দেশের প্রায় সর্বত্র বিদ্যমান করোনার বিপদের সঙ্গে কোথাও কোথাও যুক্ত হয়েছে বন্যার প্রকোপ। উত্তর ও মধ্যাঞ্চলের অনেক নদ-নদীর পানির বিপদসীমা অতিক্রম করেছে।
বর্ষাকালে বাংলাদেশে বন্যা একটি স্বাভাবিক ঘটনা। বলতে গেলে, নিয়মিতভাবে দেশের নিম্নাঞ্চল বন্যায় প্লাবিত হয়। এজন্য অতিবৃষ্টি ও উজানের পাহাড়ি ঢল দায়ী।
বাংলাদেশের মতো বর্ষাবহুল, পলিমাটিময়, ভাটির দেশে বন্যার বিরুদ্ধে যত ব্যবস্থাই নেওয়া হোক না কেন, এই প্রাকৃতিক বিপদকে নির্মূল করা অসম্ভব। অতীতের মতো বর্তমানেও এদেশের মানুষকে বন্যার সঙ্গে লড়াই করেই বেঁচে থাকতে হচ্ছে।
ফলে এই প্রাকৃতিক বিপদের চাপ সরাসরি কৃষক ও কৃষি ব্যবস্থাকে আক্রান্ত করে। গ্রামাঞ্চলের অবকাঠামো ও যোগাযোগ ব্যবস্থাকে বহুলাংশে বিনষ্ট করে। এমতাবস্থায় কৃষি ও কৃষকদের পাশে দাঁড়ানো অপরিহার্য।
আমার কর্মক্ষেত্র কিশোরগঞ্জের উদাহরণ দিয়ে সমস্যাটির গভীরতা তুলে ধরা যেতে পারে। বলাবাহুল্য, দেশের সকল বন্যা কবলিত এলাকার চিত্রে কিছুটা তারতম্য থাকলেও মূলত অভিন্ন।
কৃষিনির্ভর ও হাওরাঞ্চলীয় কিশোরগঞ্জ জেলা করোনার অন্যতম প্রধান ক্ষেত্র হিসেবেও চিহ্নিত হয়েছে। ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী, সাভারের পর করোনা বিস্তারে কিশোরগঞ্জের পরিস্থিতি মারাত্মক। এখন পর্যন্ত জেলার ১৩ উপজেলায় এক হাজার ৬১০ জনের শরীরে ধরা পড়েছে করোনা। এর মধ্যে সুস্থ হয়েছেন এক হাজার ১৩৬ জন। মারা গেছেন ২৪ জন।
এদিকে করোনার বিপদের মধ্যেই জেলার তিনটি হাওরাঞ্চলীয় উপজেলা, যথা, ইটনা, মিঠামইন, অষ্টগ্রামে বন্যার পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে। বৃহত্তর সিলেটের পার্শ্ববর্তী এই তিন উপজেলা পুরো জেলার দুই-তৃতীয়াংশ জায়গা নিয়ে পরিগঠিত এবং সম্পূর্ণভাবে কৃষিনির্ভর। এদের মধ্যে সবচেয়ে মারাত্মক অবস্থা মিঠামইনের। সেখানে বিভিন্ন হাওর ও নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। অন্তত ১০টি পুকুর তলিয়ে মৎস্য চাষের বিরাট ক্ষতি হয়েছে এবং বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রতিরক্ষা দেয়াল, স্থাপনা এবং সড়ক-বেড়িবাঁধ হুমকির মুখে পড়েছে।
এমনকি, ১১ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণাধীন ঘাগড়া-কেওয়ারজোড় অলওয়েদার সড়কের বিভিন্ন স্থানে পানির প্রবল চাপে ফাটল ধরে রাস্তা ভেঙ্গে পানি চলাচল করছে। অনেক সরকারি অফিসও পানিতে তলিয়ে গেছে।
এমতাবস্থায় কৃষকদের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছে। তাদের চাষের জমি, বীজতলা, ঘরবাড়ি বিনষ্ট হওয়ার মতো শোচনীয় অবস্থায় সুদের কারবারি ও দাদন ব্যবসায়ীরা সুযোগ নিচ্ছে। এই চক্রের খপ্পরে সর্বস্ব হারিয়ে অনেক পরিবারই এখন পথে বসার উপক্রম।
বাংলাদেশের সকল গ্রামেই আর্থিক অনটন ও মূলধনের অভাব একটি সাধারণ চিত্র। যে সুযোগ নেয় একদল অসাধু ব্যবসায়ী ও এনজিও। সরকারের নানা বরাদ্দ ও ঋণ অধিকাংশ সময়েই আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও অন্যান্য বিঘ্নের কারণে কৃষকের হাত পর্যন্ত পৌঁছায় না।
ঋণের মতোই কৃষকের জন্য সার, বীজ, কীটনাশক ও অন্যান্য সরকারি সাহায্য ও প্রণোদনা কখনোই সঠিকভাবে বণ্টিত হয় না। রিলিফ ও খয়রাতি সাহায্যের ক্ষেত্রও রয়েছে বিস্তর অনিয়ম।
বিদ্যমান দুর্যোগময় পরিস্থিতিতে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে এসব বিষয় অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে মনিটরিং করা এখনই কর্তব্য। কারণ, করোনার আক্রমণের কারণে মানুষ গৃহবন্দি হয়ে আর্থিক দিক দিয়ে অনেক পিছিয়ে গেছে। ক্ষুদ্র কৃষক, কৃষি শ্রমিক, খেতমজুর প্রভৃতি প্রান্তিক পেশার লোকজনের আয়-রোজগারে ভাটা পড়েছে। বন্যার আক্রমণেও যদি তারা প্রয়োজনীয় সাহায্য-সহযোগিতা সঠিকভাবে না পায়, তাহলে এই বিশাল জনগোষ্ঠীকে নিঃস্ব ও দরিদ্রের কাতারে এসে শামিল হতে হবে, যা দেশের মানব উন্নয়ন ধারাকে ব্যাহত করবে।
সন্দেহ নেই, পুরো বিশ্বের মতো বাংলাদেশও করোনার কারণে বিপদে রয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের কৃষক সম্প্রদায় রয়েছে প্রাকৃতিক বিপদ তথা বন্যার মতো আরও একটি ভয়ানক বিপদে। উভয়বিধ বিপদ সামলানোর মতো সঙ্গতি এইসব নিম্নবিত্ত ও দরিদ্র মানুষদের নেই।
তদুপরি, দেশের খাদ্য উৎপাদনের সচল চাকাকে অব্যাহত রাখতে হলে কৃষক শ্রেণি ও কৃষি ব্যবস্থাকে নানামুখী বিপদ থেকে বাঁচাতে হবে। সরকারের নীতি ও পরিকল্পনায় এই বিষয়টি গুরুত্ব পাওয়ার দাবি রাখে।
বিশেষত চলমান করোনার বিপদের সঙ্গে এখন ক্রমবর্ধমান বন্যার কারণে গ্রাম ও কৃষি দ্বিমুখী বিপদে আক্রান্ত। করোনা বিপর্যস্ত কৃষক নিপতিত হয়েছে বন্যার মতো আরও একটি প্রলয়ঙ্করী বিপদের মুখে। এই অবনতিশীল পরিস্থিতি চরম আকার ধারণ করার পূর্বেই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিয়ে বিপর্যস্ত কৃষকদের বাঁচাতে হবে।
আশরাফুল ইসলাম: লেখক-সাংবাদিক।