সম্প্রতি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিয়মিত সংবাদ বুলেটিনে করোনায় আক্রান্ত মৃতের লাশ দাফন সম্পর্কে অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) নাসিমা সুলতানা বলেন, ‘বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) বলেছে, এটা প্রমাণিত হয়নি মৃত ব্যক্তির কাছ থেকে অন্য ব্যক্তির দেহে করোনাভাইরাস ছড়িয়েছে। মৃতদেহ সৎকার করতে তিন-চার ঘণ্টা সময় লেগেই যায়। তিন ঘণ্টা পর মৃত ব্যক্তির শরীরে এই ভাইরাসের আর কার্যকারিতা থাকে না। সে জন্য মৃতদেহ থেকে ভাইরাস ছড়ানোর কোনো আশঙ্কা নেই।’
এ বক্তব্যের আলোকে বলা চলে, করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া ব্যক্তির সৎকার যেকোনো জায়গায় করা যাবে। মুসলিম ধর্মাবলম্বীরা পারিবারিক বা অন্য যেকোন কবরস্থানে মৃতদেহ দাফন করতে পারবেন। অন্য ধর্মাবলম্বীরাও তাদের ধর্মীয় বিধি অনুযায়ী মৃতদেহের সৎকার করতে পারবেন।
তার পরও সতর্কতার জন্য, নিয়ম অনুযায়ী মৃতদেহের সব আনুষ্ঠানিকতা শেষে বডি ব্যাগ বা তা না পাওয়া গেলে পলিথিনে মুড়িয়ে মনোনীত কবরস্থান বা পারিবারিকভাবে নির্ধারিত স্থানে দাফন করা যাবে। সুতরাং করোনায় আক্রান্ত মৃতের লাশ দাফন নিয়ে অযাচিত ভয় ও বিভ্রান্তি কাম্য নয়।
তারপরও আমরা দেখছি, করোনায় আক্রান্তদের মৃতদেহ নিয়ে সাধারণ মানুষের মাঝে এক ধরনের ভয় কাজ করছে। যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে করোনার উপসর্গ নিয়ে কিংবা করোনায় আক্রান্তদের লাশ নিয়ে মর্মস্পর্শী ও অমানবিক ঘটনা প্রকাশ পেয়েছে। মানুষ হিসেবে এগুলো হৃদয় বিদারক ও লজ্জাজনক। এর মধ্য দিয়ে সমাজের মানুষের অমানবিক ও কুৎসিত স্বার্থপরতা চিত্রই প্রকাশ পেয়েছে।
আমরা জানি, যেকোনো ক্রান্তিকালেই মানুষের মানসিকতা, মানবিকতা ও সহমর্মিতা যেমন প্রকাশিত হয়; বিপরীত দিকে বিভাজন, অমানবিকতা ও অসহযোগিতাও প্রকাশ পায়। ভয়ঙ্কর করোনা মহামারির প্রাদুর্ভাব ঘটেছে এক বৈশ্বিক যুদ্ধের আকারে। এটা সুনির্দিষ্ট কোনো গোষ্ঠী বা ধর্মের লোকদের শুধু আক্রান্ত করছে না। করোনা আমাদের জাতীয় জীবনের বিপদ। দুঃখ-কষ্ট ও অনিশ্চয়তার আঘাত হানা ছাড়াও বিপুলসংখ্যক দরিদ্র মানুষের জীবনধারণের সমস্যা প্রকটতর করে তুলেছে।
জাতীয় এই মহাদুর্যোগ একদিন না একদিন কেটে যাবে- ইনশাআল্লাহ। কিন্তু পারিবারিক ভালোবাসা, সামাজিক সংহতি, মমত্ববোধ, সহমর্মিতা ও সহযোগিতাহীনতার রেশ থেকে যাবে দীর্ঘদিন। এর ক্ষত সমাজকে বয়ে বেড়াতে হবে অনেকদিন। মানুষের স্বাভাবিক সংবেদনশীলতা, মানবতাবোধ ও পরার্থপরতার মূলে আঘাত দেওয়ার কথা মানুষকে নিষ্ঠুর বাস্তবতার মুখে দাঁড় কয়ে দিয়েছে। সেটা হলো- নিজে ভালো থাকা। এখানে সন্তান কিংবা মা-বাবা, ভাই-বোন ও আত্মীয়-স্বজনের কথা নস্যি। অথচ এই কঠিন সময়ের সহমর্মিতা ও সহযোগিতায় তাদেরই আগে হাত বাড়ানোর কথা ছিল।
আমাদের মনে রাখতে হবে, বিশ্বে করোনাই প্রথম মহামারি নয়। যুগে যুগে এ ধরনের মহামারি আরও দেখা গেছে। এসব প্রাণঘাতি ব্যাধির মধ্যে প্লেগ, জিকা ভাইরাস, ইবোলা, হলুদ জ্বর, কুষ্ঠরোগ, জল বসন্ত, কলেরা, ইনফ্লুয়েঞ্জা, ম্যালেরিয়া, যক্ষ্মা, টাইফয়েড, হাম ইত্যাদি। এসব রোগে বিভিন্ন সময় মানব সমাজ বিপন্ন ও বিপর্যস্ত হয়েছে। কিন্তু সমাজ মানুষ আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে। সঙ্কটকাল জয় করা মানুষের স্বভাব ধর্ম। কিন্তু সামাজিক ক্ষত মুছে ফেলা কঠিন কাজ। যে করোনাকালে আমাদের মাঝে দেখা যাচ্ছে।
