নাকারিন ইনতা নামে থাইল্যান্ডের এক পাইলটকে নিয়ে সংবাদ প্রকাশ করেছে আন্তর্জাতিক বেশ কয়েকটি গণমাধ্যম। যিনি এখন মোটরসাইকেলে খাবার সরবরাহ করেন। মহামারি করোনাভাইরাস তাকে আকাশ থেকে মাটিতে নামিয়ে এনেছে।
খবরে বলা হচ্ছে, করোনার কালে এক দেশ থেকে আরেক দেশে ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞার কারণে বাণিজ্যিক এয়ারলাইন্সগুলো বড় ধরনের সংকটে পড়েছে। অনেকেই কর্মীদের বেতন দিতে পারছে না। ফলে নাকারিন ইনতার মতো অনেকেই নেমেছেন বিকল্প আয়ের সন্ধানে।
এ তো গেল একজন বিদেশি আকাশচারীর কথা। চোখ ফেরানো যাক দেশের মাটিতে। ৬৫ বছর বয়সী অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক মো. আবুল কালাম আজাদ। বাড়ি ময়মনসিংহ। অবসরের পরে সংসার চলত গৃহশিক্ষকতা করে। মাসে আয় হতো প্রায় ১০ হাজার টাকা। কিন্তু মহামারি করোনার আঘাতে সে পথ বন্ধ। ফলে বাধ্য হয়ে শুরু করেছেন অটোরিকশা চালানো। সারা জীবন পড়িয়েছেন ‘লেখাপড়া করে যে, গাড়িঘোড়া চড়ে সে’। জীবন সায়াহ্নে এসে তিনি এখন সেই গাড়ি চালাচ্ছেন!
গোলাম কিবরিয়া নামে আরেক শিক্ষক এখন রাজমিস্ত্রি। দিনাজপুরের পার্বতীপুর উপজেলার একটি কিন্ডার গার্টেনের সহকারী শিক্ষক ছিলেন তিনি। কিন্তু করোনাঝড়ে গত ১৭ মার্চ থেকে বন্ধ রয়েছে তার স্কুল। স্কুলের পরিচালকেরও দুরাবস্থা। ফলে তার কাছে মাসিক বেতন চাইতে পারছেন না। সম্মানের ভয়ে রাস্তায় লাইনে দাঁড়িয়ে ত্রাণও নিতে পারছেন না। কাউকে কষ্টের কথা বলতে পারছেন না। অবশেষে শুরু করেছেন রাজমিস্ত্রির জোগালির (সাহায্যকারী) কাজ।
বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের এ রকম দুর্দশার কথা প্রতিনিয়তই গণমাধ্যমের শিরোনাম হচ্ছে। করোনা পরিস্থিতিতে রাজধানীসহ দেশের বেশিরভাগ বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নন-এমপিও শিক্ষক-কর্মচারীরা প্রায় তিন মাস ধরে বেতন পাচ্ছেন না। হাতে গোনা কয়েকটি প্রতিষ্ঠান বেতন দিলেও বেশিরভাগ নন-এমপিও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীরা বেতন পাননি। রাজধানীসহ সারাদেশের কিন্ডার গার্টেনের প্রায় ছয় লাখ শিক্ষক গত এপ্রিল থেকে বেতন পাচ্ছেন না বলে জানা গেছে।
২.
সম্প্রতি বেশ কয়েকটি সংবাদপত্রে রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় বাড়ির সামনে, গলির মুখে, রাস্তার পাশে, বিদ্যুতের খুঁটিতে, দেয়ালে সাঁটানো টু-লেট লেখা বিজ্ঞাপনের ছবি প্রকাশ করে লেখা হয়েছে, করোনার কারণে রাজধানীর অনেক বাসা বাড়ি খালি হয়ে গেছে। ফলে ঝুলছে টু-লেট। আগামী দিনগুলোয় এই সংখ্যা যে আরও বাড়বে, তাতে সন্দেহ নেই। কারণ, করোনা এসে যে অসংখ্য মানুষের প্রাণ নিচ্ছে তা-ই নয়, বরং অসংখ্য মানুষের জীবিকাও শেষ করে দিয়েছে। অসংখ্য মানুষ এরই মধ্যে চাকরি হারিয়েছেন। তাদের অনেকে বিকল্প চেষ্টা করছেন। না পেলে পৃথিবীর অন্যতম ব্যয়বহুল এই শহরে থেকে তারা কী করবেন? আরও অনেকেই হয়তো জন্মস্থানে ফিরে যাবেন।
অনেকের চাকরি আছে, কিন্তু বেতন কমে গেছে। বহু প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। এবার রোজার ঈদে অনেক বড় প্রতিষ্ঠানও কর্মীদের বোনাস দেয়নি। অনেকে আংশিক দিয়েছে। এই প্রজন্মের মানুষের জন্য এটি বোধ হয় প্রথম অভিজ্ঞতা যে বেতন বাড়ার বদলে কমেছে। ব্যাংক, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় এমনকি অনেক বিখ্যাত করপোরেট প্রতিষ্ঠানেও কর্মী ছাঁটাই এবং বেতন কমানোর খবর এসেছে। সুতরাং যিনি এতদিন ২০ হাজার টাকা বাসা ভাড়া দিতেন, আগামী মাস থেকে তাকে হয়তো ১০-১২ হাজার টাকার বাসা খুঁজতে হবে। ফলে টু-লেটের সংখ্যা বাড়বে।
ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভলপমেন্ট (বিআইজিডি)-এর এক গবেষণা বলছে, রাজধানীতে যাদের নিজের বাসস্থান নেই, সেসব চাকরিজীবী বা শ্রমজীবী মানুষের আয়ের প্রায় অর্ধেক চলে যায় বাসা ভাড়ায়। সঙ্গত কারণেই করোনার প্রভাবে যাদের বেতন কমেছে বা যারা চাকরিচ্যুত হয়েছেন, তাদের পক্ষে বেশি ভাড়া দিয়ে এই শহরে থাকা সম্ভব হবে না। অনেকেই তল্পিতল্পা গুছিয়ে গ্রামের বাড়িতে চলে গেছেন। তাতে অন্তত বাসা ভাড়াটা বাঁচবে। সড়ক-মহাসড়ক, ফেরিঘাট ও রাজধানীর সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালে গিয়ে এ রকম অনেক পরিবারের সন্ধান পেয়েছেন সাংবাদিকরা।
একটি পত্রিকার খবরে বলা হচ্ছে, রাজধানীতে সাবলেটের সংখ্যাও বেড়েছে। একটি ফেসবুক গ্রুপে দেখা যায়, শেষ ২০ পোস্টের মধ্যে ১২টিই সাবলেট বিষয়ক। এই পোস্টে একজন লিখেছেন, তিন মাস ধরে বেতন বন্ধ। আগে বাসা নিয়ে থাকতাম। এখন সম্ভব না হওয়ায় বাধ্য হয়ে সাবলেট থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। অনেকে আবার খরচ কমানোর জন্য পরিবারের সদস্যদের বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়ে নিজে কোনো মেস বা ছোট বাসায় উঠেছেন। পক্ষান্তরে অনেক মেসও ফাঁকা হতে শুরু করেছে। করোনার কারণে বন্ধ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। তাই মেসগুলো ছেড়ে দিচ্ছেন শিক্ষার্থীরা। ফলে মেস ভাড়া দিয়ে যাদের সংসার চলত, তারাও বিপাকে পড়েছেন। ২০২০-২১ অর্থবছরের বিকল্প বাজেট নিয়ে এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি বলেছে, মহামারি করোনাভাইরাসের কারণে অনেক মানুষ কাজ হারিয়েছেন। অনেক মানুষের শ্রেণি কাঠামোর পরিবর্তন হয়েছে। নতুন করে অনেক মানুষ হতদরিদ্র হয়েছেন।
৩.
