মধ্যরাত। ঘড়ির কাঁটা তিন এর ঘর ছুঁইছুঁই করছে। মোবাইলের স্ক্রিনে চোখ রেখে ফেসবুক দুনিয়ায় ঘুরছি। বোধ করছি এই ঘুমিয়ে যাব, যাব, কিন্তু ঘুম হচ্ছে না। আমিও মোবাইল রাখছি না। ঘটনা নতুন নয়, করোনাকালে প্রায়ই এমন হচ্ছে আমার। কেন যে এমন হচ্ছে বুঝতে পারছি না। কোনো দিন এমন হচ্ছে যে, রাত পেরিয়ে ভোর, তারপর সকালের নরম রোদ বন্ধ জানালার অদৃশ্য ছিদ্র দিয়ে উঁকি মেরে জানান দেয় প্রতিদিনকার মত আরও একটি দিনের শুরু। তখনও গেল রাতের ঘুমটুকু বকেয়াই রয়ে গেল। মাঝে মাঝে ভাবনায় পেয়ে বসে, দিনকে দিন বকেয়া হয়ে জমাকৃত ঘুমগুলো একদিন খুব করে ঘুমিয়ে নেব। আহা.. ঘুম।
কিন্তু আমার আজকের আলোচনা ঘুম নিয়ে নয়। যে কথা বলছিলাম মোবাইলের স্ক্রিনে চোখ রেখে ফেসবুক দুনিয়ায় ঘুরছি। হঠাৎই চোখে পড়লো ভয়াবহ এক নির্মমতার চিত্র। যেমনটা আমরা প্রত্যহ লক্ষ্য করি মানুষের প্রতি মানুষের নির্মমতা, পৈশাচিকতার বহিঃপ্রকাশ, বিষয়টি এমন নয়।
এবার বরগুনার তালতলীর এক যুবক বাসা থেকে ডিমসহ ধরে এনে একটি মাছরাঙা পাখি জবাই করে তার ছবিসহ ফেসবুকে পোস্ট করে। পাখিটির হত্যাকারী কামরুজ্জামান ফারুক পোস্টে লিখেছেন- ‘অনেক তাড়াইছি লাভ হয় নাই, অতঃপর বাসায় রেড’। ছয়টি ডিমের পাশে গলা বিচ্ছিন্ন করা নিথর পরে থাকা পাখিটির ছবি দেখে এই মধ্যরাতে বুকের ভেতরটা কেমন জানি মোচড় দিয়ে উঠল। আহা.. এ কেমন হৃদয়হীন মানুষ!
নির্মম এই বিষয়টি শুধু আমি নই আরও অনেকের হৃদয়কে ক্ষতবিক্ষত করেছে, ক্ষুব্ধ করেছে মন। ফেসবুকে অনেকেই স্ট্যাটাস দিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। লেখক আদনান সৈয়দ লিখেছেন- ‘কী সুন্দর একটা মাছরাঙা পাখি! পাখিটা ডিমে তা দিতে নিশ্চয়ই তার বাসায় নিয়মিত আসা হত! আর এই পাষণ্ডটা পাখিটাকে মেরে দু’টুকরো করে ফেসবুকে ছবি দিল! এই লোকটা যে চোখ বুজে মানুষ খুন করতে পারবে সন্দেহ নেই। এর তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছি। দ্রুত এই মানসিক বিকারগ্রস্ত পশুটাকে গ্রেফতার করার অনুরোধ জানাচ্ছি।’
অনেকের কাছে এই ক্ষোভ প্রকাশকে আদিখ্যেতা মনে হতে পারে। দেশে যেখানে মানুষের জীবনের নিরাপত্তা নেই। যখন-তখন, এখানে-ওখানে, মানুষ মরছে। সেখানে একটি ছোট্ট মাছরাঙা পাখি নিয়ে এত কথা!
বিষয়টিকে এত সরলীকরণ করার সুযোগ নেই। আমাদেরকে এর গভীরে যেতে হবে। ভাবতে হবে ভিন্নভাবে। পাখিটির হত্যাকারী কামরুজ্জামান ফারুক কেন এই কাজটি করেছেন? তার তুলনায় সামান্য এই পাখিটির প্রতি তিনি কেন এত ক্ষিপ্ত হয়েছিলেন? একটি ক্ষুদ্র পাখি তার এমন কী ক্ষতি করতে পারে, যার জন্য একে গলা কেটে হত্যা করতে হবে। এখানেই শেষ নয় ভয়াবহ সেই কাণ্ডের ছবি আবার ফেসবুকে পোস্ট করে দেশবাসীকে দেখাতে হবে তার বিকৃত মানসিকতার রূপ। তার এই মানসিক বিকারগ্রস্ত হয়ে ওঠার পেছনের কারণটি কী? কিংবা এই অপরাধের বিচার আদৌ হবে কি না? এই প্রশ্নগুলো যখন মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল তখন জানতে পারি, এই পাখি হত্যাকারীর বিরুদ্ধে একটি মামলা হয়েছে।
মঙ্গলবার, ৯ জুন সন্ধ্যায় সাগর কর্মকার নামের একজন পাখিপ্রেমী বাদি হয়ে তালতলী থানায় মামলাটি দায়ের করেছেন। বন্য প্রাণী সুরক্ষা আইনে মামলাটি দায়ের হয়েছে। তালতলী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কামরুজ্জামান মিয়া সাংবাদিকদের বলেছেন- ‘পাখি হত্যার বিষয় তদন্ত করে, তার বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’ এই ঘোষণা শুনে আত্মতৃপ্তির ঢেকুর তুলতে চাই না।
লেখক আদনান সৈয়দ এর কথার সাথে আমিও একমত। এই লোকটা (কামরুজ্জামান ফারুক) চোখ বুজে মানুষ খুন করতে পারবে সন্দেহ নেই। সাম্প্রতিককালে এধরণের ঘটনা কিন্তু নতুন নয়। প্রাণ-প্রকৃতির প্রতি নির্মমতা এখন নিত্যদিনের ঘটনা।
এই তো সেদিন ভারতের কেরালায় পেটে বাচ্চা নিয়ে খাবারের খোঁজে বন থেকে লোকালয়ে এসেছিল একটি হাতি। তারপর ক্ষুধার্ত হাতিটি সামনে থাকা আনারস খেয়েছিল। কিন্তু কিছু মানুষ পূর্বেই সেই আনারসে ভরে রেখেছিল পটকাবাজি। পরে তা প্রাণীটির মুখে বিস্ফোরিত হয়। এরপর হাতিটি বাঁচার জন্য নদীতে নামে। সেখানে দাঁড়িয়ে অসহায় আহত হাতিটি মৃত্যুকে বরণ করতে বাধ্য হয়। এরপরই আমরা আমাদের দেশে হাতি হত্যার মত আরও একটি নির্মম ঘটনা প্রত্যক্ষ করি।
ঘটনাস্থল কক্সবাজার সদর উপজেলার ইসলামাবাদ ইউনিয়ন। আমরা জানতে পারি, বন্যহাতি মাকে গুলি করে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। হাতিটির দেহে বেশ কয়েকটি গুলির চিহ্ন ছিল। মৃত মায়ের দেহ আগলে রেখে মাতম করছে একটি বাচ্চা। কয়েক মাস বয়সী বাচ্চা হাতিটি কখনও শুয়ে পড়ে, কখনও উঠে মায়ের চারপাশে ঘুরছিল। বাচ্চাটির চোখ দিয়ে তখন অনবরত পড়ছিল জল। মায়ের মৃতদেহ নিয়ে বাচ্চা হাতির এমন মাতম দেখে সেখানে উপস্থিত লোকজনও কেঁদেছেন। এসবের মধ্যে আবার দেখলাম এসিড দিয়ে পুড়িয়ে দেয়া ক্ষতবিক্ষত একটি গরুর ছবি।
তারও কয়েকদিন আগে মাদারীপুরের চরমুগরিয়ায় খাবারের সঙ্গে বিষ মিশিয়ে ১৫টি বানর হত্যা করা হয়। হত্যাকারী একজন গৃহবধূ। বাড়ি-ঘরে বিরক্ত করায় তিনি বিষ দিয়ে এসব বানর হত্যা করেছেন বলে আমরা জনতে পারি। এখানে বানর হত্যা এই প্রথম নয়। এর আগেও ওই এলাকায় বিষ প্রয়োগ করে ৮টি বানর হত্যা করা হয়েছিল।
কয়েকদিন আগে বন্যপ্রাণী বিষয়ক সাংবাদিক হোসেন সোহেল এর ফেসবুক পোস্ট থেকে জানতে পারি, সিলেটের জৈন্তাপুরে ৬টি শেয়াল ২টি বাগডাশা ও ১টি বেজি হত্যা করা হয়। পরে অবশ্য এই অপরাধে মামলা করে বনবিভাগ। এরপর ফরিদপুর জেলার সদরপুর উপজেলায় ৫০টি ডাহুক পাখি হত্যার সংবাদ আমরা পাই। পাখিগুলোর হত্যাকারী শওকত ফকিরের বিরুদ্ধে ইতিমধ্যে মামলা হয়েছে। অভিযুক্ত ব্যক্তি একজন স্থানীয় পাখি বিক্রেতা। দেখুন কী সামান্য কারণে অবাধে বন্যপ্রাণী নিধন চলছে। চারপাশে খানিকটা সন্ধান করলে বন্যপ্রাণী হত্যার এই তালিকা শুধু দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হবে।
লেখাটি যখন শেষ করে আনবো তখনই মনে পড়ল ডলফিন হত্যার কথা। শুধুমাত্র এই করোনাকালেই দেশে একাধিক ডলফিন হত্যা করা হয়। চট্টগ্রামের হালদা নদীতে ধারালো অস্ত্রের আঘাতে হত্যা করা হয় একটি ডলফিন। পরে ভাসমান অবস্থায় সেটিকে উদ্ধার করা হয়। ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর থেকে এ পর্যন্ত হালদায় ২৪টি ডলফিনের মৃত্যু রেকর্ড করেছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের হালদা রিভার রিসার্চ ল্যাবরেটরি। তার আগে কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতে পড়ে থাকা একটি ডলফিনের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। ডলফিনটির শরীরে দায়ের এবং মাথায় লাঠির আঘাতের চিহ্ন ছিল।
প্রাণ-প্রকৃতির প্রতি এই নির্মম অত্যাচার আর মানতে পারছি না। এখনই এসব থামানো উচিৎ। এরজন্য আমাদেরকে সোচ্চার হতে হবে। ঐক্যবদ্ধভাবে সকলকে প্রাণ-প্রকৃতির সুরক্ষায় আওয়াজ তুলতে হবে। অপরাধীদের আইনের আওতায় এনে তাদের বিচার নিশ্চিত করতে হবে। তবেই ভবিষ্যতে এ ধরনের অপরাধ কমে আসবে। নিশ্চিত হবে প্রাণ-প্রকৃতির সুরক্ষা। আমাদের মনে রাখতে হবে প্রকৃতির সুরক্ষা মানেই সুন্দর পৃথিবী।
ফয়সাল আহমেদ: লেখক ও গবেষক