আমাদের বাংলাদেশিদের মধ্যে সবসময় এই বিশ্বাস এবং আবেগ কাজ করে যে, করোনাভাইরাস আমাদের খুব বেশি আক্রান্ত করতে পারবে না, আমাদের খুব বেশি মানুষ আক্রান্ত হয়ে মারাও যাবে না এবং খুবই নিকট অতীতে আমরা করোনার ভয়াল থাবা থেকে মুক্ত হব। কিন্তু তাদের এই বিশ্বাস এবং আবেগের যুক্তিসঙ্গত কারণ কি সেটা তারা জানে না। কিন্তু সাধারণের এই না জানার মধ্যেও এক সহজ এবং বৈজ্ঞানিক যুক্তি আছে তো বটেই। যা জানা থাকলে সত্যিই করোনাকে পরাভূত করা অকুতোভয় এই জাতির জন্য সময়ের ব্যাপার মাত্র।
আক্রান্তদের দিকে নজর দিলে দেখা যায় এই বিশাল জনগোষ্ঠীর যারা চাষাবাদ করেন তারা, গার্মেন্টস কর্মী, রিকশাচালক, বিভিন্ন ধরনের শ্রমিক এবং অন্যান্য পেশায় নিয়োজিত। যারা আউটডোরে বেশি কাজ করেন অথবা সেলস মার্কেটিং এর সাথে জড়িত তারা খুব একটা আক্রান্ত হয়নি বলেই প্রমাণ পাওয়া যায়। যারা আক্রান্ত হয়েছেন, তারা বেশিরভাগই ঢাকা এবং নারায়ণগঞ্জ বসবাস করেন।
আমরা যেটা আলোচনা করব তা হলো, এই ছোট আয়তনের বিশাল জনগোষ্ঠীর দেশে লকডাউন, সামাজিক দূরত্ব কোনোকিছুই না মেনে, গাদাগাদি করে কয়েকবার লাখ লাখ মানুষ গ্রামের বাড়িতে গেলাম এলাম, শপিং করলাম, চুটিয়ে আড্ডা দিলাম পাড়ার দোকানে, বাজার করলাম শত মানুষের ভিড় ঠেলে তবুও আশঙ্কা বিশেষজ্ঞদের ভবিষ্যৎবাণীর চাইতে অনেকগুণ কম আক্রান্ত হলাম, তা কোনো প্রকারেই 'ফ্লুক' নয়। এই কম আক্রান্ত হওয়া এবং মৃত্যুহার কম হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। এটা শুধু আবেগ আর বিশ্বাস নয়। বিশেষজ্ঞ এবং বিজ্ঞানীরা মনে করছেন করোনাকে প্রতিরোধ করা এবং এর সংক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে হলে আমাদের ইমিউন সিস্টেমকে শক্তিশালী করতে হবে। ভালো শক্তিশালী ইমিউনিটির মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি। এজন্য তারা পরামর্শ দিয়েছেন, বেশি করে শাক সবজি এবং ফলমূল খেতে, প্রতিদিন শারীরিক পরিশ্রম বা ব্যায়াম করতে এবং বেশি করে ভিটামিন ডি গ্রহণ করতে।
ইমিউনিটি হলো শরীরের মধ্যে একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন এবং সংবেদনশীল প্রতিরক্ষা পদ্ধতি যা ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস এবং অন্যান্য জীবাণুকে শনাক্ত এবং ধ্বংস করে আর এই কাজটি রক্তের শ্বেত কণিকা (WBC) এর মাধ্যমে করে থাকে। এই শ্বেত কণিকার কাজ এবং সংখ্যা বদলাতে পারে ভিটামিন 'ডি', যা কিনা ক্ষতিকর ভাইরাসকে ধ্বংস করে দিতে পারে।
ভিটামিন 'ডি'র প্রধান উৎস সূর্যের রোদ। ৮০% ভিটামিন ডি রোদের অতিবেগুনি রশ্মির মাধ্যমে পাওয়া যায়। সহজভাবে তার মানে দাঁড়াল, যখন করোনাভাইরাসটি মানবদেহে যেকোনো উপায়ে প্রবেশ করে তখন যেকোনো একটি শ্বেত কণিকা তাকে দ্রুত শনাক্ত করে ফেলে এবং অন্যান্য শ্বেত কণিকাদের খবর পাঠায়, তারা একযোগে করোনাকে ঘিরে ফেলে। অন্যান্য শ্বেত কণিকাদের সবাই করোনার সাথে শক্তিতে না পারলেও ভিটামিন ' ডি' যে শ্বেত কণিকাকে রেগুলেটর করে সেইটা করোনাকে পরাস্ত করে ফেলে এবং তাতে আক্রান্ত ব্যক্তি দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠে।
করোনা মোকাবেলায় ভিটামিন 'ডি' কীভাবে কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারে সে সম্পর্কে গবেষক ও বিশেষজ্ঞরা তাদের গুরুত্বপূর্ণ মতামত দেন। বস্টন ইউনিভার্সিটির একজন ভিটামিন ডি গবেষণা বিশেষজ্ঞ বলেন, সংক্রামক জীবাণু, ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়া শনাক্ত করে ধ্বংস করে এমন এক প্রোটিনের নিয়ন্ত্রণ থাকে ভিটামিন ডি এর ওপর। ব্রিটেনের কেম্ব্রিজ এর আংলিয়া রাস্কিন বিশ্ববিদ্যালয়ের ডা. লি স্মিথ এবং কুইন এলিজাবেথ হাসপাতালের ডা. পিটার ক্রিস্টিয়ান ইলি 'এজিং ক্লিনিক্যাল অ্যান্ড এক্সপেরিমেন্টাল রিসার্চ জার্নাল' এ একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন। সেখানে একটি পর্যবেক্ষণে বলা হয়, ইতালি এবং স্পেনের লোকজন উত্তর ইউরোপীয় দেশগুলোর তুলনায় কড়ারোদ এড়িয়ে চলে, সানস্ক্রিন ব্যবহার। সেজন্য তাদের করোনা সংক্রমণ বেশি।
লি আরও বলেন, আমরা ইউরোপের ২০টি দেশে পরিসংখ্যান চালিয়ে দেখেছি, যারা করোনায় মারা যাচ্ছে তাদের শরীরে ভিটামিন 'ডি' কম।
এই পরিস্থিতিতে 'হার্ড ইমিউনিটি' নিয়ে ঢের আলোচনা হয়েছে। এটাকে ইমিউনিটি অব কমিউনিটিও বলা হয়। ভ্যাকসিন দিয়ে অথবা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে একটি প্রতিরক্ষা বলয় তৈরি করে রোগ সংক্রমণের চেইন ধ্বংস করে একটা নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠী'কে সংক্রমণমুক্ত করা হয়। এর জন্য ৭০% থেকে ৮০% জনগোষ্ঠী সংক্রমিত হওয়ার দরকার পড়ে। আসলে আমরা অজান্তে 'হার্ড ইমিউনিটি' প্রসেস এর মধ্যে আছি মনে হয়।
বিজ্ঞানী ড. বিজন শীল বলেছেন, আমাদের দেশের ৩০-৪০ পার্সেন্ট মানুষ করোনাতে সংক্রমিত হয়েছি। আমরা অনেকেই আক্রান্ত হয়েছি কিন্তু টের পাইনি, আমাদের ইমিউন সিস্টেম শক্তিশালী হবার জন্য অটোমেটিক্যালি ভালো হয়ে গেছি।
আসলে, আমরা একটা অদৃশ্য করোনা সংক্রমণ 'ওয়েভ' অজান্তেই এক্সপেরিয়েন্স করেছি, টের পাইনি। সারাদেশের অসংখ্য মানুষ সংক্রমিত হয়েছে, কিন্তু আবার সুস্থও হয়ে গেছে।
আমাদের ৯০% এর বেশি মানুষ চাষাবাদের সাথে জড়িতে। গ্রামে অথবা মফস্বলের যারা যে কাজের সাথেই জড়িত আছেন, তারা দীর্ঘদিন যাবত রোদের সংস্পর্শে আছেন। তারা বছরের পর বছর রোদ থেকে ভিটামিন 'ডি' গ্রহণ করেছেন এবং করছেন। তারা নিয়মিত শারীরিক পরিশ্রম করেন ফলে তাদের শরীরে খুব একটা চর্বি জমে না এবং তারা স্থূলকায়ও নন।
মোটকথা, তারা শক্তিশালী ইমিউনিটির অধিকারী। একথা শহরের রিকশাচালক, বিভিন্ন প্রকার শ্রমিক, ছোট ব্যবসায়ী, কাজের বুয়া এবং বাইরে কাজ করেন এমন অনেক পেশাজীবীদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। তারা বছরের পর বছর রোদ থেকে ভিটামিন 'ডি' নিয়েছেন। গার্মেন্টস শ্রমিকদের ক্ষেত্রেও একথা প্রযোজ্য, কারণ তারা দীর্ঘদিন গ্রামে বাস করে এসেছে। ৫০-৬০ বছরের পর শরীরে ভিটামিন 'ডি' কমতে থাকে, শরীরেও নানা রকমের রোগ বাড়তে থাকে।
