মোদ্দা কথা হল আমরা আর ‘নরমাল’ পরিস্থিতিতে ফিরছি না বরং ‘নিউ নরমাল’ বা নতুন স্বাভাবিক জীবনে প্রবেশ করতে যাচ্ছি। কালের এই বাঁক বদলের সময় পাল্টে যাওয়া পৃথিবীতে কেমন হবে আমাদের জীবন যাপন, জীবিকা প্রবাহ, আত্মীয়তার বন্ধন কিংবা সামাজিক আচরণ?
করোনাভাইরাস পরবর্তী পরিস্থিতিতে আমরা কতটুকু, কতদ্রুত নিজেদের খাপ খাইয়ে নিতে পারব সেটাই হল আসল কথা। পারতে আমাদের হবেই। না হলে ‘সারভাইভাল অব দ্যা ফিটেস্ট’ নীতিতে ছিটকে পড়তে হবে। গভীর সমুদ্রে ছোট ছিদ্রের কারণেও যদি বিরাট জাহাজ ডুবতে থাকে সেখান থেকে যারা বেঁচে যায়, টিকে যায় তারাই তো সবকিছু সাজায় নতুন করে-এটাই বাস্তবতা। একইভাবে হালের অদৃশ্য শক্তির (কোভিড-১৯) আঘাতে পাল্টে যাওয়া পৃথিবী কেমন হবে, কারা থাকবে তা নিয়ে শত জল্পনা কল্পনার মাঝেই শুরু হয়ে গেছে পরিবর্তন।
বিশ্বজুড়ে এখন বদলের হাওয়া। ‘নিউ নরমাল’ খ্যাত পরিবর্তিত পৃথিবীতে নতুন মোড়কে আমাদের নবযাত্রা শুরু। যদিও ‘নিউ নরমাল’ শব্দটি একবারে নতুন নয়। ২০০৭-০৮ সালের বৈশ্বিক মন্দার পরেও উচ্চারিত হয়েছিল এই শব্দটি। তবে এবারের করোনাকালে ‘নিউ নরমাল’ এর সাথে লকডাউন, সঙ্গরোধ, আইসোলেশন, হার্ড ইমিউনিটির মত অনেক অপ্রচলিত ও অপরিচিত শব্দগুলোও আমাদের কানে-মুখে জায়গা করে নিয়েছে।
শুধু নতুন শব্দ সম্ভার নয়, বিভিন্ন অনলাইন ইন্টারেক্টিভ মিটিং টুলস যেমন গুগল মিট, জুম, গো-টু-মিটিং, গো-টু-ওয়েবইনার, ওয়েবএক্স, মাইক্রসফটট মিটিং, স্ট্রিমইয়ার্ড, বি-স্ট্রিম, বি-লাইভের মত সফটওয়্যার, অ্যাপস আমাদের নৈমিত্তিক কাজের ভরসা হয়ে উঠছে। প্রযুক্তির পরশে অনেক নতুন অভ্যাস, কাজের বিকল্প ধরন, আচরণগত পরিবর্তনও চোখে পড়ার মত। আমরা মানি আর না মানি ইতোমধ্যে আমাদের মন-মস্তিষ্ক এসব নতুনের আহবানে সাড়া দিতে শুরু করেছে। এরই মধ্যে ‘ওয়ার্ক ফ্রম হোম’ বা বাসায় বসে কাজের নীতি চালু হয়ে গেছে অনেক অফিসে। জব বা প্রজেক্ট ট্র্যাকিং টুলসের ব্যবহার, ভার্চুয়াল কাস্টমার সার্ভিস, বিভিন্ন সফটওয়্যার ভিত্তিক এইচআর ব্যবস্থাপনাসহ কর্মক্ষেত্রে নানা পরিবর্তন আসছে। যদিও উন্নত বিশ্বে অনেক আগে থেকেই এগুলোর ব্যবহার হচ্ছে।
আমাদের এ অভিজ্ঞতা অনেকটা নতুন হলেও অনেক জায়গায় ঘরে বসে অফিস করাও তাদের কাছে মামুলি ব্যাপার। গুগল টুইটারের মত জায়ান্ট প্রতিষ্ঠানগুলোতো ঘোষণাই দিয়েছে যে আগামী ২০২১ সাল পর্যন্ত তাদের বেশিরভাগ কর্মী বাড়িতে বসেই অফিসের কাজ করতে পারবেন। ফোর্বস ম্যাগাজিনের এক নিবন্ধে বলা হয়েছে, কোভিড-১৯ পরিস্থিতির কারণে নতুন অর্থনৈতিক মন্দার মুখোমুখি পুরো বিশ্ব। এমন পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্যবিধি মেনে সব কর্মীর কাজ করানোর মাধ্যমে প্রতিষ্ঠান টিকিয়ে রাখতেই ওয়ার্ক ফ্রম হোম ধারণা জনপ্রিয় হচ্ছে। তাছাড়া, এতে অফিস স্থাপন ও ব্যবস্থাপনা ব্যয়ও কমে আসবে।
