ছবির মতো সাজানো গোছানো ভারতের একটি প্রদেশ, যার নাম সিকিম। সিকিম সম্পর্কে যখনই জানতে পারি তখন থেকেই সিকিম যাবার স্বপ্ন দেখি। কিন্তু সিকিমে বাংলাদেশীদের প্রবেশাধিকার না থাকায় সিকিম যাওয়া আগে কখনো সম্ভব হয়নি। পরে যখন ২০১৮ সালের নভেম্বর থেকে সিকিমে বাংলাদেশীদের প্রবেশাধিকার দেয়া হয় তখন থেকেই সিকিম যাওয়ার পরিকল্পনা করতে থাকি। আজকে আপনাদের সাথে আমার সিকিম ভ্রমণের অভিজ্ঞতা বিনিময় করবো।
২০১৯ সালের ১৬ নভেম্বর রাত ৮ টার সময় আমি আর আমার সহকর্মী জাহিদ ভাই মিলে শ্যামলী পরিবহনে চড়ে বসলাম শিলিগুড়ি হয়ে সিকিমের উদ্দেশ্যে। আমাদের দুজনেরই আগেই ভারতের ভিসা নেয়া ছিলো এবং আগেই ট্রাভেল টেক্স জমা দিয়ে টোকেন নিয়ে রেখেছি। সারারাত ভ্রমণ শেষে ১৭ নভেম্বর সকালে পৌঁছালাম বুড়িমারী স্থলবন্দর। ফ্রেশ হয়ে বুড়িমারীর প্রখ্যাত বুড়ির দোকানে নাস্তা সেরে নিদ্দিষ্ট সময়ে ইমিগ্রেশন শেষ করে ভারতে চ্যাংড়াবান্ধা থেকে শিলিগুড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। চ্যাংড়াবান্ধা থেকে ডলার এক্সচেঞ্জ করে নিলাম, এখানে শিলিগুড়ি বা গ্যাংটকের চেয়ে ভালো রেট পাওয়া যায়।
দুপুর সাড়ে বারোটায় পৌঁছালাম শিলিগুড়ি। প্রথমে আমরা যোগাযোগের জন্য একটা সিম কিনলাম। তারপর লাঞ্চ সেরে দার্জিলিং টেক্সিস্ট্যান্ড থেকে একটি ছোট টাটা অল্টো গাড়ি ১৮০০ রুপিতে গ্যাংটক এমজি মার্গ পর্যন্ত ভাড়া করলাম, গাড়িটি সিকিমের হওয়ায় এতো কমে প্রাইভেট টেক্সি পেলাম। ভাড়া করার সময় আমার ড্রাইভারকে বলে নিয়েছি রাংপোতে ইনার লাইন পারমিট (ওখচ) নিতে থামার কথা। দুপুর আড়াইটার সময় শিলিগুড়ি থেকে আমাদের গাড়ি যাত্রা শুরু করলো গ্যাংটকের উদ্দেশ্যে।
ছোট্ট শিলিগুড়ি শহর, ক্যান্টনমেন্ট, সেভক এরিয়া পাড়ি দিয়ে গাড়ি চলছে তিস্তা নদীর পাড় ঘেঁষা সড়ক ধরে। তিস্তার নীলচে পানির সৌন্দর্যে প্রাণ জুড়িয়ে গেল। নদীর মতই এঁকেবেঁকে রাস্তা চলে গেছে, সে রাস্তা ধরে আমাদের গাড়ি ছুটছে। পিচঢালা মসৃণ সড়ক, খানাখন্দক খুবই কম। আশেপাশের দৃশ্য বদলাচ্ছিল একটু পরপরই। কখনো পাহাড়ের সারির পাশ দিয়ে ছুটছি, সাথে ঘন গাছপালা। আবার কখনো পাহাড়গুলো দূরে সরে যাচ্ছিল, সামনে চলে আসছিল গাছের সারি আর ঘন ঘাসের জমি।
