গত তিন দিন ধরেই তোড়জোড়। মাইকিং। পূর্ব রাজাবাজার এলাকা রেড জোন। মঙ্গলবার (৯ জুন) রাত ১২টা থেকে লকডাউন। চার তলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে এসব দৃশ্য দেখি।
কার্যত ১৮ মার্চ থেকেই আমরা গৃহবন্দী। খুব জরুরি প্রয়োজন ছাড়া এই আড়াই মাসে বাসার বাইরে বের হইনি। অফিসও অনলাইনে, বাসায় বসে। এরইমধ্যে আবার টানা দুই-তিন সপ্তাহের লকডাউন।
আগের আড়াই মাস ছিল সাধারণ ছুটি। ফলে অধিকাংশ মানুষই গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরেছেন। অনেকে রাস্তায় বেরোলেও মাস্ক পরেননি। শারীরিক দূরত্ব বহু পরের কথা। ফলে কর্তৃপক্ষ বলছে এবার সত্যিই লকডাউন। প্রস্তুতি দেখে তা-ই মনে হচ্ছিলো।
১০ জুন বুধবার সকাল। ঘুম ভাঙলো মূলত উচ্চস্বরের মাইকিংয়ে। কারণ রাজধানীর ফার্মগেট-পান্থপথ সংলগ্ন এই পূর্ব রাজাবাজার এলাকাকে লকডাউন ঘোষণা করে একটিমাত্র বেরোনোর পথ রাখা হয়েছে গ্রিন সুপার মার্কেট ও আইবিএ হোস্টেলের পাশ দিয়ে। আমাদের বাসাও ঠিক এখানেই। ফলে মাইকের শব্দ বেশ ভালোভাবেই ঘরে প্রবেশ করে। বারবারই বলা হচ্ছে, চিকিৎসক-নার্স-সাংবাদিক ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর লোক ছাড়া কেউ বের হতে পারবেন না।
বারান্দায় এসে দাঁড়াই। বাড়ির সঙ্গেই একটা বড় নিম গাছ। সবুজ পাতার আড়াল ভেদ করে রাস্তার যাবতীয় কর্মকাণ্ড, মানুষের চলাচল, হুস করে রিকশার ছুটে চলা—সবই দৃশ্যমান। পরিপাটি পোশাক পরে বেশ কিছু লোককে দেখা যাচ্ছে তারা হেঁটে যাচ্ছেন। বোঝাই যাচ্ছে এই মানুষগুলো অফিসগামী। কিন্তু সবাই চিকিৎসক-নার্স-সাংবাদিক ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য নন। ফলে প্রবেশ ও বহির্গমনস্থল, যেখানে বাঁশ দিয়ে বেড়া দেওয়া হয়েছে এবং যেখানে মানুষের চলাচল নিয়ন্ত্রণে পুলিশ ও স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলের লোকজন রয়েছেন, সেখানে একটা বড় জটলা তৈরি হয়। বারবার মাইকিংয়ে বলা হচ্ছে, নির্দিষ্ট ওই দু তিনটি পেশার লোক ছাড়া কেউই বের হতে পারবেন না এবং নির্দেশ না মানলে জেল-জরিমানারও হুঁশিয়ারি দেওয়া হচ্ছে।
যারা রাজধানীর পূর্ব রাজাবাজার এলাকাকে করোনা সংক্রমণের কারণে ‘রেড জোন’ ঘোষণা করে এটিকে লকডাউন করার পরামর্শ দিয়েছেন, মানুষ আশা করে এটি তাদের সুচিন্তিত সিদ্ধান্ত। কিন্তু এই এলাকার একজন বাসিন্দা হিসেবে আমার মনে হয়, এটি মূলত ‘রাইট ডিসিশন ইন রং টাইম’। অর্থাৎ যে কাজটি করার কথা ছিল আড়াই মাস আগে, আমরা এখন এসে সেটি করছি।
এখানে কয়েকটি প্রশ্ন আছে:
১. বলা হচ্ছে রাজাবাজারে করোনা রোগী বেশি, তাই এটি লকডাউনের সিদ্ধান্ত হয়েছে। ৯ জুন আইইডিসিআরের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হিসাব বলছে, রাজাবাজারে করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছে মোট ২৮ জন। অথচ এর আশপাশের এলাকাগুলোয় যেমন গ্রিন রোডে ৭২ জন, কলাবাগানে ৬৮ জন, ফার্মগেটে ৬৩ জন, কাঁঠালবাগানে ৪১ জন এবং পান্থপথে ৩৭ জন করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছেন। সুতরাং রোগী বেশি—এটিই যদি রেড জোন এবং লকডাউন ঘোষণার ক্রাইটেরিয়া হয়, তাহলে রাজাবাজারের আগে তো এর আশপাশের এলাকাগুলোকে রেড জোন ঘোষণা করে সেখানে লকডাউন করা উচিত ছিল।
২. বলা হচ্ছে, কোনো এলাকায় প্রতি এক লাখ বাসিন্দার মধ্যে আক্রান্তের সংখ্যা ৩০ থেকে ৪০ জন হলে সেই এলাকা রেড জোন হিসেবে বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হবে। কিন্তু পুরো রাজাবাজারেই করোনা শনাক্তের সংখ্যা ৩০ জনের কম। সেক্ষেত্রে এটি রেড জোন হয় কী করে? বলা হচ্ছে, রাজাবাজারে লোকসংখ্যা ৪০ হাজার এবং এখানে যেহেতু শনাক্ত প্রায় ৩০ জন, ফলে পরীক্ষামূলকভাবে এটিকে লকডাউন করা হয়েছে। এখানে সফলতা এলে অন্যান্য রেড জোনও লকডাউন করা হবে। রাজাবাজারকে লকডাউন করার আরেকটি কারণ বোধ হয় এই যে, এই এলাকায় প্রবেশ ও বের হতে ৭-৮টি পথ রয়েছে। অধিকাংশ প্রবেশমুখেই গেট রয়েছে। ফলে এই এলাকাকে লকডাউন করা সহজ। যেহেতু বলা হচ্ছে এক্সপেরিমেন্টাল, তাই আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং লকডাউন বাস্তবায়নে দায়িত্বরতদের সুবিধার কথাও হয়তো এখানে বিবেচনায় নেয়া হয়েছে।
৩. এই লকডাউনকে বলা হচ্ছে পরীক্ষামূলক। ধরা যাক এসএসসি পরীক্ষার জন্য সরকার ফেব্রুয়ারি মাসকে নির্ধারণ করলো। তো মার্চ মাসে কোনো শিক্ষার্থী গিয়ে যদি এসএসসি পরীক্ষা দিতে চায়, তার পরীক্ষা নেয়া হবে? এখন যে লকডাউন করা হলো, এটা তো করার দরকার ছিল এপ্রিল মে মাসে। জুন মাসে এসে যে পরীক্ষা নেয়া হচ্ছে, তার রেজাল্ট কী হবে?
৪. বাংলাদেশে প্রথম করোনা শনাক্ত হলো ৮ মার্চ। শুরু থেকেই বলা হলো করোনা মোকাবেলায় সব প্রস্তুতি সম্পন্ন, আতঙ্কের কারণ নেই। বলা হলো সামাজিক সংক্রমণ হয়নি বা সেটার আশঙ্কা নেই ইত্যাদি। তারপর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের চাপে হোক বা যে কারণেই হোক, সরকার সাধারণ ছুটি ঘোষণা করলো। তাও ‘লকডাউন’ শব্দটি বললো না। সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হলো করোনা রোগী শনাক্তের ১৮ দিন পরে। এভাবে ৬৬ দিন চললো। অসংখ্য মানুষ গায়ে বাতাস লাগিয়ে ঘুরলো, গার্মেন্টস খুললো, লাখ লাখ মানুষ ঈদের আনন্দ করতে বাড়ি গেলো, বাড়ি থেকে ফিরে এলো এবং সরকার সাধারণ ছুটি সমাপ্তও ঘোষণা করলো। কিন্তু তার ৮ দিন পরে গিয়ে সংশ্লিষ্টদের মনে হলো যে পূর্ব রাজাবাজারকে লকডাউন করা দরকার! সংক্রমণের তিন মাস পরে গিয়ে মনে হলো যে এখন রেড জোন ইয়োলো জোন করা দরকার! ধরা যাক লকডাউনে এই এলাকায় করোনা আর ছড়ালো না। তো দুই বা তিন সপ্তাহ পরে তো এই এলাকায় আবার মানুষ আসবেন এবং এই এলাকার মানুষও অন্য জায়গায় যাবেন। তখন করোনা ছড়াবে না?
৫. কোনো এলাকাকে করোনামুক্ত ঘোষণা করতে চাইলে সেখানে সিরিয়াসলি বা আদর্শিক লকডাউন কতদিন অব্যাহত রাখতে হয়? প্রাথমিকভাবে রাজাবাজারে দুই সপ্তাহ এবং প্রয়োজনে আরও এক সপ্তাহ বাড়ানোর কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু ৯ জুন রাতে একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের টকশোতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক নজরুল ইসলাম জানান, কারো শরীরে করোনা ভাইরাস প্রবেশ করলে সেটির লক্ষণ দেখা দেয়ার জন্য দুই সপ্তাহ এবং চিকিৎসায় সুস্থ হওয়ার জন্য আরও দুই সপ্তাহ অপেক্ষা করতে হয়। এরপর পরবর্তী আরও ১০ দিন পর্যবক্ষেণ করতে হয়। তার মানে ৪ সপ্তাহের ২৮ দিন এবং শেষের ১০ দিন মিলিয়ে মোট ৩৮ দিন লকডাউন রাখতে হবে। প্রশ্ন হলো, কোনো একটি এলাকায় টানা ৩৮ দিন সবকিছু বন্ধ রেখে এভাবে লকডাউন কার্যকর কতটা বাস্তবসম্মত? বাসিন্দারা এটি মানবেন কি না এবং তাদের বিরক্তি একসময়ে ক্ষোভে রূপ নেবে কি না? যেখানে ২৬ মার্চ থেকে ৩০ মে পর্যন্ত দুই মাসেরও বেশি সময়ে টানা সাতদিনও কোথাও (রাজধানীর টোলারবাগ বাদে) সিরিয়াসলি লকডাউন কার্যকর করা যায়নি, সেখানে টানা ৩৮ দিন শক্ত লকডাউন মানানো সম্ভব? তাছাড়া অধ্যাপক নজরুল ইসলাম এও মনে করেন যে, সুফল পেতে চাইলে একসাথে পুরো ঢাকা শহরকে লকডাউন করতে হবে। বিচ্ছিন্নভাবে একটি দুটি এলাকায় লকডাউন করে কেবল সময়ক্ষেপণই হবে। মানুষের ভোগান্তি বাড়বে।
৬. রাজাবাজারের লকডাউনে চিকিৎসক-সাংবাদিক ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা ছাড়া এই এলাকায় বসবাসকারী আরও কাউকে বেরোতে বা ঢুকতে দেয়া হচ্ছে না। প্রশ্ন হলো, রাজাবাজারে যেসব বেসরকারি চাকরিজীবী বসবাস করেন, যাদের অফিস অন্য এলাকায়, তারা যদি টানা দুই তিন সপ্তাহ অফিসে যেতে না পারেন, তাহলে তাদের চাকরি থাকবে, সেই নিশ্চয়তা কে দেবে? এই এলাকায় যেসব দোকান আছে সেগুলো যদি দুই তিন সপ্তাহ বন্ধ থাকে, তাহলে আগামী মাসে তারা দোকান ভাড়া কীভাবে দেবেন? সরকারের তরফে তাদের বাড়িতে হয়তো চাল ডাল সরবরাহ করা হলো, কিন্তু মাস শেষে দোকান ভাড়াটা কে দেবে? ঢাকা উত্তর সিটির মেয়র আতিকুল ইসলাম অবশ্য জানিয়েছেন, রেড জোনের যেসব বাসিন্দার অন্য এলাকায় অফিস, তাদের চাকরি যাতে না যায়, সেজন্য সিটি করপোরেশনে তরফে তিনি সংশ্লিষ্ট অফিসগুলোয় অনুরোধ করবেন। তাছাড়া আইইডিসিআর-এর উপদেষ্টা মুশতাক হোসেনও গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, লাল রং চিহ্নিত এলাকায় যেন কারও চাকরি না যায়, সে ব্যাপারে সরকারের নির্দেশনা আছে। প্রয়োজনে সেই নির্দেশনার কথা মনে করিয়ে দিতে হবে।
তবে…
এই লকডাউনে একটা জিনিস ভালো হয়েছে, এখানের নাজনীন স্কুলে করোনা পরীক্ষার বুথ স্থাপন করা হবে। সেক্ষেত্রে লকডাউনের সময়ে এই এলাকার মানুষের মধ্যে কারো উপসর্গ দেখা দিলে তারা সহজে করোনা পরীক্ষা করাতে পারবেন আশা করি। আর যদি এই লকডাউনের পিরিয়ড শেষ হওয়ার পরে দেখা যায় যে এখানে নতুন কেউ আক্রান্ত হয়নি এবং আক্রান্তরা সবাই সুস্থ হয়েছেন, তাহলে দেশের প্রথম করোনামুক্ত এলাকার বাসিন্দা হিসেবে আমরা হয়তো গর্বিতবোধ করতে পারব।
আমীন আল রশীদ: কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স এডিটর, রংধনু টেলিভিশন।