‘নিউ নরমাল’ পরিস্থিতিতে হয়তো প্রযুক্তি নির্ভর ভার্চুয়াল ব্যবস্থা ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত’ হিসেবে টিকে থাকবে। করোনার সাথে পাল্লা দিয়ে পাল্টে যাচ্ছে ব্যবসায়ের চিত্র। হয়তো বদলে যাবে বাজারের প্রচলিত সজ্ঞা। ক্রেতা বিক্রেতার আনাগোনায়, প্রয়োজনীয় পণ্যের আদান প্রদানে যেভাবে জমে উঠতো বাজার, বিপণী বিতান তা এখন অনেকটাই অনলাইন নির্ভর হয়ে যাচ্ছে। চাল, ডাল থেকে প্রসাধনী, পোশাক থেকে বাচ্চার খেলনা সবই উঁকিঝুঁকি করছে ‘ভার্চুয়াল বাজারে’।
পরস্পর সম্পর্কের ক্ষেত্রেও ‘ভার্চুয়াল ভালবাসায়’ গা ভাসিয়ে হয়তো তৃপ্ত থাকতে হবে আগামীতে। গা ঘেঁষাঘেঁষি, বুকে মাথা রেখে আশ্রয় খোঁজা বা হাতে হাত রেখে পথচলার জন্য প্রয়োজন হবে বাড়তি সতর্কতা, সুরক্ষা সামগ্রী! ‘পৃথিবী বদলে গেছে যা দেখি কি নতুন লাগে, তুমি আমি একি আছি দুজনে যা ছিলাম আগে’ কবিগুরুর গানে কণ্ঠ মিলিয়ে আবেগী এই গানের মত দু’জনে আর আগের মত থাকা হবে না।
পৃথিবীর সাথে পাল্টে যাবে আমাদের হৃদয়ের গান। তখন হয়তো কবি নির্মলেন্দু গুনের মত বলতে হবে ‘হাত দিয়ে ছুঁই না তোকে, মন দিয়ে ছুঁই---।
সবচেয়ে বেশি শূন্যতা তৈরি হবে শিশুদের কমল মনে। স্কুল ভ্যানে শহুরে শিশুদের ঠাসাঠাসি স্কুলে যাওয়া বা গ্রাম্য বালক বালিকাদের দলবেঁধে সাঁতার কাটায় জারি হবে নতুন নিষেধাজ্ঞা। কলোনির মাঠে, গলির মুখে খেলায় মেতে উঠতে দেখে ভয়ে শিউরে উঠবে অভিভাবকবৃন্দ। বরং ধরে বেধে মোবাইল, ট্যাবে কিংবা টিভির পর্দায় বসিয়ে দেখাবে বাইরের পৃথিবী।
অনলাইন ক্লাসে বাচ্চাদের সিলেবাস শেষ করিয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তুলবে ‘ডিজিটাল’ বাবা মা। এভাবে শান্ত অনুগত লক্ষ্মী ছেলেমেয়েরা হয়তো কবি নজরুলের ‘থাকবোনাকো বদ্ধ ঘরে, দেখবো এবার জগতটাকে’ কবিতার চরণ চিরদিনের জন্য ভুলে যাবে অথবা ভুলিয়ে দেওয়া হবে।
করোনার কারণে যদি মানুষের দূষণ, দুঃশাসন আর দুর্যোগ কমে যায় তবে হয়তো জেগে উঠবে সজীব প্রকৃতি, বহতা নদী ফিরে পাবে গতি, অতিথি পাখির পাখায় ভর করে ফিরে আসবে সুখবার্তা। সংকটে টিকে থেকে করোনা পরবর্তী পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নতুন পৃথিবী সাজানোর প্রত্যয় জেগে থাক প্রতিটি প্রাণে।
নাজমুল হুদা: প্রাবন্ধিক, গবেষক ও উপপরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক