নমুনা পরীক্ষার তেলেসমাতি
বড় কোনো দুর্যোগ হানা দিলে কিছু লোক সেই দুঃসময়কে পুঁজি করে ব্যক্তিগত সুবিধা নিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে— যেখান থেকে এসেছে ‘ঘর পোড়ার মধ্যে আলুপোড়া প্রবাদটি’। এরকম একটি ‘আলুপোড়া চক্র’কে ধরলো পুলিশ—যারা রাজধানীতে বাড়ি বাড়ি গিয়ে করোনার নমুনা সংগ্রহ করে পাঁচ থেকে দশ হাজার টাকার বিনিময়ে করোনার ভুয়া রিপোর্ট দিতো।
শুরু থেকেই যেহেতু করোনার নমুনা দেয়া এবং পরীক্ষা করানোর প্রক্রিয়াটি অত্যন্ত জটিল ও ভোগান্তির বিষয় হয়ে আছে, ফলে সেই সুযোগ নিচ্ছে কিছু চক্র, যারা করোনা পরীক্ষায় এভাবে হোম সার্ভিসের নামে প্রতারণা করে আসছে। তবে শুধু বাড়ি গিয়ে নমুনা সংগ্রহ এবং রিপোর্ট দেয়ার নামে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেয়াই নয়, বরং নমুনা সংগ্রহ এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই টাকার বিনিময়ে করোনার ভুয়া পজিটিভ-নেগেটিভ (যার যেটা দরকার) সার্টিফিকেট দেয়—এরকম একটি চক্রও ধরা পড়েছে। একটি দুটি চক্র ধরা পড়েছে মানে হলো এরকম চক্র আরও আছে। সুতরাং এরইমধ্যে তারা কত লোকের কাছ থেকে কত টাকা হাতিয়ে নিয়েছে এবং কত মানুষকে ভুয়া সার্টিফিকেট দিয়ে প্রতারিত করেছে, সেটিই প্রশ্ন।
করোনার নমুনা পরীক্ষা নিয়ে আরও নানারকম অদ্ভুত ও ভয়াবহ খবর গণমাধ্যমের শিরোনাম হচ্ছে। যেমন ২৩ জুন অনলাইন নিউজ পোর্টাল বাংলা ট্রিবিউনের একটি শিরোনাম ছিল ‘নমুনা না দিয়েই করোনা পজিটিভ!’ এই প্রতিবেদনে বলা হয়, নমুনা পরীক্ষা ছাড়াই চট্টগ্রামের সাংবাদিক এম এ হোসাইন করোনা পজিটিভ শনাক্ত হয়েছেন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এসএমএসে বলা হয়, ওই সাংবাদিক ঢাকার ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ল্যাবরেটরি মেডিসিন অ্যান্ড রেফারেল সেন্টারে নমুনা দিয়েছেন। নমুনা পরীক্ষায় তার করোনা পজিটিভ এসেছে। মূলত ওই সংবাদকর্মী নমুনাই দেননি। ফলে যে প্রশ্নটি এখন উঠছে তা হলো, নমুনা ছাড়াই যদি করোনা পজিটিভ রিপোর্ট আসতে পারে, তাহলে যারা নমুনা দিচ্ছেন, তারা কতটুকু সঠিক রিপোর্ট পাচ্ছেন?
হাসপাতালের বেড খালি
কোনো সরকারি হাসপাতালে নাকি সিট খালি নেই। ফলে করোনা অথবা অন্য কোনো রোগ নিয়ে গেলে ভর্তি করা যায় না। ভর্তি হতে না পেরে ফিরে আসার ঘটনা নিয়মিত। অথচ ২২ জুন দৈনিক কালের কণ্ঠর প্রতিবেদনে বলা হয়, হাসপাতালে শয্যা খালি নেই বলে রোগী ফিরিয়ে দেওয়ার অভিযোগ উঠলেও বাস্তবে হাসপাতালের অর্ধেকের বেশি অর্থাৎ ৬১.৯৩ শতাংশ শয্যাই খালি পড়ে আছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল) ডা. আমিনুল ইসলামের বরাত দিয়ে ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, রাজধানী ঢাকার হাসপাতালগুলোয় ৫০ শতাংশ বেডই খালি পড়ে আছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ২১ জুনের প্রতিবেদন অনুযায়ী, যেমন বসুন্ধরা আইসোলেশন সেন্টারে দুই হাজার ১৩ বেডের মধ্যে বর্তমানে রোগী আছে মাত্র ১০০ জন। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে কোভিডের জন্য নির্ধারিত রয়েছে ৯১০টি শয্যা। এর মধ্যে এদিন রোগী ভর্তি ছিলেন ৫৮৯ জন। কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে শয্যাসংখ্যা ৫০০। এদিন রোগী ছিলেন ৩৩২ জন। ৫০০ বেডের মুগদা জেনারেল হাসপাতালে রোগী ছিলেন ২৩৪ জন। ২০০ বেডের কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে রোগী ছিলেন ১৩৫ জন। তার মানে এটা কি চিকিৎসা না দেয়ার ফন্দি বা বেশি রোগী ভর্তি করে ‘ঝামেলা’ না বাড়ানোর কৌশল? জনগণের পয়সায় বেতন নেয়া সরকারি ডাক্তার এবং হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের এই আচরণকে কী বলা যাবে, নৈরাজ্য?
৩০ মিনিটের অক্সিজেন বিল ৮৬ হাজার টাকা
একটি টেলিভিশনের খবরে দেখানো হলো, রাজধানীর একটি বড় বেসরকারি হাসপাতালে এক রোগীর ৩০ মিনিটের অক্সিজেন সাপোর্টে বিল করা হয়েছে ৮৬ হাজার টাকা। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক রোগী না দেখলেও কনসালট্যান্ট ফি ৪৯ হাজার টাকা এবং সার্ভিস চার্জ যোগ করা হয়েছে ৪৫ হাজার টাকা। আইসিইউ সাপোর্ট ছাড়াই ১৫ দিন হাসপাতালে থাকার খরচ ৩ লাখ ৮৩ হাজার ৭শ ৫৯ টাকা।
করোনাকালে বেসরকারি হাসপাতালে এরকম ‘ভুতুড়ে’ বিল করার খবর এটিই প্রথম নয়। আবার সরকারি হাসপাতালে গিয়ে মানুষ যে চিকিৎসা নেবে, তারও উপায় নেই। কারণ করোনা রোগীদের ভর্তি করতে পারাটাই এখন বিশাল সৌভাগ্যের ব্যাপার। কোথাও সিট খালি নেই। আইসিইউ তো দূরের কথা।
নন কোভিড বা করোনা ছাড়া অন্য রোগের চিকিৎসা পেতেও যে কী ভয়াবহ ভোগান্তি, তা এই অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যারা না গিয়েছেন, তারা কল্পনাও করতে পারবেন না। প্রতিনিয়তই গণমাধ্যম ও সোশ্যাল মিডিয়ায় কিছু কিছু খবর আসছে। পরিস্থিতি নিয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বক্তব্যের সঙ্গে বাস্তবতার তফাৎ আকাশ-পাতাল। বেসরকারি হাসপাতালে ভুতুড়ে বিল করার সপক্ষে কর্তৃপক্ষের যুক্তি হলো, আগের চেয়ে চিকিৎসক ও সংশ্লিষ্টদের বেতন দিতে হচ্ছে দ্বিগুণেরও বেশি। করোনার কারণে স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করতেও খরচ বেড়ে গেছে।
করোনা কি ধনী হওয়ার সুযোগ?
একটি বেসরকারি হাসপাতালের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, তারা তাদের হাসপাতালে করোনা রোগীদের চিকিৎসা দেয়ার প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। কিন্তু ডাক্তাররা করোনার কারণে/অজুহাতে তাদের ফি ও অন্যান্য আর্থিক সুবিধা দাবি করছেন দুই থেকে চারগুণ বেশি। ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘আমরা মানবিক ও দায়িত্বের কারণে কোভিড-নন কোভিড সব ধরনের রোগীদের ন্যূনতম মূল্যে সেবা দিতে চাইলেও ডাক্তারদের আচরণে সেটা সম্ভব হচ্ছে না।’ তিনি জানান, ডাক্তারদের অতিরিক্ত পয়সা দেয়ার কারণে হাসপাতালে সকল সেবার মূল্য পুনঃনির্ধারণ করতে হয়েছে। এমনকি পরীক্ষা নিরীক্ষায় আগে যে ডিসকাউন্ট দেয়া হতো, সেটিও বাতিল করতে হয়েছে।
প্রশ্ন হলো, করোনাকে কি তাহলে কিছু চিকিৎসক ধনী হবার হাতিয়ার বানাতে চাচ্ছেন? লাখ লাখ মানুষ যে বিনা চিকিৎসায় ঘুরছে, সেই রূঢ় বাস্তবতাটি তাদের হৃদয়কে নাড়া দেয় না? মনে রাখা দরকার, একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে যারা সম্মুখ সমরে অংশ নিয়েছিলেন, তাদের সবার হাতে আধুনিক অস্ত্র বা সুরক্ষাব্যবস্থা ছিল না। তারা নগদ টাকার লোভেও জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করেননি। কিন্তু এখন যদি সুরক্ষা সামগ্রী আর অতিরিক্ত বেতন ও সম্মানীর অজুহাতে করোনার মতো মহামারিকালে মানুষকে বাঁচানোর যুদ্ধ থেকে কেউ সরে যান বা দায়িত্বে অবহেলা করেন, তার চেয়ে দুঃখজনক আর কী হতে পারে!