এখানে বলে রাখছি আমার সিকিম ভ্রমণের জন্য দেশ থেকে দশ কপি করে ছবি ও সর্বশেষ ভিসাসহ পাসপোর্টের কপি সাথে নিয়ে রেখেছি। কারণ সিকিমের যেকোনো জায়গায় ভ্রমণের জন্য বিদেশী পর্যটকদের ইনার লাইন পারমিট (ওখচ) ও রেষ্ট্রিকটেড এরিয়া পারমিট (জঅচ) নিতে হবে ছবি ও পাসপোর্টের কপি প্রয়োজন হয়। সিকিম থেকে ফিরার সময়ও আবার রাংপোতে অবহিত করতে হয়। মজার বিষয় হচ্ছে সিকিম প্রবেশের সময় ও ফিরার সময় পাসপোর্টে সিল দেয়া হয়।
ইনার লাইন পারমিট দিয়ে আপনি শুধু সিকিম শহর ভ্রমন করতে পারবেন। সিকিমের অন্যান্য যায়গা ভ্রমন করতে হলে আপনাকে রেষ্ট্রিকটেড এরিয়া পারমিট নিতে হবে, যা শুধু সিকিমের অনুমোদিত ট্যুর এজেন্ট থেকে ট্যুর প্যাকেজ নেয়ার মাধ্যমে নিতে পারবেন। ট্যুর এজেন্ট আপনাদের রেষ্ট্রিকটেড এরিয়া পারমিট ব্যবস্থা করে আপনাদের প্যাকেজ অনুযায়ী ঘুরাবে। তবে অনেক সময় গাড়ির ড্রাইভারই গাইড হিসেবে কাজ করে।
শিলিগুরি থেকে গ্যাংটক যেতে প্রায় ৪ ঘন্টার মত সময় লাগে। আকাবাঁকা পাহাড়ি পথ ও তিস্তা নদীর সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে রাস্তায় একটি চা বিরতি দিয়ে কখন যে রাংপো চেকপোস্ট পৌঁছে গেলাম বুঝতেই পারলাম না। প্রায় তিনঘন্টার মতো লাগলো রাংপোতে পৌছাঁতে। রাংপোতে আমাদের অভ্যর্থনা জানালো বিশাল এক ঐতিহ্যবাহী ফটক। ওপরে সবুজ চৌচালা, দু’পাশে কলাম, কলামের গায়ে রংবেরঙের নকশাকাটা কারুকার্য, যা সিকিমের স্বকীয় বৈশিষ্ট্য। রাংপো চেকপোস্ট থেকে পাসপোর্ট ও পারমিট পেপারে এন্ট্রি সিল নিতে প্রায় ২০ মিনিটের মত লাগলো, প্রায় ২০/২১ জনের মতো ট্যুরিস্ট ছিলো। এখান থেকে পারমটি না নিলে গ্যাংটক গিয়ে কোন হোটেলেই থাকতে পারবেন না এবং কোথাও ঘুরতেও পারবেন না।
আমরা পারমিশনের কাগজ ও পাসপোর্টে সিল নিয়ে আবার গ্যাংটকের উদ্দেশ্যে রওনা হই এর মধ্যেই সন্ধ্যা হয়ে আঁধার ঘনিয়ে এসেছে, আশপাশের সুউচ্চ পাহাড়ী বসতির বৈদ্যুতিক আলোগুলো জ্বলে উঠেছে, মনে হচ্ছে আকাশে সারি সারি তারা জ্বলছে, সে এক অসাধারণ অনুভূতি যা বলে প্রকাশ করা যাবে না। প্রায় সোয়া এক ঘন্টার মধ্যেই আমরা গ্যাংটক (এমজি মার্গ) পৌঁছে যাই, ঘড়ির কাঁটায় তখন প্রায় সন্ধ্যা সাতটার কিছু বেশি। গাড়ি থেকে নামতেই বেশ ঠান্ডা আমাদের চারদিক থেকে ঘিরে ধরে, তাপমাত্রা ১৫ ডিগ্রী সেলসিয়াস। এবার হোটেল নেয়ার পালা, আমরা কয়েকটা হোটেল দেখা শেষে এমজি মার্গের রেডপান্ডা স্ট্যাচুর পাশেই হোটেল বায়ুলে উঠলাম। আমরা ২ জনের জন্য ১টা রুম নিলাম, যার ভাড়া পড়েছিলো ১৪০০ রুপি।
হোটেলে উঠেই ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে পড়ি পরের দিনের নর্থ সিকিমের (লাচুং ও ইয়ামথান) ট্যুর প্যাকেজ বুকিং ও রাতের খাবার খাওয়ার জন্য। হোটেলের একদম নিকটে এমজি মার্গ থেকে লালবাজারের দিকে নামার মুখেই ঠাকুর এন্ড ব্রাদার্স ট্যুরস এন্ড ট্রাভেলসে গেলাম। সেখানে দেখি চট্টগ্রাম থেকে আসা বাংলাদেশী এক দম্পতিও পরের দিন লাচুং ও ইয়ামথান ভ্রমণের জন্য প্যাকেজ খুঁজতে এসেছেন। পরিচয়ের পর উনারা আমাদের সাথে লাচুং ও ইয়ামথান ভ্রমণের জন্য আগ্রহ প্রকাশ করলেন। তখন ৪ জন একসাথে একটা মাহিন্দ্র স্কোরপিও জীপসহ দুইদিনের যাওয়া আসা, থাকা খাওয়া, রেস্ট্রিকটেড এরিয়া পারমিট (জঅচ) নেয়া, ইয়ামাথান ভ্যালী ও লাচুং জিরো পয়েন্ট বেড়ানো সহ ১৬০০০ রুপিতে প্যাকেজ বুকিং দিলাম।
গ্যাংটকে রাত ৮ টার মধ্যেই প্রায় সব দোকানপাট বন্ধ হয়ে যায়, তার আগেই একটি রেষ্টুরেন্টে চিকেন কারি দিয়ে ভাত খেয়ে নেই। এরপর শুরু হয় মুসলিম হোটেলের সন্ধান। লাল মার্কেট দিয়ে একটু সামনে গেলে মিলবে জান্নাত হোটেল ও আসলাম বিরিয়ানি। অনেক দেশি বিদেশী পর্যটকের পদচারণায় মুখরিত গ্যাংটক শহরের এই প্রাণকেন্দ্র এমজি (মহাত্মা গান্ধী) মার্গ, আইনশৃখংখলা পরিস্থিতি খুব চমৎকার, ক্রাইম নেই বললেই চলে। কিছুক্ষণ এমজি মার্গে ঘুরে মহাত্মা গান্ধীর স্ট্যাচু ও রেডপান্ডা স্ট্যাচুর পাশে ছবি তুলে ফিরে এলাম হোটেলে। এবার ঘুমাবার পালা, পরদিন আবার সফর শুরু হবে।
পরদিন ১৮ নভেম্বর সকালে ঘুম থেকে উঠে জানালা দিয়ে বাইরে তাকাতেই পাহাড়ের গায়ে গড়ে উঠা গ্যাংটক শহরের দৃশ্য দেখতেই মনটা চনমনে হয়ে উঠলো। মনের মধ্যে তখন অদ্ভূত এক অনুভূতি। ছোটবেলায় বই পড়ে যে ছবি এঁকেছি মনের মধ্যে, আজ সে ছবি বাস্তব হয়ে চোখের সামনে! সকালের অসাধারণ এমজি মার্গ দেখে কিছু ছবি তুললাম। তারপর ফ্রেশ হয়ে ব্রেকফাস্ট সেরে সাড়ে নয়টার সময় হোটেল থেকে চেকআউট হয়ে বেরিয়ে পড়লাম ভাজারা টেক্সি স্ট্যান্ডের উদ্দেশ্যে।
মূলত এখান থেকেই লাচুং-ইয়ামথান প্যাকেজের গাড়িগুলো ছেড়ে যায়। লোকাল একটা টেক্সিতে জনপ্রতি ২০ রুপিতে পৌঁছে গেলাম সেখানে। কিছুক্ষণের মধ্যে আমাদের অন্য দুই সহযাত্রী দম্পতিও হাজির। আমাদের ড্রাইভারকে ফোন দিতেই সেও হাজির, আমাদেরকে ছোট্ট একটা ব্রিফ করে নিয়ে চললো জীপের কাছে। এই দুদিনের জন্য সে আমাদের ড্রাইভার কাম গাইড, আমাদের সবগুলো লাগেজ ও ব্যাগ গাড়িতে তুলে প্রায় সাড়ে দশটার দিকে আমরা নর্থ সিকিমের (লাচুং) উদ্দেশ্যে রওনা করলাম।
