করোনাভাইরাসের অদৃশ্য সন্ত্রাসে ক্ষতবিক্ষত সমাজ ব্যবস্থায় 'অর্থনৈতিক উত্তরণ ও ভবিষ্যত পথপরিক্রমা’ স্লোগান নিয়ে ঘোষিত হয়েছে ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকার বাজেট। ২০২০-২১ অর্থবর্ষের জন্য প্রস্তাবিত এ বাজেটে ঘাটতির পরিমাণ ১ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা, যার বিশাল অংশ অর্থায়নের পরিকল্পনা রয়েছে ব্যাংক ঋণের মাধ্যমে।
বিশেষজ্ঞদের বিবেচনায়, ৩ লাখ ৭৮ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা উচ্চাভিলাষী, কারণ মন্দাকালীন অর্থনীতিতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বড় জোর ২ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকার মতো রাজস্ব সংগ্রহ করতে পারবে। এ পরিস্থিতিতে সরকার ব্যাংক থেকে ৮৫ হাজার কোটি টাকা ঋণ গ্রহণের পরিকল্পনা করলেও শেষ পর্যন্ত বাজেট বাস্তবায়ন করতে ব্যাংকের ওপর নির্ভরশীলতা আরও বাড়বে। ইতোপূর্বে করোনা মোকাবিলায় সরকারের ঘোষিত ১ লাখ কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়নে ব্যাংক থেকে প্রায় ৮২ হাজার কোটি টাকার ঋণ প্রদানের নির্দেশনা রয়েছে।
বর্তমানে খেলাফি ঋণের পরিমাণ আছে প্রায় ৯৫ হাজার কোটি টাকা। অধিকন্তু মহামারির এ দুঃসময়ে আমানতকারীরা খুব একটা ব্যাংকমুখী হবেন, তা-ও আশা করা যায় না। সার্বিক বিবেচনায় বর্তমান ব্যাংক ব্যবস্থার তারল্য পরিস্থিতি বাজেট ঘাটতি অর্থায়নে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারবে, এমন সম্ভাবনা ক্ষীণ। হোঁচট খাওয়া অর্থনীতির স্বাভাবিক গতি অর্জনে প্রয়োজন ব্যাপক ব্যক্তিগত বিনিয়োগ। ব্যাংক যদি সরকারের চাহিদা মেটাতেই চাপের মধ্যে থাকে, তবে ব্যক্তি পর্যায়ে ঋণ সরবরাহ করবে কোত্থেকে? ব্যাংকের অক্ষমতার কারণে ব্যক্তিগত বিনিয়োগ তেমন আশাব্যাঞ্জক হবে বলা যাচ্ছে না। এতে করে ব্যক্তিগত বিনিয়োগ জিডিপির শতকরা ২৫.৩ ভাগ হয়তো কাগুজে লক্ষ্যমাত্রা হিসেবেই রয়ে যাবে।
বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী আগামী অর্থবর্ষে ৮.২ ভাগ প্রবৃদ্ধির আশা করেছেন। এমন আশা বর্তমান বাস্তবতার নিরিখে কিছুটা কাল্পনিক, কারণ বিশ্বব্যাংক যখন বলছে, এবারের প্রবৃদ্ধি হবে ১.৬ ভাগ, তখন আগামী বছর তা ৮.২ ভাগ হতে হলে অর্থনীতির গতিপথ ইংরেজী ‘ইউ’ (ট) আকৃতির না হয়ে ‘ভি’ (ঠ) আকৃতির হওয়া চাই। ‘ভি’ আকৃতির হলে যা হতো- অর্থনীতি যেমনটা দ্রুত বেগে নিম্নমুখী হচ্ছে, অতি শিগগির তা আবার দ্রুতবেগে ঊর্ধ্বমুখী হবে। কিন্তু করোনা পরিস্থিতি দিনকে দিন যে চেহারা উম্মোচন করছে, তাতে মনে হয় না, নিকটতম সময়ে এ থেকে পরিত্রাণ মিলবে। তাই যদি হয়, তবে ‘ইউ’ আকৃতির সময়পথ বিবেচনায় রেখে ৮.২ ভাগ প্রবৃদ্ধির হার অসম্ভবই ধরে নিতে হবে। বিশ্ব অর্থনীতি যেখানে ৫.২ ভাগ সংকুচিত হওয়ার শঙ্কায়, সেখানে আমাদের ধনাত্মক প্রবৃদ্ধি আশা করতে বাধা নেই, তাই বলে ৮.২ ভাগ নিশ্চয়ই অনেক বেশি।
২ লাখ ৫ হাজার কোটি টাকার প্রস্তাবিত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে কাঠামোগত পরিবর্তন আনা নিতান্ত জরুরি। গত বেশ ক’বছর অর্থনৈতিক কার্যক্রমের গতিশীলতা আমাদের মাঝে আশার সঞ্চার করেছিল, অর্থনীতির বিবিধ সূচকে অনুকূল পরিবর্তন ছিল লক্ষণীয়। এমন ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকলে এডিপিতে অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত খাতগুলো যেমনভাবে চিহ্নিত হয়েছিল, তেমন থাকতে পারত।
কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মতো মেগাপ্রকল্পের জন্য ১৫ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ, আমাদের সাধ্যের বাইরে। এমন আরও কয়েকটি মেগাপ্রকল্পের বরাদ্দ কমিয়ে আনা সময়ের দাবি। চলমান সময়কে গত কয়েক বছরের স্বাভাবিক সময়ের অনুরূপ চিন্তা করলে পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন উভয়ই বিভ্রান্তিকর হবে।
চলছে এখন করোনকাল, যা অর্থনীতিতে একসাথে চাহিদা ও জোগান অভিঘাত জন্ম দিয়েছে। ভোক্তা, উৎপাদক, সরকার সবাই কিংকর্তব্যবিমূঢ়। অর্থনীতির প্রদীপ যেন ঝড়ো হাওয়ার কবলে একবার নিভে, আবার জ্বলে। নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত সবাই আছে অনিশ্চয়তা আর উৎকণ্ঠায়। আমদানি, রপ্তানি, রেমিটেন্স কোনো কিছুতে রাতারাতি আশাব্যাঞ্জক ঘটার মতো কিছু নেই। বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমায় বিপুল সংখ্যক প্রবাসী চাকরিচ্যুত হওয়ার ঝুঁকিতে আছে। এমন বাস্তবতায় বাজেটচিত্র ভিন্ন হওয়া আবশ্যক ছিল। অতি নাজুক স্বাস্থ্যখাত তেমন গুরুত্ব পেয়েছে বলে মনে হচ্ছে না। জিডিপির ন্যুনতম ৫% বরাদ্দ হলেও উক্ত পরিমাণ হওয়া উচিত প্রায় ১ লাখ ৪০ হাজার কোটি টাকা, কিন্তু করোনাকালীন ১০ হাজার কোটি টাকার থোক বরাদ্দসহ স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ মাত্র ৪১ হাজার ২৭ কোটি টাকা। ২০১৯ সালে পরিচালিত বিশ্বব্যাংক সমীক্ষা অনুযায়ী দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশে স্বাস্থ্যখাতে মাথাপিছু ব্যয় সর্বনিম্ন। ভারত, পাকিস্তানসহ এ অঞ্চলে স্বাস্থ্যখাতে গড় মাথাপিছু ব্যয় ১৫ ডলার। বাংলাদেশে তা মাত্র ৬ ডলার। এদেশে গড়ে ১৫৮১ জন লোকের জন্য একজন চিকিৎসক বিদ্যমান। বর্তমান বাজেটে জনগণ উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আশা করেছিল, কিন্তু বাস্তবে গতানুগতিক ধারা থেকে বের হয়ে আসার কোনো লক্ষণ পরিস্ফুট হয়নি।
বরাবরের মতো এবারও বাজেটে অপর যে খাতটি নীরবে অবহেলিত থেকে গেল, তা হলো শিক্ষা। ২০২০-২১ অর্থবছরে শিক্ষা খাতে মাত্র ৬৬ হাজার ৪০০ কোটি টাকা বরাদ্দ ঘোষণার মধ্য দিয়ে এ খাতকে অনাদৃত খাত হিসেবে চিহ্নিত করা হলো। তা-ও এ বরাদ্দ কেবল প্রাথমিক, মাধ্যমিক, কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষার জন্য। উচ্চশিক্ষায় বরাদ্দ অপ্রতুল। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের মাধ্যমে বরাদ্দ পেলেও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, বেসরকারি স্কুল, এমপিও বহির্ভূত কলেজ সরকারের কোনো বরাদ্দ পায় না, অথচ কেবল দেশের শ’খানেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে ৪ লাখেরও বেশি শিক্ষার্থী অধ্যয়ন করছে, যাদের অনেকে করোনাসৃষ্ট অর্থনৈতিক প্রতিকূলতায় টিউশন ফি দিতে ব্যর্থ হচ্ছে।
প্রায় ২৫ হাজার শিক্ষক-কর্মকর্তার জীবিকা অনিশ্চয়তার মুখোমুখি। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অসংখ্য শিক্ষার্থী করোনাকালে টিউশন হারিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে। গত চার মাস সারাদেশের সব পর্যায়ের প্রায় ৪ কোটি শিক্ষার্থী ঘরে বসে অলস সময় কাটাচ্ছে। করোনা সংক্রমণ রোধে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ আর ব্যক্তিপর্যায়ে আয় হ্রাস পাওয়ায় শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার শঙ্কা ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। পাশাপাশি অপুষ্টি, বাল্যবিবাহ, আগাম মাতৃত্ব বাড়ার ব্যাপক