মারায়ন তং চূড়া থেকে ফিরে: কোনোভাবেই ফসকানোর সুযোগ নেই! ১০ মিনিট অন্তর অন্তর তিন ধাপের অ্যালার্ম ব্যবস্থা। একটায় ঘুম না ভাঙলে আরেকটা। সূর্যদেব দেখা দেওয়ার আগেই হাজির থাকতে হবে। মারায়ন তং পাহাড়ের পুবপাশ ঘিরে ভিড় করবে মেঘদল। মেঘের ভেলায় ভেসে যাবো যতদূর মন চায়..
মারায়ন তং মিরিঞ্জা রেঞ্জের একটি পাহাড়। পূর্বপাশজুড়ে চিম্বুক রেঞ্জ। এই কুলে মিরিঞ্জা আর ওইকুলে চিম্বুক, মাঝখানে মাতামুহুরী নদী ওই বয়ে চলে যায়। নদীর উপরের ফাঁকা জায়গাজুড়ে জড়ো হয় রাশি রাশি তুলোর মতো মেঘ। মারায়ন তংয়ের চূড়ায় দাঁড়িয়েই ছোঁয়া যায়! এরপর আলো ফোটার পর ধীরে ধীরে মিলিয়ে যায় আকাশের কোলে।
এই সুযোগ থেকে নিজেকে বঞ্চিত করলে চলে? একদমই না! মারায়ন তং পাহাড় রোমঞ্চকর খাড়া ট্রেইল আর ক্যাম্পিংয়ের জন্য বিখ্যাত হলেও ভোরবেলা মেঘের রাজ্যে ভাসা আরেক আকর্ষণ। গতদিনের ট্রেকিং ক্লান্তি, সেইসঙ্গে রাতভর আড্ডা-গান-গল্প আর জোছনাস্নানের পর তাঁবুর ভেতর শরীর পড়তেই ঘুম একেবারে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলেছিল। তবু মেঘের কাছে ঘুমের পরাজয় তো হতেই হবে। এজন্যই এমন নিশ্ছিদ্র ব্যবস্থা!
ভেবেছিলাম, মোটামুটি সবারই শরীরজুড়ে ক্লান্তি আর চোখজুড়ে ঘুম, কজনই বা উঠবে! ভুল ভাঙলো তাঁবু থেকে বেরিয়েই। দু-একজন বাদে প্রায় সবাই সূর্যকে নমস্কার জানাতে প্রস্তুত। অল্প যে কয়েকজন তাঁবুর ভেতরে, তারাও নিচ্ছে বেরনোর প্রস্তুতি। যে যার মতো ক্যামেরা-স্মার্টফোন নিয়ে প্রস্তুত। মেয়েরা শাড়ি পড়ে টিপটপ। চূড়ার পুব-দক্ষিণ কোণার দিকে ভিড় বেশি বলে গেলাম উত্তর-পুবের দিকটায়। আধো আধো ঘুম চোখে ক্যামেরা চালু করতেই কানে আসে, ‘ভাই, আরেকটু পিছনে দাঁড়ান, ফ্রেমে আসতেছেন’। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি ড্রোন, গো-প্রো, ডিএসএলআর, ডিজিটাল ক্যামেরাসহ সবাই হাজির। তখনও আঁধার কাটেনি, তাই খেয়াল করিনি লতা-পাতার ভেতর এতজন বসে আছে!
ধীরে ধীরে লাল-কমলা আভা প্রকট হয়। ছোটবেলায় বহুল পঠিত ট্রান্সলেশন ‘সূর্য পূর্ব দিকে উদিত হয় এবং পশ্চিম দিকে অস্ত যায়’-এর প্রথম অংশ আরেকবার নতুন করে উপলব্ধি করি। কিন্তু সবার একটাই প্রশ্ন, মেঘ কই? এ ওর মুখের দিকে চায়। গাইড কাম ক্যাম্পিং সহকারী গতকালও অন্য একটি দলকে ঘুরিয়ে নিয়ে গেছেন। ঘন মেঘ ছিল তখন। একই কথা ট্রাভেল অরগানাইজারেরও। তারা বিস্মিত, আমরা হতাশ!
মারায়ন তং চূড়াকে সোনা দিয়ে মুড়িয়ে দেওয়ার মতো রোদ হয়। দেখি, নানা রঙের মেঘ আকাশের কোলে বসে ভেংচি কাটছে। রোজই পাজি মেঘ মাতামুহুরির উপর দিয়ে গাভীর মতো চরে বেড়ায়। ঠিক আজই আমাদের ফাঁকি দিতে হলো! প্রকৃতির পরিহাস বোঝা বড়ই মুশকিল।
মেঘ ছুঁতে না পারার বেদনা সবার মধ্যেই কম-বেশি ছড়ালো। তবু যা আছে তাকে সম্বল করেই আবার আনন্দে মেতে উঠলো সবাই। চললো তুমুল ছবি তোলাতুলি। ফিরে গিয়েই ফেসবুক-ইনস্টাগ্রাম রঙিন হয়ে উঠবে সবার। এক ফাঁকে অরগানাইজার জানিয়ে গেলো, একটু পর নামতে হবে। নিচে গিয়ে খেয়েদেয়ে বেরোতে হবে দুর্ধর্ষ আলীর গুহা অভিযানে। দেখতে দেখতে তাঁবু গুটিয়ে এলো। হ্যামোক নামলো বটের শাখা থেকে। সবশেষে ব্যাগ কাঁধে ওঠার আগে হুল্লোড় করে তোলা হলো গ্রুপ ছবিও।
আরও পড়ুন:মারায়ন তং চূড়ায় জোছনাস্নান (১ম পর্ব)
খাড়া পাহাড়ে ওঠা যেমন কষ্ট, নামা তেমনি সহজ, তবে বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। পা হড়কালেই কেল্লা ফতে! এজন্য নামার সময় সঙ্গী হলো লাঠি। পিঠে ব্যাগ, লাঠিতে ভর দিয়ে দিয়ে যে পথ দিয়ে এসেছিলাম সেই পথ দিয়ে নামা। এবার আর হাঁটার ক্লান্তি নেই তাই পাখির গান আরও সুমধুর। কলাপাতা দুলে দুলে ওঠে। শিমলতা এঁকেবেঁকে পথ এগিয়ে দেয়। সেগুন পাতায় ঝলমল রোদ আরও সুন্দর লাগে। জীবন সুন্দর তাই সুন্দর সঙ্গে করে নিয়ে যেতে হয়..
মারায়ন তং পাহাড়ে কীভাবে যাবেন
ঢাকা থেকে আলীকদম সরাসরি বাস যায়। নামতে হবে আবাসিক রাস্তার মাথায়। এখান থেকেই যাত্রা শুরু। বিভিন্ন কোম্পানির বিভিন্ন রকম বাস রয়েছে। ভাড়া ৮৫০ টাকা থেকে শুরু। রাত ৮-১০টার মধ্যে বাসগুলো ঢাকা থেকে ছেড়ে যায়, পৌঁছায় সকালে।
কোথায় থাকবেন
মারায়ন তং পাহাড়ে মূলত সবাই যায় ক্যাম্পিং করার জন্য। কাজেই সেটি মাথায় রেখে পরিকল্পনা করাই ভালো। এছাড়াও কোনো প্রয়োজনে আলীকদম থাকতে হলে সরকারি-বেসরকারি বাংলো বা হোটেল মিলবে।
প্রয়োজনীয় পরামর্শ ও সতর্কতা