮৭ শতাংশ টিউশন ফি। ওই প্রতিষ্ঠানে উদ্বৃত্ত আছে কয়েকশ’ কোটি টাকা। অবৈধ কয়েকটি ক্যাম্পাসও রয়েছে ঢাকায়।

অভিভাবকদের আন্দোলনের মুখে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের একাধিক টিম শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে নামে তদন্তে। ২০১৭ সালের ১৯ জানুয়ারি প্রতিটি স্কুলে তদন্তে যায় ৬ সদস্যের টিম। জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে উপকমিটির সদস্যরা নগরীর ৯৮টি বিদ্যালয়ের বেতনসহ অতিরিক্ত ফি আদায়ের তথ্য সংগ্রহ করে। তদন্ত দল প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে ভর্তি ফি ছাড়াও উন্নয়ন ফি বাবদ শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত অর্থ আদায়ের প্রমাণ পায়। চট্টগ্রামের সার্সন রোডের একটি ইংরেজি মাধ্যমের বিদ্যালয় ৬৩ হাজার টাকা ভর্তি ফি ও ১৯ হাজার টাকা মাসিক বেতন আদায়ের তথ্য পায় তদন্ত দল। আরেকটি শীর্ষ স্কুলে শুধু প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণিতে ভর্তিতে ফি গ্রহণ করে ১০ হাজার তিনশ’ টাকা।

আরো একটি পেছনে যেতে চাই। অর্থাৎ ২০১৫ সালের শিক্ষা খাতে অব্যবস্থাপনার সমস্যার কিছু চিত্র স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি। ২০১৫ সালের এসএসসি পরীক্ষার ফরম পূরণের সময় আদায় করা অতিরিক্ত অর্থ ফেরত না দেয়ায় সারা দেশের এক হাজার ২০৯টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয়া হয়। ৩০ দিনের মধ্যে নোটিশের জবাবও দিতে বলা। তবে সেই জবাব দেয়নি অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান। শুধু তাই নয় এই প্রতিষ্ঠানের মধ্যে এমন অনেক প্রতিষ্ঠান রয়েছে, অতিরিক্ত অর্থ আদায় করা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে যাদের নাম এসেছে বারবার।

২০১৫ সালের এসএসসি পরীক্ষার ফরম পূরণে বিজ্ঞান বিভাগে ফি ছিল এক হাজার ৭৫০ টাকা এবং মানবিক ও ব্যবসায় শাখায় ছিল এক হাজার ৫৮০ টাকা। কিন্তু স্কুলগুলো আদায় করে এর চেয়ে কয়েকগুণ বেশি টাকা। শিক্ষাবোর্ডগুলোর তদন্তে সারা দেশের তিন হাজার ৩৮টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অতিরিক্ত অর্থ নেয় বলে প্রমাণ পাওয়া যায়। ওই বছর মন্ত্রণালয় দাবি করেছিল ৮৩০টি প্রতিষ্ঠান আদায় করা অতিরিক্ত অর্থ ফেরত দিয়েছে। যদিও এর সত্যতা খুব একটা পাওয়া যায়নি।

সারাদেশে প্রাক-প্রাথমিক থেকে স্নাতকোত্তর স্তর পর্যন্ত লেখাপড়া করছে ৪ কোটি ৯০ লাখ শিক্ষার্থী। এদের মধ্যে বেশিরভাগই লেখাপড়া করছে বেসরকারি স্কুল কলেজে। আর উচ্চ শিক্ষার ৯০ শতাংশ শিক্ষার্থী লেখাপড়া করে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে বিভিন্ন বেসরকারি কলেজে। শতভাগ বেসরকারি কলেজ, এমপিওভুক্ত ননএমপিও শিক্ষক, নন এমপিও অনার্স মাস্টার্স শিক্ষক, বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় এবং বিভিন্ন পর্যায়ের প্রায় ৮ লাখ শিক্ষক বেতন পাচ্ছেন না। প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ বলছেন, করোনা এমন সময়ে শিক্ষার্থীরা বেতন দিচ্ছে না বলে এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। এটা খুবই অমানবিক এবং দুঃখের ও কষ্টের। সরকারের উচিত হবে- দেশের প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের আয় ব্যয়ের নির্দিষ্ট হিসাব রাখা। ঢাকার শীর্ষ বেশ কয়েকটি কলেজের জমি আছে কক্সবাজারে। আছে হোটেল ব্যবসা। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের আড়ালে মানব সম্পদ পাচারের খবরও জানা আছে অনেকের। শিক্ষা মেলার নামে কোটি কোটি টাকা অর্থ মেরে দেয়ার নজিরও আছে এই দেশে।