তবে সবাই নিশ্চয়ই এরকম নন। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আমাদের অনেক ডাক্তার ও নার্সরা করোনা রোগীদের সেবা দিচ্ছেন, তা নিয়ে কোনো দ্বিমত নেই। অনেক ফ্রন্টলাইন ফাইটার মারাও গেছেন। অনেকে আক্রান্ত হয়েছেন, হচ্ছেন। ফাউন্ডেশন ফর ডক্টরস সেফটি রাইটস অ্যান্ড রেসপন্সসিবিলিটির (এফডিএসআর) হিসাবে, ২১ জুন পর্যন্ত দেশে করোনায় ৪৪ জন চিকিৎসকের মৃত্যু হয়েছে। এছাড়া, করোনা উপসর্গ নিয়ে মারা গেছেন আরও ৭ জন চিকিৎসক। তাদের সবার প্রতি আমাদের বিনম্র শ্রদ্ধা। কিন্তু সেই সাথে সাথে মুদ্রার অন্যপিঠ নিয়েও আমাদের কথা বলতে হবে। যদি সত্যিই কিছু ডাক্তারের পয়সার লোভের কারণে চিকিৎসার খরচ দুই তিনগুণ বেড়ে যায়, তাহলে সেটি অত্যন্ত দুঃখজনক।
অসুস্থ হওয়ার সময় নয়
করোনার কারণে বেসরকারি হাসপাতালগুলোয় বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের অধিকাংশই চেম্বারে ফেরেননি। খুব অল্প সংখ্যক ডাক্তার চিকিৎসা দিচ্ছেন। অথচ ইউরোপ আমেরিকায় অনেক অবসরপ্রাপ্ত চিকিৎসকদেরও করোনার চিকিৎসায় কাজে লাগানো হচ্ছে। কিন্তু আমাদের দেশের সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালের বেতনভুক্ত সব চিকিৎসকই মাঠে নেই; অবসরপ্রাপ্তরা তো দূরে থাক। অথচ মানুষকে সেবা দেয়াই চিকিৎসকদের ব্রত। যারা সরকারি মেডিকেলে পড়াশোনা করে চিকিৎসক হয়েছেন, দেশ ও জনগণের প্রতি তাদের দায়বদ্ধতা আরও বেশি। কারণ জনগণের পয়সায় তারা পড়ালেখা করে ডাক্তার হয়েছেন। অথচ করোনার অজুহাতে সেই জনগণকেই চিকিৎসা দেয়া থেকে বিরত থাকবেন বা করোনার অজুহাতে বেতন ও অন্যান্য আর্থিক সুবিধা দুই তিন গুণ বেশি দাবি করবেন, সেটি কাম্য নয়। চিকিৎসক সংকটের কথা বিবেচনায় নিয়ে সরকার আনুষ্ঠানিকতা ছাড়াই দুই হাজার ডাক্তার নিয়োগ দিয়েছে। আরও দুই হাজার নিয়োগের প্রক্রিয়া চলছে। কিন্তু তারপরও পরিস্থিতির কতটা উন্নতি হচ্ছে তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।
এই পরিস্থিতিতে অনেকে বলছেন, এখন অসুস্থ হওয়ার সময় নয়। সবার এখন প্রার্থনা একটাই, করোনা হোক বা না হোক, এই চিকিৎসা না পাওয়ার মহামারির সময়ে কাউকেই যেন হাসপাতালে যেতে না হয়। কারণ এরইমধ্যে অনেক জটিল রোগের চিকিৎসা যেমন ক্যান্সারের কেমো, কিডনি রোগের ডায়ালাইসিস বা জরুরি অস্ত্রোপচার করাতেও অনেকের সীমাহীন ভোগান্তির খবর গণমাধ্যমে আসছে। সবখানে একই অজুহাত, করোনা। অথচ সরকারের তরফে বারবারই বলা হচ্ছে, করোনা মোকাবেলায় পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।
মন্ত্রীর চেয়েও শক্তিশালী ডিজি
সম্প্রতি নোয়াখালী-৪ আসনের সংসদ সদস্য মোহাম্মদ একরামুল করিম চৌধুরীর একটি বক্তব্য বিভিন্ন গণমাধ্যমে এসেছে—যা নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায়ও তোলপাড় চলছে। মি. চৌধুরী স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিরও সদস্য। তার বক্তব্যে দেশের স্বাস্থ্য খাতের পুরো চিত্র পরিষ্কার। তিনি বলেন, তিনি জানেন না স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় আসলে কে চালায়? তার মনে হয় মন্ত্রীর চেয়েও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বেশি ক্ষমতাবান। এই মন্ত্রণালয় যে বিরাট সিন্ডিকেটের হাতে বন্দি, সে কথাও তিনি বলেছেন এবং সেই সিন্ডিকেট কোথা থেকে নিয়ন্ত্রিত হয়, তাও বলেছেন। এই সংসদ সদস্যও মনে করেন, প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ ছাড়া স্বাস্থ্য খাতের এই নৈরাজ্য বন্ধ হবে না।
আমীন আল রশীদ: কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স এডিটর, রংধনু টেলিভিশন।