করোনাভাইরাসে গোটা বিশ্ব যখন আতঙ্কিত তখন নতুন করে আলোচনায় আসছে অতীতের মহামারি ও সেগুলোর ধ্বংসাত্মক প্রভাবের কথা। গত শতাব্দির দু’টি বিশ্ব যুদ্ধসহ পারমাণবিক বোমা। বন্যা, খরা, অগ্নুৎপাত, ভূকম্পন, সাইক্লোন ও বিভিন্ন মহামারি পৃথিবীকে বিপর্যস্ত করেছে।
এসব মহামারি মানব সভ্যতায় সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলেছে। করোনা আমাদের কোন জায়গায় নিয়ে যাবে, সেটা অনুমান করা মুশকিল। বিজ্ঞানীরা বলছেন, করোনাভাইরাস মানুষের দেহ কোষের মধ্যে ইতিমধ্যে ‘মিটটেট’ করছে অর্থাৎ গঠন পরিবর্তন করে নতুন রূপ নিচ্ছে এবং সংখ্যা বৃদ্ধি করছে। যার কারণে এটি বেশি বিপদজনক। করোনাভাইরাস বিপদজনক হলেও মানুষ হিসেবে তা থেকে পালানোর কোনো উপায় নেই।
মানছি, স্বভাবতই মানুষ যেকোনো রোগকে ভয় পায়। অসুস্থ হলে হতাশায় ভেঙে পড়ে। কারণ এতে অসহনীয় কষ্ট এবং মৃত্যুর ভয় থাকে। করোনা এই ভয়কে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু করোনাকালে আমরা দেখছি, বিভিন্ন রোগে আক্রান্তদের তুলনায় করোনার লক্ষণধারী কিংবা করোনায় আক্রান্তরা নানাভাবে মানুষের অবহেলার শিকার হচ্ছেন। খোদ পরিবারের সদস্যরাও তাদের সেবাযত্ন করছেন না। অনেককে তো রাস্তায় রেখে যাওয়ার ঘটনাও ঘটেছে।
হাসপাতালগুলোতে ভর্তি হওয়া যেমন দুরূহ, তেমনি চিকিৎসা পাওয়াও রীতিমত ভাগ্যের ব্যাপার। ভর্তির জন্য যাওয়া ও ভর্তি হওয়া রোগীদের কী ধরনের বিড়ম্বনা, হয়রানি ও অসহযোগিতার সম্মুখীন হতে হয়েছে, তার আংশিক বিবরণ পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে বা বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে। তা লোমহর্ষক বললেও কম বলা হয়। এমন আচরণও কোনোভাবেই কাম্য নয়।
ইসলামের শিক্ষা হলো- মানুষ তার চলাফেরা, খাওয়া-দাওয়ায় এমন নীতি গ্রহণ করবে না, যাতে রোগভোগের আশঙ্কা থাকে। অর্থাৎ সতর্কতা অবলম্বন করবে। প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলবে। তার পরও রোগাক্রান্ত হয়ে গেলে, হতাশ হবে না। র্ধৈয্যধারণ করে চিকিৎসা নেবে। মনে রাখতে হবে, ইবনে মাজা শরিফে বর্ণিত হাদিসে ‘অসুস্থাবস্থায় মৃত্যুবরণ করলে শহীদের মর্যাদা পাওয়ার কথা’ বলা হয়েছে।
সুতরাং রোগ হতাশা এবং ভয়ের কারণ নয়। আর রোগীর দেখাশোনা ও সেবা-যত্ন ইবাদত হিসেবে মনে করে তা পালন করতে হবে।
করোনাসহ যেকোনো আক্রান্ত হওয়া অপরাধ নয়। যেকোনো ব্যক্তি যেকোনো সময় যেকোনো রোগে আক্রান্ত হতে পারেন। আল্লাহর নবীরাও রোগে আক্রান্ত হয়েছেন।
হজরত আইয়ুব (আ.)-এর দীর্ঘ রোগভোগের কথা আমরা সবাই জানি। মানুষ রোগাক্রান্ত হলে এমনিতেই মানসিকভাবে সে দুর্বল হয়ে যায়। এমতাবস্থায় তার সঙ্গে অমানবিক আচরণ, সামাজিকভাবে বয়কট, অবজ্ঞা, অবহেলা তাকে মৃত্যুর মুখে ঠেঁলে দেয়। এমন প্রবণতা কোনোভাবেই কাম্য নয়। এগুলো ধর্মীয় বিধিবিধান পরিপন্থি কাজ। এমন অমানবিক কাজ থেকে সবাইকে বিরত থাকতে হবে। করোনাসহ যেকোনো রোগীর পাশে দাঁড়াতে হবে। এটাই মানবতা ও ইসলামের শিক্ষা।
করোনা বিপর্যয়ের সূচনাকাল থেকে জোর দিয়ে প্রতিনিয়ত বলা হচ্ছে, ‘আতঙ্ক নয়, সচেতনতাই কাম্য।’ বাস্তবে মানুষ এ ব্যাপারে যতটা সচেতন, এর চেয়ে ঢের বেশি আতঙ্কিত। তার চেয়েও বড় কথা, নানা ধরনের অপবাদ ও কলঙ্কের শিকার হচ্ছেন অনেকে। এমন আতঙ্ক ও অপবাদের কার্যকর মোকাবেলা করতে হবে। এ জন্য সচেতনতা ও সতর্কতার কোনো বিকল্প নেই।
মুফতি এনায়েতুল্লাহ: বিভাগীয় প্রধান, ইসলাম