মূলত সরকারি চাকরিজীবী ছাড়া অন্য সব পেশার মানুষই এখন ঝুঁকিতে পড়ে গেছেন। করোনার কারণে সারা দেশের অর্থনীতি যে ভয়াবহ সংকটে এরই মধ্যে পড়ে গেছে এবং ভবিষ্যতে এই সংকট আরও ঘণীভূত হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে, তাতে বেসরকারি খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোর টিকে থাকা এক বিশাল চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে। কতগুলো প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাবে, আবার যেগুলো চালু থাকবে সেখানে কত লোক ছাঁটাই হবেন, তা এখনই বলা মুশকিল। এমনকি বড় বড় করপোরেট প্রতিষ্ঠানও নিজেদের বাজেট কমাবে। বাজেট কমানো মানে কর্মী ছাঁটাই। এখন করোনার সময়ে মানবিক কারণে হয়তো অনেকে ছাঁটাই করছে না। কিন্তু পরিস্থিতি ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হতে শুরু করলে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের কর্মীদের সঙ্গে কী আচরণ করবে, তা বলা যাচ্ছে না।
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা বলছে, করোনার কারণে সারা বিশ্বে প্রায় ১৬০ কোটি মানুষ বেকার হবে। বিকল্প আয়ের উৎস ছাড়া এই মানুষদের টিকে থাকার কোনো উপায় থাকবে না। আর বৃহস্পতিবার (১৮ জুন) স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ বলেছেন, দেশ থেকে আগামী এক-দুই বা তিন মাসে করোনাভাইরাস যাবে না। বরং এটি দুই থেকে তিন বছর বা তারও চেয়ে বেশি সময় স্থায়ী হবে। যদি তা-ই হয়, অর্থাৎ উচ্চ হারে না হলেও করোনা যদি আরও দুই তিন বছর মৃদু অথবা মাঝারি মাত্রায়ও থেকে যায়, তাহলে এই সময়ের মধ্যে সব প্রতিষ্ঠান এবং আয়-রোজগারের সবগুলো খাত স্বাভাবিক হতে পারবে না। ফলে আরও অনেক মানুষের কর্মহীন হওয়ার শঙ্কা তৈরি হবে। অনেক বড় প্রতিষ্ঠানও তাদের কলেবর ছোট করে ফেলবে।
স্বাস্থ্য খাতের কিছু প্রতিষ্ঠান যেমন ওষুধ কোম্পানি বা চিকিৎসার সঙ্গে যুক্ত ব্যবসার হয়তো প্রসার ঘটবে। অনলাইনভিত্তিক খাদ্য ও বস্ত্র সরবরাহের ব্যবসাও হয়তো আরও বেশি বিকশিত হবে। কিন্তু অন্যান্য প্রায় সব ধরনের পেশায় যে ধাক্কা লেগেছে, তা কাটিয়ে উঠতে আসলেই কতদিন, কত মাস বা কত বছর লাগবে, তা এখনই বলা কঠিন। সুতরাং শুধু বিভিন্ন খাতে সরকারি প্রণোদনা দেয়া কিংবা সামাজিক নিরাপত্তার জাল বিস্তৃত করে এই পরিস্থিতিতে দীর্ঘমেয়াদে টিকে থাকা যাবে না। সেজন্য প্রয়োজন হবে নতুন ধরনের অর্থনীতি-যেখানে ভোগ-বিলাসের পরিমাণ কমিয়ে মানুষের জীবন বাঁচানো এবং তার স্বাস্থ্য সুরক্ষাই হবে প্রধান মন্ত্র।
আমীন আল রশীদ: কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স এডিটর, রংধনু টেলিভিশন।