এরপর আমরা কনফার্ম কেসগুলোর দিকে নজর দেব। একটা মৃত্যুও কাম্য নয়, তবু যারা করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন এবং যারা পজিটিভ হয়ে চিকিৎসাধীন আছেন, তারা মূলত: একটা লম্বা সময় ধরে ভিটামিন 'ডি' নি:সরণ হয় এমন রোদের সংস্পর্শে আসেননি দীর্ঘদিন।
আমরা যারা দীর্ঘদিন ঢাকায় বসবাস করছি, চাকরি অথবা ব্যবসায়িক কাজে ব্যস্ত থাকার জন্য ভালোমতো রোদ থেকে ভিটামিন 'ডি' গ্রহণ করতে পারিনি এবং শারীরিক শ্রম হয় এমন কোনো কাজ করিনি, কেউবা স্থূলকায় হয়ে গেছি, কেউবা হৃদরোগ, কিডনি সমস্যা, শ্বাসপ্রশ্বাসজনীত রোগ কিংবা অন্য কোনো জটিল রোগে ভুগছি তারা যদি সংক্রমিত হই তবে ভীষণ বিপদ অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য। সাবধানে থাকতে হবে। করোনা আক্রান্তদের ক্ষেত্রে বয়সও একটা ফ্যাক্টর। এই সংখ্যাগুলো বাদ দিলে সামগ্রিকভাবে ইমিউনিটির দিক থেকে ভালো অবস্থানে আছি।
কাজেই, পৃথিবীর অন্যান্য দেশ যারা করোনা মহামারির স্বীকার হয়েছে তাদের থেকে আমরা ভিটামিন 'ডি' গ্রহণে অনেক এগিয়ে আছি এবং আমরা অধিকতর আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থেকে একটু ভালো অবস্থানে আছি। চিকিৎসা ব্যবস্থায় অপ্রতুল সুবিধা নিয়ে আমাদের ডাক্তার, নার্স চিকিৎসাকর্মীরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে যাচ্ছেন। তাদের ওপর যাতে আরও চাপ না বাড়ে সেজন্য আমাদের আরো সচেতন হয়ে চলতে হবে।
গতকাল থেকে আমাদের অফিস, আদালত, ব্যাংক, শিল্প প্রতিষ্ঠান, গণপরিবহন, দোকানপাট, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সবই খুলে দেওয়া হয়েছে। অর্থনীতিকে সচল রাখতে এটা করা হয়েছে। কাজেই, এই পরিস্থিতির সাথে মানিয়ে নিয়ে করোনার সাথে এডজাস্ট করেই আমাদের চলতে হবে।
আমরা সবাই সচেতন, সচেতনভাবে আমরা যদি সবাই দায়িত্ববান হয়ে নিজেদের কর্মপন্থা ঠিক করে নেই তবে খুব শীগগির করোনাকে জয় করতে পারবো। সেগুলোর সবই আমরা মোটামুটি সবাই জানি। তাই, ওই আলোচনায় না যেয়ে পরিশেষে আলোকপাত করতে চাই, আমরা আরো সংক্রমিত হওয়ার হাত থেকে নিজেদের রক্ষা করব এবং কতগুলো বিষয় কঠিনভাবে মাথায় রাখবো। আমরা কঠোরভাবে সামাজিক দূরত্ব মেনে চলব, মাস্ক ব্যবহার করব, ঘনঘন হাত ধুবো। আমরা আমাদের ইমিউনিটি ডেভেলপ করব। সেজন্য আমরা ফলমূল এবং শাকসবজি খাবো, ভিটামিন সি গ্রহণ করবো, ব্যায়াম করবো বা শারীরিক শ্রম হয় এমন কাজ করব। রোদ থেকে ভিটামিন 'ডি' নেওয়ার জন্য সপ্তাহে অন্তত চারদিন সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৩ টার মধ্যে ১০-১৫ মিনিটের জন্য রোদ পোহাবো। আমরা আত্মবিশ্বাস ধরে রাখবো, হতাশ হব না। আত্মবিশ্বাস ইমিউনকে শক্তিশালী করে।
আমাদের আছে যুক্তিসঙ্গত আবেগ এবং বিশ্বাস। আমরা করোনাকে সহজেই পরাভূত করতে সক্ষম হব। আমাদের আছে সেই আত্মবিশ্বাস।
লুৎফর রহমান মাসুদ: আইনজীবী, ঢাকা জজ কোর্ট