কালো মানুষ জর্জ ফ্লয়েডকে পুলিশ হত্যা করার পর আমেরিকার বর্ণবাদী চেহারা আরেকবার উন্মোচিত হলো। কয়েক শতাব্দী পরেও বর্ণবাদী নির্যাতনের রক্তমাখা আমেরিকা বদলায়নি।
প্রতিবছর ১২ অক্টোবর যে আমেরিকানরা সাড়ম্বরে 'কলম্বাস দিবস' পালন করেন, সেদিনই বর্ণবাদের প্রথম পেরেক ঠোকা হয় মহাদেশটির মাটিতে। ১৪৯২ সালের প্রথম অভিযাত্রী হিসেবে কলম্বাস এসে তছনছ করেন স্থানীয় মানুষদের সাজানো জীবন। তারপর একে একে স্পেনীয়, ইংরেজ, ফরাসি, পর্তুগিজ দখলদার কবলিত হয় আটলান্টিকের ওপাশের উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা।
স্বর্ণের সন্ধানে ধ্বংস করা হয় মহাদেশের অতি সমৃদ্ধ ইনকা, মায়া, অ্যাজটেক সভ্যতা। রেড ইন্ডিয়ানসহ অপরাপর আদিবাসীদের নির্বিচারে হত্যা করা হয়। তাদের শৃঙ্খলাবদ্ধ করে দাস হিসেবে বিক্রি করা হয় ইউরোপের বাজারে বাজারে।
গবেষকরা নায়ক ও অভিযাত্রী কলম্বাসকে এখন চিহ্নিত করছেন খলনায়ক ও ভিলেন রূপে। আর আমেরিকার ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে গণহত্যা, লুণ্ঠন, শোষণ ও নির্যাতনকে উন্মোচিত করছেন।
কলম্বাসের রক্তমাখা ঐতিহ্যে আমেরিকায় বহু বছর দাস ব্যবসা ও বর্ণবাদ চলেছে। এসবের বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে জীবন দিতে হয়েছে আব্রাহাম লিংকনকে। গণতন্ত্র, ব্যক্তি স্বাধীনতা ও মানবাধিকারের যে আমেরিকা, তার অন্তরালে এখনো গুমরে কাঁদে রক্তাক্ত আদিবাসী ও কালো মানুষদের নিগৃহীত ইতিকথা।
কারণ, আমেরিকা থেকে দাসদের নিয়ে শুধু বিক্রি করাই হয়নি, আফ্রিকা থেকে শৃঙ্খলযুক্ত দাসদের ধরে এনে কঠোর পরিশ্রম করানো হয়েছে। অ্যালেক্স হ্যালির বিশ্ব বিখ্যাত আখ্যান 'দ্য রুটস' সে প্রমাণবহ।
ফলে গণতন্ত্র, ব্যক্তি স্বাধীনতা ও মানবাধিকারের আমেরিকার নেপথ্যে বর্ণবাদী অতীত এক ঐতিহাসিক সত্য, যা সুযোগ পেলেই মাথাচাড়া দেয়। সুসভ্যতার মুখোশ খুলে বের হয়ে আসে আদিম, বন্য, হিংস্র, নির্যাতকের মূল চেহারায়।
জর্জ ফ্লয়েডকে হত্যা করে সেই বর্বর অতীতকেই মনে করিয়ে দেওয়া হলো। এক্ষেত্রে অনুঘটকের কাজ করেছে ক্ষমতাসীন পুলিশ ও প্রশাশন। ডোনাল্ড ট্রাম্পের নেতৃত্বে ক্ষমতাসীন প্রশাসন যেন মরিয়া হয়ে সভ্য আমেরিকাকে সরিয়ে বর্বর আমেরিকার লুপ্ত ইতিহাসকে পুনঃপ্রতিষ্ঠায় পাগলপারা।
ডোনাল্ড ট্রাম্পের ক্ষমতা দখলের পর থেকেই উগ্রতা, বর্ণবিদ্বেষ, জাত্যাভিমান আমেরিকার সকল নান্দনিক অর্জনকে খুবলে খাচ্ছে। অভিবাসীদের এই দেশকে মনে করা হচ্ছে কেবল শ্বেতকায় সাদাদের। কালো, বাদামি, পিঙ্গল মানুষদের শনাক্ত করা হচ্ছে 'আলাদা' হিসেবে।
এই বর্ণবাদী মেরুকরণের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কুপ্রভাব একাধিকবার দেখা গেছে। উগ্রতা, হিংসা, সন্ত্রাস বেড়েছে। জাতিগত ঘৃণা প্রকট হয়েছে এবং সর্বশেষে জর্জ ফ্লয়েডকে প্রকাশ্য দিবালোকে রাজপথে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে।
যে আমেরিকাকে বিশ্বব্যাপী যুদ্ধ, দাঙ্গা, হাঙ্গামা, সন্ত্রাস, অস্ত্র ও বোমাবাজির জন্য সমালোচকরা সন্ত্রাসী রাষ্ট্র বলে, সে আমেরিকা নিজের দেশে সাধারণ নাগরিকদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাস ও জুলুমকারী। আমেরিকার মুখভরা গণতন্ত্র, ব্যক্তি স্বাধীনতা ও মানবাধিকারের বুলি যে আসলে কতো ঠুনকো ও প্রহসন মূলক, তা প্রমাণিত হয় এইসব বর্বরোচিত সন্ত্রাসী ঘটনায়।
তবে, আশার কথা হলো, ভালো ও মন্দের চিরায়ত দ্বন্দ্বের পটভূমি আমেরিকাতেও দৃশ্যমান। পুরো আমেরিকা গর্জে উঠেছে বর্ণবাদী হত্যার বিরুদ্ধে। এতো প্রবল গণবিক্ষোভ আমেরিকায় আগে দেখা যায়নি, যা এখন চলছে মানবিক মানুষের জ্বলন্ত প্রতিবাদের সংক্ষুব্ধ ভাষায়।
জর্জ ফ্লয়েড হত্যাকাণ্ড পুরো আমেরিকাকে মুখোমুখি করেছে এক ঐতিহাসিক প্রশ্নের সামনে। তা হলো কলম্বাসের রক্তাক্ত বর্বরোচিত পথে নাকি সুসভ্য মানবিকতার পথে চলবে আমেরিকা? জনগণ এই প্রশ্নের উত্তর পেতে বর্ণবাদী হত্যাকারীদের বিরুদ্ধে সরবে পথে নেমেছেন। তারাই নির্ধারণ করবেন আমেরিকার চরিত্র এবং সেটা যে বর্ণবাদী বর্বরদের ধ্বংস ও পরাজিত করেই রচিত হবে, ইতিহাস সে সমর্থনই জ্ঞাপন করে।
কেননা, শেষ বিচারে মানুষ ও মানবতারই জয় হয়। আমেরিকাতেও তাই হবে বর্ণবাদ ও সন্ত্রাসবাদের চূড়ান্ত অবসানের মাধ্যমে।
ড. মাহফুজ পারভেজ: অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম