সরকারের হিসেবেই এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে করোনায় আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা ৩৬ হাজার ৭৫১ জন। মৃতের সংখ্যা ৫২২। প্রতিদিনই এই সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। তবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রতিদিন দুপুর আড়াইটার এই ব্রিফিংও আমাদের গা সওয়া হয়ে গেছে যেন। আক্রান্ত আর মৃতের সংখ্যা আমাদের কাছে নিছক সংখ্যাই যেন। তবুও করোনায় কিছু মৃত্যু, কিছু আক্রান্তের খবর আমাদের চমকে দেয়। যখন শুনি এস আলম গ্রুপের মালিকদের একজন মোরশেদ আলম বা সাবেক সংসদ সদস্য আলহাজ্ব মকবুল হোসেন বা সানবিমস স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা নীলুফার মঞ্জুর করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন; যখন শুনি ড. আনিসুজ্জামানের মৃত্যুর কারণ করোনা ভাইরাস; তখন চমকে যাই, ভয় পেয়ে যাই, নিজেকে অসহায় লাগে। এত বড় বড় মানুষগুলোকে আমরা করোনার থাবা থেকে বাঁচাতে পারলাম না, সেখানে আমরা তো ভেসে যাবো। প্রতিদিনই পরিচিত কারো না কারো আক্রান্ত হওয়ার বিষণ্নতায় ঢেকে দেয় আমাদের দিনগুলো।
এই বিষণ্ন দিনগুলোকে বিষণ্নতর করে তুলেছে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর করোনা সংক্রমণের খবরটি। আমি ভয় পাচ্ছি, দুটি কারণে, প্রথম কথা হলো, তার বয়স প্রায় ৮০। দ্বিতীয়ত তিনি একজন কিডনি রোগী, সপ্তাহে তার একাধিক ডায়ালিসিস লাগে। আমরা সবাই জানি করোনায় প্রবীণ মানুষের ঝুঁকি বেশি, আর যাদের অন্য কোনো রোগ আছে, তাদের ঝুঁকিটা আরও বেশি। তবু মানুষটা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলে, আমি সাহস পাই। তিনি সাহসী ও লড়াকু। করোনা সংক্রমণের সাথে সাথে জাফরুল্লাহ চৌধুরী আইসোলেশনে চলে গেছেন। তার সাথে কথা বলেছেন, এমন মানুষেরা জানিয়েছেন, তিনি ভালো আছেন এবং তার আত্মবিশ্বাস এখনও অটুট। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র আবিষ্কৃত র্যাপিড টেস্টিং কিটের পরীক্ষায় তার করোনা পজিটিভি এসেছে। অনুরোধ করছি, তিনি যেন পিসিআর’এর মাধ্যমে আরেকবার করোনা টেস্ট করিয়ে নেন। বিষয়টা নিশ্চিত হওয়া জরুরি। কারণ ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীকে আমাদের আরও অনেকদিন দরকার।
সব মানুষের জীবনই মূল্যবান। তবে জাফরুল্লাহ চৌধুরীর জীবন একটু বেশি মূল্যবান। কারণ জাফরুল্লাহ চৌধুরী একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা, সাহসী দেশপ্রেমিক এবং উদ্যোগী মানুষ।
অনেক অনেক ভিন্নমত সত্বেও ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীকে আমার ভালো লাগে। মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সবসময় আমার সর্বোচ্চ শ্রদ্ধা আছে। কারণ আমরা চাইলে অনেক কিছু হতে পারবো, কখনো মুক্তিযোদ্ধা হতে পারবো না। তারা জীবনের মায়া না করে, যুদ্ধ করেছিলেন, বলেই আজ আমরা স্বাধীন দেশে বাস করতে পারছি। তাকে আমার অকপট মনে হয়। কঠিন কঠিন ন্যায্য কথাও বলে ফেলেন অবলীলায়, নির্ভয়ে। অনেক কাজের সমালোচনা করলেও তার দেশপ্রেম নিয়ে আমার বিন্দুমাত্র সংশয় নেই।
তিনি গভীরভাবে বাংলাদেশকে ভালোবাসেন। ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাশ করে বিলাতে মানে লন্ডনে গিয়েছিলেন এফআরসিএস পড়তে। পড়াও প্রায় শেষ। সামনে যখন চূড়ান্ত পরীক্ষা, তখনই শুরু হলো মুক্তিযুদ্ধ। পাকিস্তানি পাসপোর্ট ছিঁড়ে ফেলে ট্রাভেল ডকুমেন্ট নিয়ে জীবনের ঝুঁকি মাথায় করে যেভাবে লন্ডন থেকে দিল্লী পৌছেছেন, তা সিনেমার গল্পকেও হার মানায়। বিলাতি ডিগ্রি, নিশ্চিত ক্যারিয়ার সব পেছনে ফেলে আগরতলার মেলাঘরে প্রতিষ্ঠা করেন ফিল্ড হাসপাতাল, যে হাসপাতাল বাঁচিয়েছে অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধার জীবন। মুক্তিযুদ্ধ শেষে সেই ফিল্ড হাসপাতালটিই 'গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র' নামে প্রথমে কুমিল্লা ও পরে সাভারে স্থাপন করেন।
জাফরুল্লাহ চৌধুরী অকপট এবং সৎ। কিন্তু তবুও বর্তমান সরকার ছাড়া আর সব সরকারের সাথেই তার ঘনিষ্ঠতা ছিল। 'গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র' নামটি বঙ্গবন্ধুর দেয়া, আর গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের জমিও দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। দেশের দুই সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান এবং এইচ এম এরশাদের সাথেও তার ঘনিষ্ঠতা ছিল। মজাটা হলো, জিয়া-এরশাদের সাথে ঘনিষ্ঠতা থাকলেও তিনি কোনো সুবিধা নেননি।
দুই জেনারেলই তাকে মন্ত্রী বানাতে চেয়েছিল, তিনি প্রত্যাখ্যান করেছেন। তবে দুই সামরিক শাসকের বেশকিছু জনবান্ধব পদক্ষেপের পেছনে জাফরুল্লাহ চৌধুরী হাত আছে। তবে তার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কাজ হলো ঔষধ নীতি প্রণয়ন।
তার এই নীতি সহায়তা দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল দেশের ঔষধ শিল্পকে। জাফরুল্লাহর সেই নীতির কারণেই বাংলাদেশ আজ ঔষধ রপ্তানিকারক। অন্যদের কথা জানি না, ঔষধ প্রস্তুতকারকরা জাফরুল্লাহ বড় ভাস্কর্য বানিয়ে রাখতে পারেন। তিনি দেশি-বিদেশি অনেক পুরস্কার পেয়েছেন। একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে পুনর্গঠনে তার অবদান অনস্বীকার্য। আমি বিশ্বাস করি তিনি নোবেল পুরস্কারও পেতে পারতেন।
জাফরুল্লাহ চৌধুরী একের ভেতরে অনেক। তিনি একজন ডাক্তার। শুধু ডাক্তারি করলে তিনি হতে পারতেন দেশের সেরা ডাক্তারদের একজন। তিনি একজন উদ্যমী সংগঠক, যিনি দাঁড় করিয়েছেন গণস্বাস্থ্যের মত একটি প্রতিষ্ঠান। তার হাসপাতালে অল্প পয়সায় চিকিৎসা হয়। মাত্র দুই হাজার টাকায় ডায়ালিসিস হয়।
তিনি একজন একাডেমিশিয়ান, তার লেখা বই বিশ্বের অনেক দেশে এমবিবিএস শিক্ষার্থীদের পড়ানো হয়। তিনি একজন গবেষক, তার গবেষণাকর্ম ছাপা হয়েছে বিশ্বের অনেক নামী জার্নালে। অথচ জাফরুল্লাহ চৌধুরীকে কাছ থেকে দেখলে আপনি বিশ্বাসই করবেন না, এই সাদাসিধা, ভোলাভালা, আনস্মার্ট লোকটিরই এত গুণ।
কিন্তু এইসব গুনের বাইরে ইদানীং তিনি রাজনৈতিক অ্যাকটিভিস্ট। অন্য সুশীল বুদ্ধিজীবীদের মত তিনি দূরে থেকে বিবৃতি দিয়ে, কলাম লিখে, টক শো করেই দায়িত্ব শেষ করেননি। বরং রাজনীতির মাঠে দারুণ সক্রিয়। সরকারের কঠোর সমালোচক। আর এই সমালোচনার বেশিরভাগই যৌক্তিক। গত নির্বাচনের আগে সরকারের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের মূল কারিগর তিনি। কোনো দল না থাকলেও ঐক্যফ্রন্টের অন্যতম নীতি নির্ধারক ছিলেন ডাঃ জাফরুল্লাহ। সরকারের সমালোচনা করেন বলে বিএনপি তাকে আপন ভাবে। আবার মাঝে মাঝে কঠোর ভাষায় বিএনপিরও সমালোচনা করেন। তখন বিএনপির লোকজনই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যান, তিনি আসলে কোন পক্ষ। কথা শুনে মনে হয়েছে, তিনি আসলে কোনো দলের নয়, দেশের স্বার্থে কথা বলছেন, গণতন্ত্রের স্বার্থে ভূমিকা রাখছেন। তার অনেক অবস্থান বা বক্তব্যে ভিন্নমত থাকলেও তার চাঁছাছোলা স্টাইলটা বেশ ভালো লাগে। অনেকে বলছেন, তিনি রাজনীতিতে জড়িয়ে নিজেকে বিতর্কিত করেছেন। আমার কাছে কিন্তু রাজনীতির প্রতি আগ্রহের কারণেই তাকে বেশি ভালো লাগে। বিতর্কিত হওয়ার ভয়ে যদি আমরা সবাই রাজনীতি থেকে দূরে খাকিম তাহলে দেশটা চালাবে কারা। বরং জাফরুল্লাহ চৌধুরীদের মত লোকদের আরো বেশি করে রাজনীতি নিয়ে ভাবা দরকার। রাজনীতিবিদদের ভুলগুলো ধরিয়ে দেয়া দরকার।
বলছিলাম জাফরুল্লাহ চৌধুরীর উদ্যমের কথা। জীবনী পড়লে আপনি জানবেন যে তাঁর বয়স ৭৯। কিন্তু তাঁর প্রতিদিনকার কাজকর্মের ধরণের সাথে আপনিও পাল্লা দিয়ে পারবেন না। দেশপ্রেমিক অনেক আছেন, কিন্তু দেশপ্রেমের সাথে উদ্যম আর উদ্যোগটা জরুরি। তাহলে সেই প্রেমটা দেশের কাজে লাগে। জাফরুল্লাহ চৌধুরী তেমন প্রেমিক। তার উদ্যম আছে, উদ্যোগ আছে। এই যেমন এই করোনাকালে যখন অধিকাংশ রাজনীতিবিদ এবং বুদ্ধিজীবী গভীর কোয়ারেন্টিনে চলে গেছেন, তখন জাফরুল্লাহ চৌধুরী ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছিলেন করোনার টেস্টিং কিটের উদ্ভাবন নিয়ে। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের র্যাপিড টেস্টিং কিটটি কার্যকর কিনা সেটা এখনও পরীক্ষিত নয়, বিএসএমএমইউতে তার পরীক্ষা চলছে। কিন্তু জাফরুল্লাহ চৌধুরীর চেষ্টাটা তো দেশের জন্যই ছিল। সেই চেষ্টা করার লোকেরই তো বড় অভাব।
ডাঃ জাফরুল্লাহ চৌধুরীর দ্রুত আরোগ্য কামনা করে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেয়ার পর কেউ কেউ বলেছেন, আপনি না দুদিন আগে তার বিরোধিতা করলেন, আজ আবার তার আরোগ্য কামনা করেছেন। আমি অবাক হয়ে গেছি, কারো বিরোধিতা করলেই যেন তার সুস্থতা চাওয়া যাবে না।
এটা ঠিক গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র আবিষ্কৃত র্যাপিড টেস্টিং কিট নিয়ে তোলপাড়ের সময় আমি একাধিক লেখা লিখেছি। তাতে প্রক্রিয়া নিয়ে বিরোধিতা থাকলেও ব্যক্তি জাফরুল্লাহ চৌধুরীর প্রতি কোনো বিদ্বেষ ছিল না। আমি এখনও বিশ্বাস করি, সরকারকে বিপাকে ফেলতে ডাঃ জাফরুল্লাহ চৌধুরী টেস্টিং কিট নিয়ে সরকারের কাছে যাওয়ার আগেই মিডিয়ার কাছে চলে এসেছিলেন।
সরকারের অনীহার কারণেই টেস্টিং কিটটি বাজারে আনা যাচ্ছে না, কৌশলে তিনি এমন একটা পারসেপশন ছড়িয়ে দিতে পেরেছেন। আমি এর সমালোচনা করেছি। কিন্তু এও বলেছি, তার জায়গায় থাকলে আমিও তাই করতাম। এটা স্রেফ সুযোগের সদ্ব্যবহার।
জাফরুল্লাহ চৌধুরী যেহেতেু সরকার বিরোধী জোটের সংগঠন। তাই সরকারকে বিপাকে ফেলার কোনো সুযোগ তিনি কেন হাতছাড়া করবেন। আর এমন স্মার্টলি তিনি চালটা দিয়েছেন, যার কোনো জবাব সরকারের কাছে ছিল না বা থাকলেও বিশ্বাসযোগ্যভাবে তা উপস্থাপন করতে পারেনি। অথচ গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র যাওয়ার সাথে সাথে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর তাদের কিট যাচাই করার অনুমতি দিয়েছে। অধিদপ্তর চেয়েছিল যাচাইটি আইসডিডিআর’বি-তে করতে। কিন্তু গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র চেয়েছে বিএসএমএমইউতে করতে। বিএসএমএমইউ কিন্তু সরকারের সিআরও’র তালিকায় ছিল না।
তারপরও গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের চাওয়া অনুযায়ী বিএসএমএমইউতেই যাচাইয়ের কাজ চলছে। বিষয়টি এখন আর সরকারের হাতে নেই। টেস্টিং কিট নিয়ে অনেক রাজনীতি হয়েছে। এখন বিষয়টির বিজ্ঞানভিত্তিক যাচাই চলছে। বিএসএমএমইউউর রিপোর্ট পাওয়ার পর আবার সরকারের কাছে আসবে বিষয়টি। তখন ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর কত দ্রুত সে সিদ্ধান্ত কার্যকর করবে, সেটা হলো বিবেচ্য।
বিএসএমএমইউ কী রিপোর্ট দেবে, সেটা তো আমরা কেউ জানি না। আমি চাই ইতিবাচক সিদ্ধান্ত আসুক। কারণ ১৮ কোটি মানুষের দেশে পিপিসআর টেস্টের ওপর ভরসা করে করোনা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। কারো না কারো একটা র্যাপিড টেস্টিং কিটই পারে করোনা টেস্ট নিয়ে আমাদের সীমাবদ্ধতা দূর করতে। সে ক্ষেত্রে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রই সবচে বিশ্বাসযোগ্য। কারণ এই কিটের আবিষ্কারক ড. বিজন কুমার শীলের এ ধরনের কাজের আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা আছে। তবে নেতিবাচক রিপোর্টও কিন্তু আসতে পারে। তারপরও মানুষের স্বাস্থ্যের সাথে সম্পর্কিত কোনো কিছু যাচাই ছাড়া বাজারে আনার কোনো সুযোগ নেই বলেই আমি বিশ্বাস করি। টেস্টিং কিট নিয়ে ঘোড়ার আগে গাড়ি জুড়ে দেয়া কৌশলের সমালোচনা করলেও ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর সারাজীবনের অবদানের, চেষ্টার, উদ্যমের, উদ্যোগের, দেশপ্রেমের গুণমুগ্ধ ভক্ত আমি। ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী একজন ফাইটার। অন্য সবার মত সহজ যুদ্ধ নয়, সবসময় তিনি স্রোতের বিপরীতে সাঁতার কেটে জয়ী হওয়া মানুষ। আমি নিশ্চিত জানি, ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী করোনার সাথে লড়াইয়েও জিতবেন। চারপাশে ভীতু মানুষ দেখতে দেখতে ক্লান্ত। জাফরুল্লাহ চৌধুরীর মত সাহসী মানুষ দেখেলে মনে জোর পাই। তাই চাই তিনি দ্রুত সুস্থ হয়ে ফিরে আসুন।
প্রভাষ আমিন, হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ।