এই লেখাটি যখন প্রকাশিত হবে তখন হয়তো সারাদেশের ‘রেড জোন’ সম্পর্কে সরকারি অর্থাৎ স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা চলে আসবে। লকডাউন কার্যকর করার প্রস্তুতি চলবে। কোথাও কোথাও লকডাউন কার্যকর হয়েও যেতে পারে। সেটা আমার আলোচনার বিষয় না। আমি আলোচনা করতে চাচ্ছি এই ‘রেড জোন’ আর ‘লকডাউন’ নিয়ে আমরা গণমাধ্যম কর্মীরা কী করছি, আমাদের গণমাধ্যম-ই বা কী ভূমিকা রাখছে।
রেড জোন ও লকডাউন নিয়ে গত কয়েকদিনের গণমাধ্যম ঘাটাঘাটি করলে এর একটা চিত্র স্পষ্ট হয়ে উঠবে। বিশেষ করে গত ১৪ জুন রোববার সারাদিন এবং রাত পর্যন্ত বিভিন্ন অনলাইন মিডিয়া, পত্রিকা এবং টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে ‘রেড জোন’ ও ‘লকডাউন’ এর সংবাদ যেভাবে প্রকাশিত হল তাতে আমার কাছে মনে হয়েছে আমাদের গণমাধ্যমের দৈন্যতাই ফুটে উঠেছে।
আমরা সংবাদকর্মীরা যেভাবে কার আগে কে ব্রেকিং নিউজ দেবো- এমন অসুস্থ প্রতিযোগিতা করে কোনো রকম সোর্স ছাড়াই বা সরকারের কোনো দায়িত্বশীল ব্যক্তির বক্তব্যকে ভুলভাবে উপস্থাপন করে সংবাদ প্রকাশ করছি তা আমার কাছে রীতিমত একটা বিস্ময়ই মনে হয়েছে। কারণ এমন প্রতিযোগিতাপূর্ণ ব্রেকিং নিউজ দেশের সাধারণ মানুষকে আতঙ্ক, উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা আর অস্থিরতার মধ্যেই ঠেলে দেওয়ার সামিল। এ কারণে বিশ্বজুড়ে চলা একটা মহামারির সময়ে, একটা গভীর সংকটকালে সাংবাদিকতা কেমন হওয়া উচিত- সেই প্রশ্ন বেশ বড় করে সামনে চলে এসেছে।
আমরা সবাই জানি, টানা ৬৬ দিনের সাধারণ ছুটির পর সরকার গত ৩০ মে থেকে সরকারি অফিস-আদালত থেকে শুরু করে গণপরিবহন, ব্যবসা-বাণিজ্য, শপিংমল সবকিছু সীমিত পরিসরে খুলে দিয়েছে। একই সঙ্গে বলেছিল ১৫ জুন পর্যন্ত পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। এর মধ্যেই গত ১ জুন সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের নির্দেশে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের নেতৃত্বে সচিবালয়ে একটি জরুরি বৈঠক বসে। যেখানে সরকারের বেশ কয়েকজন মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রী, ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র এবং সরকারের মন্ত্রিপরিষদ সচিব, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিবসহ বেশ কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন।
ওই বৈঠকে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ পরিস্থিতি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হয় এবং সবার মতামত নেয়া হয়। বৈঠক শেষে স্বাস্থ্য মন্ত্রী জানিয়েছিলেন, সরকার সংক্রমণ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে জোন ভিত্তিক লকডাউনের চিন্তাভাবনা করছে সরকার। অর্থাৎ সারাদেশকে ‘রেড’, ইয়েলো’ এবং ‘গ্রিন’ জোনে ভাগ করে সবচেয়ে বেশি সংক্রমণ যে এলাকা সেটিকে ‘রেড জোনে’র আওতায় এনে লকডাউন করা হবে। ইয়েলো জোনের ক্ষেত্রেও চলাচল সীমিত করে কড়াকড়ি করা হবে। গ্রিন জোন থাকবে মুক্ত।