পথে কিছু যায়গা সাইটসিয়িং করি- রাংরাং ব্রীজ, নাগা ফলস, মেয়ং ফলস, সেভেন সিস্টারস ফলস, তুং ব্রীজ, অমিতাভ বচ্চন ফলস, চুংথাং ভিউ পয়েন্ট ও তিস্তা নদীতে চুংথাং হাইড্রো ইলেকট্রিক পাওয়ার প্লান্ট, পাহাড়ী টানেল সড়ক, সহ আরো কয়েকটা পয়েন্ট সবগুলো এখন মনে পরছে না। পথে আমরা প্যাকেজে অন্তর্ভুক্ত দুপরের খাবার খেয়ে ছিলাম ভাত, ডাল, চিকেন কারি। বিকেলে চায়ের বিরতি ছিলো চুংথাং ভিউ পয়েন্টে। আকাঁবাকাঁ পাহাড়ী পথের অপরূপ দৃশ্য দেখতে দেখতে লাচুং পৌঁছাতে সন্ধ্যা হয়ে যায়। লাচুং পৌঁছে ড্রাইভার আমাদের নিয়ে যায় প্যাকেজ অর্ন্তভুক্ত হোটেল হিডেন গ্লেসারে। আমরা হোটেলে উঠে হালকা ফ্রেশ হতেই পরিবেশন করে চা বিস্কিট।
আমারা চা বিস্কিট খেয়ে প্রচন্ড ঠান্ডার মধ্যেই বেরিয়ে পড়ি রাতের ছোট্ট লাচুং শহরটা দেখার জন্য। তাপমাত্রা তখন প্রায় মাইনাস দুই ডিগ্রী, সাথে হীম বাতাস। স্বল্প সময়ে যা দেখলাম তাতে ছোট্ট লাচুং শহরটা আমার কাছে অসাধারণ লেগেছে। কিন্তু এখানে যে পরিমান ঠান্ডা তাতে বেশিক্ষণ টিকতে পারলাম না তাই হোটেলে চলে আসলাম। এখানে আমাদের বাংলাদেশী ও কলকাতার কিছু মানুষ পেয়ে তাদের সাথে কিছুক্ষণ আড্ডা দিলাম। ইতিমধ্যে আমাদের রাতের খাবার রেডি হয়ে গেল সবাই খেয়ে নিলাম। ড্রাইভার আমাদের বলে রাখে সকাল ৭ টার মধ্যে রেডি থাকতে। তাই আমরা খাবার খেয়ে রুমে গিয়ে ৩ টা কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে পরলাম ঠান্ডা থেকে বাঁচার জন্য। প্রচন্ড ঠান্ডা ছিল, শেষ রাতে তাপমাত্রা মাইনস ছয় ডিগ্রীতে নেমেছিল, নভেম্বর মাস হওয়ায় তখনো তুষারপাত শুরু হয়নি।
প্রচন্ড ঠান্ডায় ১৯ নভেম্বর খুব ভোরে আলো আসার আগেই ঘুম থেকে উঠে পড়লাম। ঘুম থেকে উঠে বাইরে যেতেই লাচুংয়ের অপরূপ রূপ দেখে মনটা জুড়িয়ে গেল। হিমালয়ের পূর্ব সীমার অর্ন্তগত বিশাল বিশাল পাহাড় পর্বত চারিদিকে, সেগুলোর উপরের দিকে বরফ আচ্ছাদিত, সে যে কি অপূর্ব দৃশ্য তা নিজে চোখে না দেখলে বলে বোঝানো যাবেনা। বরফে ঢাকা চূড়াগুলোতে মেঘের ছোঁয়াছুঁয়ি খেলা, যেন এক অপার্থিব দৃশ্যের অবতারণা। হিম বাতাসের শোঁ শোঁ শব্দ যেনো ছন্দময় সুর ছড়িয়ে দিচ্ছে চারিদিকে।