বেসরকারি কলেজ আর স্কুল যারা প্রতিষ্ঠা করেছেন তাদের তরতর করে হয়েছে সম্পদের পাহাড়। শিক্ষা নিয়ে সেবা দেয়ার পরিবর্তে যখন বাণিজ্য শুরু হয়ে গেছে তখন সম্পদের পাহাড় আরো বড় হয়েছে। এ নিয়ে শিক্ষকরাও খুব একটা কথা বলতে চান না। কারণ শ্রেণীকক্ষের চেয়ে বাইরে পড়ানোর সুবিধা থাকায় প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শিক্ষকেরও কিছু সম্পদ হয়েছে। কিন্তু করোনাকালীন এমন পরিস্থিতির সুযোগে আলো বিলিয়ে যাওয়া সাধারণ শিক্ষকদের বঞ্চিত করছেন শিক্ষা উদ্যোক্তারা। যেটা কখনোই সুফল বয়ে আনবে না। তাই সরকারের উচিত হবে খুব দ্রুত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর আয় ব্যয়ের হিসাব নেয়া।

সংকটকালীন এই সময়ে ধনী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের জমানো অর্থ দিয়ে শিক্ষকদের বেতন পরিশোধের উদ্যোগ নিতে পারেন। এই সময় অভিভাবকদেরও চাপ দিয়ে অনেক প্রতিষ্ঠান বেতন আদায়ের উদ্যোগ নিয়েছে। কোনো কোনো স্কুল এবং কলেজ সফলও হয়েছে। এক্ষেত্রে সরকারের উচিত হবে বেসরকারি বিদ্যালয়ের বাড়ি ভাড়ার ওপর ১৫ শতাংশ ভ্যাট প্রত্যাহার করে তাদের কড়া ভাষায় বলে দেয়া-পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়ার আগে শিক্ষার্থী বেতন নেয়া বন্ধ রাখতে হবে।

বর্তমান সরকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণে যে কোনো সময়ের চেয়ে সফলতা অর্জন করেছে। বলা যেতে পারে, জাতীয়করণ করে এক অনন্য নজির স্থাপন করেছে বর্তমান সরকার। করোনার এমন সময়েও দুই হাজারের কিছু বেশি প্রতিষ্ঠানকে এমপিওভূক্ত করা হয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানে ২৫ হাজার শিক্ষকের মুখে হাসি ফুটেছে। তবে আরো প্রায় ৭শ’ প্রতিষ্ঠান রয়েছে যাদের শিক্ষকের সংখ্যা ৫ হাজারের কিছু বেশি-এমপিওভূক্ত না হওয়ায় তাদেরও আছে আক্ষেপ। খোঁজ নিয়ে জানতে পেরেছি, এমপিওভুক্তির জন্য যে অর্থ ছাড় করা হয়েছে তাতে ওই ৭শ’ প্রতিষ্ঠানকেও এমপিওভুক্ত করার সুযোগ আছে। মন্ত্রণালয়ের উচিত হবে এই সুযোগ কাজে লাগানো। কারণ এই শিক্ষকদেরও এখন বেতন নেই। এমন নানা সুযোগ সুবিধা দিয়ে শিক্ষকদের আলো দেয়ার কাজে সরকারকে নিয়োজিত রাখতে হবে দেশের প্রয়োজনেই। শিক্ষক বাঁচলে বাঁচবে শিক্ষার্থী। আর শিক্ষার্থীরাই নির্মাণ করবে সেই বাংলাদেশ, যে বাংলাদেশ চাই আমরা সবাই।


মোস্তফা মল্লিক: বিশেষ প্রতিনিধি, চ্যানেল আই এবং সভাপতি, বাংলাদেশ এডুকেশন রিপোর্টার্স ফোরাম।

এ সম্পর্কিত আরও খবর