ক্ষুদ্র এক অণুজীবের কাছে পৃথিবীর মানুষ আত্মসমর্পণ করেছে। কোভিড-১৯ নামের প্রাণঘাতী ভাইরাসটি আমাদের দেশে শুধু মানুষের প্রাণই কেড়ে নিচ্ছে না, খেটে খাওয়া মানুষের পকেটও কাটতে শুরু করেছে।
আর পকেট কাটার আয়োজনটা করে দিয়েছে সরকারই। রাষ্ট্রের জনগণকে কোথায় একটু সুরক্ষা দেবে, সুযোগ সুবিধা দেবে, ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য রাস্তা বাতলে দেবে, অর্থনীতির চাকা সচল করতে সাধারণ জনগণের পাশে দাঁড়াবে, তা না করে উল্টো কীভাবে সাধারণের পকেট থেকে টাকা নিয়ে বরাবর সুবিধাভোগী গোষ্ঠীর পকেট ভারি করা যায়, সেই পথেই হাঁটছে আামাদের রাষ্ট্র ব্যবস্থা, আমাদের সরকার।
এরই মধ্যে লকডাউন তুলে দিয়েছে, পৃথিবীর এ রকম কোনো দেশই গণপরিবহনের ভাড়া যেখানে এক পয়সাও বাড়ায়নি, সেখানে আমাদের দেশের চিত্র ঠিক তার উল্টো। পরিবহন ব্যবসায়ীরা সরকারকে জিম্মি করে লকাডাউন শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই গণপরিবহনের ভাড়া ৬০ শতাংশ বাড়িয়ে নিয়েছে। অথচ বৈশ্বিক মহামারির কারণে বৈরি পরিস্থিতিতে পৃথিবী জুড়ে জ্বালানি তেলের দামও ব্যারল প্রতি ২০ ডলারের নিচে নেমে এসেছে।
টানা ৬৬ দিনের সাধারণ ছুটির পর গত ৩১ মে থেকে সব কিছু খুলতে শুরু করেছে। সরকারি অফিস আদালত থেকে শুরু করে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, গণপরিবহন সব কিছু। তবে গণপরিবহন চালুর ক্ষেত্রে একদিন পেছাতে হয়েছে। অর্থাৎ ১ জুন থেকে সারাদেশে সীমিত পরিসরে গণপরিবহন চলতে শুরু করেছে। কিন্তু একদিন পেছানোর হেতু কী? হেতু হচ্ছে গণপরিবহনের ভাড়া পুনঃনির্ধারণ করা!
সরকারের একটা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)। যাদের কাজ হচ্ছে গণপরিবহনের সমস্যা, সংকট দূর করা। বিশেষ করে সময়ে সময়ে গণপরিবহনের ভাড়া পুনঃনির্ধারণ করা। শব্দটি পুনঃনির্ধারণ না বলে সময়ে সময়ে ভাড়া ‘বৃদ্ধি’ বলাই ভালো। তারা এ কাজটি করেন পরিবহন মালিকদের ইচ্ছা ও মর্জি অনুযায়ী। জ্বালানি তেলের দাম, গ্যাসের দাম বৃদ্ধিসহ নানা কারণে গণপরিবহনের ভাড়া বাড়ে। কতভাগ ভাড়া বাড়বে, সেটা অনেকটা আগে থেকেই নির্ধারণ হয়ে থাকে। মালিক পক্ষ একটা দাবি তোলে। সেই দাবি নিয়ে পরিবহন মালিক ও বিআরটিএ এর মধ্যে লোক দেখানো দরকষাকষি হয়। আলোচনা হয়। সেখানে একটি সিদ্ধান্ত হয় এবং সম্মতির জন্য পাঠিয়ে দেয়া হয় সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ে। মন্ত্রণালয় একটু এদিক-সেদিক করে উভয় পক্ষের নেয়া সিদ্ধান্তটাকে কিছুটা পরিবর্তন করে একটা প্রজ্ঞাপন জারি করে দেয়। এতে মালিকপক্ষ ভীষণভাবে খুশি হয়। কারণ তারা যে পরিমাণ ভাড়া বাড়াতে চেয়েছিলেন, সেই পরিমাণ ভাড়া বৃদ্ধি করেই মন্ত্রণালয় থেকে প্রজ্ঞাপন জারি হয়। এ নিয়ে কিছুদিন দেন দরবার চলে। গণপরিবহনের চালক ও শ্রমিকদের সঙ্গে যাত্রীদের বাকবিতণ্ডা হয়, কখনও হাতাহাতির ঘটনাও ঘটে।
কিন্তু এবার এমন কী ঘটল যে গণপরিবহনের ভাড়া একেবারে শতকরা ৬০ ভাগ বাড়িয়ে দিতে হবে? ৩১ মে থেকে গণপরিবহন চলার সিদ্ধান্ত জানিয়ে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ২৯ মে বলেন, তার আগে বিআরটিএ ও পরিবহন মালিক, শ্রমিক ও ফেডারেশন নেতারা বসে ভাড়া নির্ধারণ করবেন। ৩০ মে বিআরটিএ এবং মালিক, শ্রমিক ও ফেডারেশন নেতাদের মধ্যে বৈঠক শেষে বিআরটিএ চেয়ারম্যান মো. ইউছুব আলী মোল্লা জানান, তারা ৮০ শতাংশ বাড়া বাড়ানোর সুপারিশ করেছেন। এখন মন্ত্রণালয় সিদ্ধান্ত দেবে। এর কারণ হিসেবে তিনি যুক্তি দেখিয়েছেন, করোনার কারণে গাড়িগুলোকে অর্ধেক যাত্রী নিয়ে যাতায়াত করতে হবে। সেই ক্ষতি পুষিয়ে দিতে তারা ৮০ শতাংশ ভাড়া বাড়ানোর এ সুপারিশ করেছেন। যদিও মালিক পক্ষ দাবি জানিয়েছিল ভাড়া শতভাগ বৃদ্ধি করার জন্য।
মন্ত্রণালয় বিআরটিএ এর সুপারিশ হাতে পাওয়ার পর ৩০ মে বিকেলেই প্রজ্ঞাপন জারি করে। তারা বিআরটিএ কর্তৃপক্ষের মতো এতোটা অবিবেচক না হয়ে আমজনতার কথা চিন্তা (!) করে ৬০ শতাংশ ভাড়া বাড়িয়ে প্রজ্ঞাপনটি জারি করে। এ সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে এটা সহজেই অনুমান করা যায় যে ভেতরে ভেতরে এ রকম একটা সিদ্ধান্ত আগে থেকেই নিয়ে রাখা হয়েছিল।
সরকারের এ সিদ্ধান্তের ফলে সরাসরি পরিবহন মালিকরাই লাভবান হয়েছেন। এ নিদারুণ দুঃসময়ে দেশের সাধারণ জনগণের কোনো উপকার হয়নি। গত দুই মাসের বেশি সময় ধরে চলা লকডাউনের কারণে কর্মহীন হয়ে পড়া মানুষ এখন দিন পার করছেন প্রচণ্ড আর্থিক সংকটে। অনেকেই জমানো টাকা ভেঙ্গে সংসার চালাচ্ছেন। ঠিক সেই সময়েই ‘মরার ওপর খাড়ার ঘা’র মত সম্পূর্ণ অযৌক্তিকভাবে গণপরিবহনের ভাড়া ৬০ ভাগ বৃদ্ধি করে জনগণের ওপর চাপিয়ে দেয়া হলো। যারা ভাড়া বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত দেন বা দিলেন, তারা কিন্তু গণপরিবহনে চড়েন না। বিলাসবহুল গাড়ি ব্যবহার করেন। মাস শেষে লম্বা মাইনে পান। সরকারি অন্যান্য সুযোগ সুবিধাও পান। জনগণের ট্যাক্সের টাকায় জীবনযাপন করেন। তাই জনগণের সুবিধা-অসুবিধার কথা ভাববার এতো সময় তাদের নাই। বরং তারা বরাবর সুবিধাভোগী পরিবহন মালিকদের স্বার্থের কথা ভাবেন, তাদের সুযোগ-সুবিধার কথা ভাবেন। এ দুর্দিনে সাধারণ মানুষ যখন আর্থিক সংকটে ছটফট করছে, ঠিক সেই সময়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন জনবান্ধব একটি সরকারের কাছ থেকে এমন বোঝা জনগণের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া কোনোভাবেই সঠিক হয়নি।
সরকার বলছে, করোনাকালের জন্য এমন ভাড়া বাড়ানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। করোনাকাল কেটে গেলে ভাড়া আবার কমিয়ে আগের জায়গায় নিয়ে আসা হবে। কিন্তু এ কথাটা কোনো বেকুবই বিশ্বাস করে না। কারণ আমাদের দেশে কোনো জিনিষের দাম একবার বাড়লে সেটি আর কখনও কমে না। এর নজিরও নাই। আর পরিবহন ভাড়ার ক্ষেত্রে তো নেই-ই। তাছাড়া যে উদ্দেশে, অর্থাৎ স্বাস্থ্যবিধি মেনে অর্ধেক আসন খালি রেখে পরিবহন চালানোর যে নির্দেশনা সরকারের পক্ষ থেকে দেয়া হচ্ছে, সেটিও যথাযথভাবে অনুসরণ করার সম্ভাবনা খুবই কম। কয়েকদিন গত হলেই এটা পরিষ্কার হয়ে যাবে।
লেখক: সাংবাদিক ও প্রাবন্ধিক।