ধীরে ধীরে পূবাকাশে সূর্য উঁকি, বিপরীত দিকের পর্বতের চূড়াগুলোতে সূর্যের সোনালী আভা আছড়ে পড়তেই এক মনভোলানো দৃশ্যের দেখা মিললো, মনে হচ্ছে পর্বতের চূড়ায় উজ্জ্বল সোনালী দ্যুতি। এ যেন এক স্বর্গীয় সাজে সেজেছে প্রকৃতি! কিছুক্ষন ঘুরাঘুরি করে হোটেলে ফিরে আমরা ৭ টার মধ্যে আমরা রেডি হয়ে নেই এবং যথাসময়ে আমাদের ড্রাইভার গাড়ি স্টার্ট করে দিলো ইয়ামথাং ভ্যালি ও জিরো পয়েন্টের উদ্দেশ্যে। পথে ইন্ডিয়ান আর্মির চেকপোস্টে আমাদের পারমিট চেক করে।
লাচুং থেকে পাহাড়ী সর্পিল পিচঢালা পথে ইয়ামথান ভ্যালীর দূরত্ব মাত্র ২৩ কিলোমিটার। এই উপত্যকা শীতকালে পুরোপুরি ঢেকে যায় শ্বেতশুভ্র বরফের চাদরে, তখন তার অন্য এক রূপ দেখা যায়। বাকি সময় সবুজ ঘাসের কার্পেটে মোড়া এই উপত্যকা, আর নীলরঙা তিস্তা নদীর বয়ে চলা মুগ্ধ করে ভ্রমণপিপাসুকে। ইয়ামথান ভ্যালী ফুলের সাম্রাজ্য হলেও নভেম্বরে ফুলের সম্ভাষণ পেলাম না। কিন্তু পুরো ভ্যালী শীতের আগমনের কারণে ধীরে ধীরে রূপ বদলানোতে ব্যস্ত। ভ্যালী জুড়ে পর্যটকদের বিশ্রাম নেয়ার জন্য স্থায়ীভাবে বেশ কিছু আসন পেতে রাখা হয়েছে। পথের ধারে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা সারি সারি পাইন গাছ, নাম না জানা পাহাড়ী ফুল। যাত্রাপথের প্রতি বাঁকে সুউচ্চ পাহাড়গুলো একটাই ইঙ্গিত দেয়- সৃষ্টিকর্তাই শ্রেষ্ঠ শিল্পী।
প্রায় সাড়ে আটহাজার ফুট উঁচু শহরের উপর তিন-চার হাজার ফুট উচ্চতার একেকটি পর্বত দাঁড়িয়ে আছে নিরহংকারী হয়ে। কোনোটির চূড়ায় বরফের আচ্ছাদন, আবার কোনোটির গায়ে সবুজের প্রলেপ, কোনোটি আবার ন্যাড়া হয়ে একটু গোমড়ামুখো। কোনো পাহাড় সূর্যকে আড়াল করতে ব্যস্ত, কোনোটি আবার সূর্যের আলোর প্রতিফলন আর প্রতিসরণের সূত্র মেনে স্বমহিমায় উদ্ভাসিত। প্রতিটি পাহাড় তার নিজস্বতায় অনন্য। পথের দুধারে পাইন গাছের সারি, বিভিন্ন পাহাড়ি ফুল বাড়িয়ে তুলেছে অপরূপ শোভা। ইয়ামথান যাওয়ার পথে একটি স্থানে আমাদের গাড়ি সকালের নাস্তার জন্য বিরতি দিয়েছিলো, যা আমাদের প্যাকেজভুক্ত ছিলো। এখান থেকে সবাই গামবুট ভাড়া করেছি জিরো পয়েন্ট গিয়ে বরফে হাঁটার জন্য।