সম্ভাবনার উদ্রেক হয়েছে। একটি সম্ভাব্য সমাধান হতে পারত, এসব শিক্ষার্থীকে অনলাইনে পাঠদান- যে উদ্দেশে প্রয়োজন তথ্যপ্রযুক্তি সুবিধা, প্রয়োজন ল্যাপটপ, ফ্রি ডাটা এবং নিরবিচ্ছিন্ন ইন্টারনেট সংযোগ। বর্তমান বাজেটে এসবের প্রতিফলন ঘটেনি। বরং মোবাইল ফোন সেট, সিম অথবা কল রেটে কর বৃদ্ধি শিক্ষাবিমুখী হিসেবে বিবেচিত হবে, কারণ পুরো দেশে শিক্ষার্থীদের বড় অংশ এখনও উপযুক্ত মোবাইল সেটের অভাবে অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রমে সংযুক্ত হতে পারছে না। তাই শিক্ষার্থীবান্ধব একটি নীতি গ্রহণ করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে ছাত্র পরিচয়পত্র ব্যবহার করে করমুক্ত মোবাইল সেট, ল্যাপটপ ইত্যাদি সরবরাহের ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন। অধিকন্তু বর্তমান আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় মোবাইল ফোন ব্যবহারে খরচ বৃদ্ধি নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত তথা সাধারণ জনগণের ওপর অতিরিক্ত করবোঝার শামিল।
সার্বিক বিষয় বিবেচনা করে বিজ্ঞমহল শিক্ষা খাতে মোট বাজেটের অন্তত ১৫ ভাগ বরাদ্দের প্রস্তাব করে আসছিল। শিক্ষা খাতের বর্তমান বরাদ্দ জিডিপির মাত্র ২ দশমিক ০৯ শতাংশ, যা হওয়া উচিত জিডিপির ন্যূনতম ৬ শতাংশ। শিক্ষা খাতে নিশ্চয়ই এমন কোনো পরিপূর্ণতা অর্জন হয়ে যায়নি যে কারণে ২০২০-২১ অর্থবর্ষে মোট বাজেটের মাত্র ১১ দশমিক ৬৯ শতাংশ বরাদ্দ ঘোষণা করল, যা ২০১০-১১ অর্থবছরে ছিল ১৪ দশমিক ৩ শতাংশ।
জাতিসংঘের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, এশীয় ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের মোট ৩৫টি দেশের মধ্যে জিডিপির সাপেক্ষে শিক্ষা খাতে ব্যয় বিবেচনায় বাংলাদেশের অবস্থান ৩৪তম। এমন দৈন্যতার মধ্যে এ খাত আরও পিছিয়ে পড়ুক, তা কাম্য নয়।
সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৯৫ হাজার ৫৭৪ কোটি টাকা। কোনো সন্দেহ নেই, সামাজিক নিরাপত্তা সূচকে বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে। করোনা জানান দিয়ে যাচ্ছে, আমাদের আর্থসামাজিক অবস্থা কতটা নাজুক। রোগী বহনের জন্য অ্যাম্বুলেন্স নেই, ভর্তির জন্য হাসপাতাল নেই, সেবাগ্রহণের জন্য ডাক্তার নেই, নিঃশ্বাস গ্রহণের জন্য অক্সিজেন নেই।
মাস খানেক লকডাউন হলে শতকরা ৯৫ ভাগ মানুষের আয় হ্রাস পায়, দরিদ্র মানুষের সংখ্যা ২১ ভাগ থেকে বেড়ে ৪৪ ভাগ হয়। এমন বাস্তবতায় সামাজিক নিরাপত্তা বরাদ্দ আরও বেশি হতে আপত্তি নেই, কিন্তু হতদরিদ্র মানুষের জাতীয় পরিচয়পত্র বিক্রি করে যখন দুষ্টু 'মানুষ'গুলো টাকা লুটে নেয়, যখন গরিবের অনুকূলে বরাদ্দকৃত চাল জনপ্রতিনিধির গুদামে চলে যায়, তখন আপত্তি থাকা স্বাভাবিক।
বাজেটতো কেবল উপস্থাপন হলো। সর্বমহলে প্রত্যাশা এ বাজেট আরও সময়োপযোগী হবে, দুর্নীতি ও কালোটাকা বিরোধী হবে, করোনা সংকটকে গুরুত্ব দেওয়া হবে, করনীতি দরিদ্রবান্ধব হবে, তামাকপণ্যের কর বাড়বে, মোবাইল ফোনসহ সাধারণ জনগণের ব্যবহার্য দ্রব্য ও সেবার দাম কমবে, কৃষি-স্বাস্থ্য-শিক্ষা যথাযথ মর্যাদা পাবে, ব্যাংকিং খাত চাপমুক্ত হবে, জ্বালানি তেলের দাম হ্রাস এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য সেবা উৎপাদন বৃদ্ধির উদ্যোগের মাধ্যমে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করবে।
ড. মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম: অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়