এই বৈঠকের পর থেকে অন্য সংবাদকর্মীদের মত আমিও বিষয়টি ফলো করে আসছি এবং নিয়মিতই আপডেট রিপোর্ট দেয়ার চেষ্টা করেছি। জোন ভিত্তিক লকডাউনের সিদ্ধান্তটি কার্যকর করতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও দপ্তরগুলোর সহযোগিতা নিয়ে একটি এসওপি বা স্ট্যান্ডার্ড অপারেশন প্রসিডিউর তৈরি করে। একই সঙ্গে আইসিটি মন্ত্রণালয় ও এটুআই এর মাধ্যমে টেকনিক্যাল সাপোর্ট নিয়ে জোন ভাগ করার কাজ শুরু করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এর মধ্যেই গত ৯ জুন মঙ্গলবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রস্তাবিত এসওপি অনুমোদন দেন। এরপর থেকেই বেশি করে খোঁজ-খবর রাখছিলাম কবে রেড জোন ঘোষণা করা হবে এবং লকডাউন-ই বা কবে থেকে কার্যকর হবে।
একটা বিষয় বলে রাখা ভালো, এসওপি অনুমোদনের আগেই সিদ্ধান্ত হয় ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের আওতাধীন রাজাবাজার, দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের আওতাধীন ওয়ারী, নরসিংদীর মাধবদী পৌরসভা, নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের একটি এলাকা এবং গাজীপুরের কালীগঞ্জ পৌরসভাকে লকডাউন করার। কিন্তু নানা জটিলতার কারণে সেটি আর হয়ে ওঠেনি। শেষ পর্যন্ত ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন পরীক্ষামূলকভাবে পূর্ব রাজাবাজার এলাকা লকডাউন করে মঙ্গলবার মধ্যরাত থেকে। যা এখনও চলমান।
এই অবস্থায় গত কয়েকদিন ধরেই সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, দপ্তর, অধিদপ্তর, সংস্থা, বিশেষজ্ঞ কমিটি, জনপ্রতিনিধিরা সিরিজ বৈঠক করেছেন। এসব বৈঠকের মূল উদ্দেশ্যই হচ্ছে কিভাবে রেড জোন এলাকা লকডাউন করা যায়। লকডাউন কার্যকর করতে মাঠ পর্যায়ে বিভিন্ন কমিটিও গঠন করা হয়েছে ইতিমধ্যে। কিন্তু এতো এতো বৈঠক, কমিটির পরও রাজধানী ঢাকা বা দেশের কোন কোন এলাকা ‘রেড জোন’ এর আওতায় সে বিষয়ে কোন ঘোষণাই আসছিল না। প্রতিদিনই সরকারের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা বারবারই বলছিলেন, রেড জোন এলাকা চিহ্নিত করতে আরও কিছুটা সময় লাগবে, দু’এক দিনের মধ্যেই আনুষ্ঠানিকভাবে জানিয়ে দেয়া হবে। আর জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন বলছিলেন, সরকারি অফিস আদালতসহ সবকিছু সীমিত পরিসরে যেভাবে চলছে সেভাবেই চলবে। আর যেসব এলাকা রেড জোনের আওতায় পড়বে এবং লকডাউন হয়ে যাবে সেসব এলাকায় সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হবে। গত কয়েকদিন ধরে এভাবেই চলছিল।
সমস্যা বাঁধলো গত ১৪ জুন রোববার। ওই দিন একটা অনলাইন পোর্টাল জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রীকে উদ্বৃত্ত করে জানাল যে, ১৫ জুন,সোমবার থেকেই লকডাউন শুরু। আরেকটি পত্রিকা টেকনিক্যাল কমিটির একটা বৈঠকের উদ্বৃতি দিয়ে জানালো, রাজধানী ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের ৪৫ টি এলাকাকে ‘রেড জোন’ করা হয়েছে। একই সঙ্গে পত্রিকাটি আরও জানালো, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর ও নরসিংদীর কয়েকটি এলাকাকেও ‘রেড জোন’ করা হয়েছে। দিন গড়িয়ে সন্ধ্যা হতে না হতেই একে একে অনেকগুলো টেলিভিশন চ্যানেল ব্রেকিং নিউজ হিসেবে প্রচার করতে লাগলো যে ঢাকার ৪৫টি ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ১১টি এলাকা রেড জোন হিসেবে চিহ্নিত। নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর ও নরসিংদীর কয়েকটি এলাকাও রেড জোন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। যে কোন সময় লকডাউন।
কিন্তু একজন ক্ষুদ্র সংবাদকর্মী হিসেবে আমি সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে যতদূর জানতে পারলাম তার সারমর্ম হচ্ছে ১৪ জুন রাত ১০টা পর্যন্ত কোন এলাকাই রেড জোন হিসেবে চিহ্নিত হয়নি। আইইডিসিআর এর পরিচালক মীরাজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা জানালেন, এখনও কোন কিছু চূড়ান্ত হয়নি। রেড জোন চূড়ান্ত হলে আমরা আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা দেব। একই সঙ্গে তিনি এ কথাও জানালেন, যেসব গণমাধ্যমে রেড জোন চূড়ান্তের খবর প্রচারিত হচ্ছে সেটা সঠিক নয়।
একই দিন (১৪ জুন) বিকেলে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেনের সঙ্গে কথা বললে তার জবাব ছিল এরকম- আরে ভাই আমি তো কাউকে বলিনি যে কাল থেকে লকডাউন শুরু। একটা অনলাইন পোর্টাল আমাকে উদ্বৃত করে সেটি প্রচার করেছে। আমি জানার পর তাদের জিজ্ঞেস করতেই তারা সেটি প্রত্যাহার করে নিয়েছে। জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী বলছিলেন, লকডাউন ঘোষণা করার এখতিয়ার তার নয়। সেটি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের। আমরা শুধু লজিস্টিক সাপোর্ট দেব।
রীতিমত টাস্কি খাওয়ার মত অবস্থা। আমাদের গণমাধ্যমগুলো কে কার আগে ব্রেকিং নিউজ দেবে এই প্রতিযোগিতায় গিয়ে নগরবাসী তথা সারাদেশের মানুষকে একরকম উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা আর আতঙ্কিত করে তোলার পাশাপাশি বিভ্রান্তও করেছে। যা এই মহামারীর সময়ে কোনভাবেই কাম্য নয়। তর্কের খাতিরে ধরেই নিলাম যে, ‘রেড জোন’ এলাকা চিহ্নিত করা হয়ে গেছে। কিন্তু সরকারি ঘোষণার আগে সেটি কোন রকম সংবাদসূত্র ছাড়া প্রচার করা কতোটা যথাযথ- সেটা আমার মাথায় কোনভাবেই আসছে না। কারণ সময়টা কঠিন এবং বিষয়টাও স্পর্শকাতর।
তাছাড়া রেড জোন ঘোষণার ক্ষেত্রে সরকারের কোন কৌশলও তো থাকতে পারে। তাই সূত্র উল্লেখ করে সংবাদটি প্রচার করলে সাধারণ মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি ছড়াত না।
মহামারির এই কালে আমাদের গণমাধ্যমের দায়িত্বশীল ভূমিকা খুব জরুরি। প্রতিযোগিতাকে অন্তত কিছুটা সময়ের জন্য দূরে ঠেলে দেয়া উচিত এই সংকটকালে। কারণ সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, দপ্তর, সংস্থার মধ্যে সমন্বয়হীনতার কারণে এমনিতেই মানুষ বিভ্রান্ত। এই সময়ে গণমাধ্যমও যদি সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করে তাহলে তো সংকট দূর করা কঠিন। তাই প্রতিযোগীতা নয়, গণমাধ্যমের আরও দায়িত্বশীল হওয়া জরুরি এবং সময়ের দাবি।
নিজামুল হক বিপুল: সাংবাদিক, লেখক