আমরা আবার ইয়ামথান উপত্যকা থেকে জিরো পয়েন্টের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। চীন সীমান্তের কাছাকাছি বলে সাধারণ পর্যটকদের এই পর্যন্তই যাওয়ার অনুমতি মেলে। প্রায় সাড়ে পনের হাজার ফুট উচ্চতায় অবস্থিত জিরো পয়েন্টের অনাবিল প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নজর কাড়বেই। যারা গেছে তারা জানে যে এই পথের দৃশ্য ভাষায় বর্ণনা করা কঠিন। যত উঠছি চারদিকের পর্বতগুলোর গা সাদা শুভ্র বরফের চাদরে আচ্ছাদিত, পাদদেশে এখনো বরফ জমেনি। আমরা চীন সীমান্তের কাছাকাছি জিরো পয়েন্টে পৌঁছালাম, মনে হলো পর্বতের চূড়ায় পৌঁছে গেছি। গাড়ি থেকে নেমে পাহাড়ের পাদদেশ ধরে পর্বতের বরফের দিকে হেটে চললাম। তবে পাদদেশ পর্বতের বরফগলা পানিতে ভেজা, সাবধানে পা ফেলতে হয়, যদিও আমাদের বরফে হাঁটার গামবুট থাকাতে কোনো সমস্যা হয়নি।
তিস্তা নদীর উৎপত্তিস্থল এই স্থানটি, পাহাড়ী ছোট ছড়ার মধ্যে দিয়ে এই বরফগলা পানি প্রবাহিত হয়ে তিস্তা নদীর জন্ম দিয়েছে। ছড়াটির উপর কাঠের পাটাতন দিয়ে বেশ কয়েকটি সাঁকো বানানো আছে। সাঁকো পার হয়ে আমার বরফের কাছে চলে এলাম। জীবনে প্রথম প্রাকৃতিক ভাবে মাটিতে জমে থাকা বরফ দেখা ও ছোঁয়ার অভিজ্ঞতা, সে এক অসাধারণ ভালো লাগা। বরফের উপর শুয়ে, বসে, হেঁটে কিছু সময় কাটালাম ছবি তুললাম। স্বচ্ছ নীল আকাশ, শ্বেত শুভ্র বরফাচ্ছাদিত পর্বত, হিমেল হাওয়া। কনকনে ঠান্ডায় হাতের দস্তানা খুলে একমিনিট থাকাও দুষ্কর। চমৎকার কিছু মুহূর্ত স্মৃতি করে নিলাম। বেশ কিছুক্ষন সেখানে মজা করে গাড়ির দিকে এগুলাম ফেরার জন্য। প্রায় সাড়ে পনের হাজার ফুট উঁচু হওয়ায় এখানে অক্সিজেন স্বল্পতা রয়েছে, আমি কিছুটা সমস্যায় পড়েছিলাম, ইয়ামথান ফিরে আসার পর শ্বাস-প্রশ্বাস আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হলো।
অপরূপ দৃশ্যগুলো দেখতে দেখতে আমারা হোটেলে ফিরে এলাম। ফ্রেশ হয়ে দুপরের খাবার খেয়ে আমরা গ্যাংটকের উদ্দেশ্যে রওনা দেই। সন্ধায় পৌঁছালাম গ্যাংটক শহরে, ড্রাইভার আমাদেরকে হোটেলের সামনে নামিয়ে দিলেন। এবার আমরা উঠেছি হোটেল চাংলো চেনে, এটি আগের হোটেলের চেয়ে অনেক ভালো হোটেল, ভাড়াও কম ১২০০ রুপী, এটি এমজি মার্গের একটু পশ্চিমে নামনাম রোডে সিকিম লেজিসলেসিভ এসেম্বলি হাউজ ও রোপওয়ের ঢালুতে অবস্থিত।
আমরা রুমে প্রবেশ করে ফ্রেশ হয়ে বের হই এবং বেশ কিছুক্ষণ এমজি মার্গ ও লালবাজারে ঘোরাঘুরি করে এবং কিছু কেনাকাটা করে খান চাচা'স কিচেনে চিকেন বিরিয়ানি খাই, বিরিয়ানিটা খুবই সুস্বাদু ছিলো। খাওয়া শেষে আমরা হোটেলে ফিরে যাই এবং হোটেলের মালিকের সাথে পরের দিনের জন্য সাংগু লেকের প্যাকেজ নিয়ে কথা বলতেই সে আমাদের ৩৫০০ রুপিতে পারমিটসহ সাংগু ট্যুর প্যাকেজ ঠিক করে দিলো। প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ও কিছু অগ্রিম টাকা দিলাম। হোটেল মালিক জানিয়ে দিলেন সকাল সাড়ে আটটায় আমাদের সফর শুরু হবে। এবার রুমে গিয়ে ঘুমোবার পালা। ২০ নভেম্বর সকালে ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে নাস্তা করে তৈরী হয়ে নিলাম সাংগু লেক ভ্রমণের জন্য। যথাসময়ে গাড়ি হাজির, আমরা চড়ে বসলাম, যাত্রা শুরু হলো সাংগু লেকের উদ্দেশ্যে।
সাংগু যাওয়ার পথে চেক পোষ্টে আমাদের পারমিট চেক হয়। কিছুদূর যাওয়ার পর অনেকটা খাড়া পাহাড়ে খাজ কাটা পিচ ঢালা রাস্তা, নিচের দিকে তাকাতেই ভয় হচ্ছিল, তবু সবাই ভালোই মজা করছিলাম। মাঝে মাঝে রাস্তা ধসে যাওয়ার চিহ্ন রয়েছে, সেগুলো মেরামত হয়েছে। এভাবে কিছু চলার পর ফিফটিন মাইল নামক জায়গায় চলে আসি এবং এখানে স্বল্প সময়ের যাত্রা বিরতিতে সবাই নুডুলস স্যুপ খাই। তারপর আবার এগিয়ে চলা শুরু। সাংগুর রাস্তাটা লাচুংয়ের রাস্তার চেয়েও এডভেঞ্চারাস। সাংগু লেক পৌঁছে আমরা বিমোহিত। খুব সুন্দর স্বছ নীল পানির একটি লেক, প্রায় সাড়ে বারো হাজার ফুট উচ্চতায় সৃষ্টিকর্তার এক অপার্থিব নিদর্শন। ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারিতে এই লেকের পানি প্রচন্ড ঠান্ডায় বরফে রূপান্তরিত হয়। তখন সেখানে ভিন্ন আরেক রূপ তৈরী হয়। লেকের দু পাড়ে ঘোরাঘুরি করলাম ছবি তুললাম। লেকের পাড়ে একটি মন্দির রয়েছে।
পর্যটকদের আকর্ষণ বৃদ্ধির জন্য মন্দিরের পাশে অনেকগুলো পোষা চমরী গরু (ইয়াক) রেখেছে স্থানীয়রা, পর্যটকরা এগুলোতে চড়ে লেকের পাড়ে বেড়ায়, ছবি তোলে। একটি পর্বতের পাদদেশ থেকে ক্যাবল কারে করে পর্বতের চূড়ায় উঠে ঘুরে আসা যায়, আগেরদিন লাচুংয়ে অক্সিজেন সংকট অনুভব করায় অসুস্থ হওয়ার ভয়ে আজ ক্যাবল কারে উঠিনি। যতটুকু সৌন্দর্য দেখতে পাই তা মুখের ভাষায় পরিপূর্ণ ভাবে প্রকাশ করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। প্রায় ঘন্টা খানেক বেরিয়ে আবার গ্যাংটকের উদ্দেশ্যে রওনা হই এবং দুপরের মধ্যেই আমরা গ্যাংটক ফিরে আসি। ফিরে এসে আমরা আসলাম বিরিয়ানি থেকে বিফ বিরিয়ানি খেয়ে হোটেলে ফিরে রেস্ট নেই। বিকেল থেকে সন্ধ্যায় আমরা লালবাজারে ঘুরে কেনাকাটা করে রাতের খাবার খেয়ে হোটেলে ফিরে আসি। সিদ্ধান্ত নিলাম এই কদিনের ভ্রমণ ক্লান্তি দূর করতে আগামীকাল ঘুম না ভাঙা পর্যন্ত দীর্ঘ সময় ধরে ঘুমাবো।
পরদিন ২১ নভেম্বর সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি ঘড়িতে সাড়ে নয়টা। উঠে ফ্রেশ হয়ে নাস্তা সেরে বের হলাম। দু-তিন মিনিট হাঁটা দূরত্বে অবস্থিত সিকিমের লেজিসলেসিভ এসেম্বলি দেখে এলাম। ছোট্ট সুন্দর একটি এসেম্বলি ভবন, ২৫ জন সদস্য নির্বাচিত হয়ে আসেন। ভূমিপুত্র হিসেবে ভারতের সাবেক ফুটবল দলের অধিনায়ক বাইচুং ভুটিয়া সেখানে খুবই বিখ্যাত। পর্যটন বান্ধব একটি রাজ্য। এরপর গেলাম পাশেই অবস্থিত ক্যাবল কারে চড়তে। টিকিট কেটে সারিবদ্ধ লাইনে আমরা উঠে পড়লাম ক্যাবল কারে। ধীরে ধীরে ক্যাবল কার চলতে শুরু করলো, আর উম্মুক্ত হতে থাকলো পাহাড়ি রাজ্য সিকিমের গ্যাংটক শহর প্রকৃতি।
প্রতিটি পাহাড়ের গায়ে তৈরি ঘরবাড়ি গাছগাছালি খুব সুন্দর লাগছিলো। অপর প্রান্তের নিচে কারুকার্যময় একটি প্রজাপতি স্ট্যাচু দেখে আমরা ফিরে এলাম। স্বল্প সময়ে ভালো রোমাঞ্চকর রাইড। এবার আমরা গ্যাংটক সিটি ট্যুরের জন্য ১৫০০ রুপিতে একটি ট্যাক্সি ভাড়া করলাম। সিটি ট্যুরের অংশ হিসেবে আমরা হনুমানটক, গণেশটক, চিড়িয়াখানা (যদিও আমরা প্রবেশ করিনি), বোটানিক্যাল গার্ডেন, তাশি ভিউ পয়েন্ট, বাকতাং ওয়াটার ফল (এখানে জিপলাইনিং করেছি), রুমটেক মোনেস্ট্রি, সিকিম মিউজিয়াম ঘুরে এমজি মর্গে এসে খান চাচা'স কিচেনে লাঞ্চ সারলাম।
তারপর বিকেল অবধি কেনাকাটা সেরে হোটেলে ফিরে লাগেজ গোছালাম। রাতের খাবার খেয়ে এমজি মার্গে শেষবারের মতো ঘুরে হোটেলে ফিরে ঘুমিয়ে পড়লাম। পরদিন ফেরার পালা, ২২ নভেম্বর সকলে ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে নাস্তা সেরে হোটেল থেকে চেকআউট করে ২০০০ রুপিতে একটি টেক্সি ভাড়া করলাম শিলিগুড়ির বাগডোগরা এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে।
বাগডোগরা থেকে আমাদের কলকাতাগামী ফ্লাইট বিকাল ৩:৪০ এ, আর কলকাতা থেকে ঢাকার ফ্লাইট রাত সাড়ে নয়টায়। সিকিম ভারতের অন্যতম একটি পরিচ্ছন্ন রাজ্য, অপরাধ নেই বললেই চলে, স্থানীয়রা খুবই বন্ধুবৎসল ও পর্যটন বান্ধব। সৃষ্টিকর্তার অশেষ কৃপায় সুস্থ ভাবে, সুন্দর ও সঠিক পরিকল্পনায় সিকিম ভ্রমণ সম্পন্ন করেছি। সিকিমের অনন্য সুন্দর মুহূর্তগুলোর জন্য সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ।