মেজর হায়দার এবং ৭ নভেম্বরের নির্মম হত্যাযজ্ঞ

বিবিধ, ফিচার

ড. মাহফুজ পারভেজ, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর, বার্তা২৪.কম | 2023-09-01 18:05:14

 

১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১, বিজয়ের মুহূর্তে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা মেজর হায়দার। যুদ্ধজয়ী মেজর হায়দার পরাজিত পাক বাহিনীর কর্মকর্তাদের নিরাপত্তা দিয়ে আত্মসমর্পণ মঞ্চে নিয়ে যান।

কিন্ত স্বাধীন দেশে নিজের সেনাসদস্যদের কয়েকজনই তাকে হত্যা করেছিলো ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর। যিনি ছিলেন একজন “বীর উত্তম”। সেদিন আরও দুইজন বীর মুক্তিযোদ্ধা, মেজর জেনারেল খালেদ মোশাররফ এবং কর্নেল নাজমুল হুদা নির্মমভাবে নিহত হন।

বিজয়রথে ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে সর্বাগ্রে ঢাকায় প্রবেশ করেছিলেন বীরযোদ্ধা মেজর হায়দার। ছিলেন হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে। স্বাধীন ও মুক্ত বাংলাদেশের টেলিভিশন যার ছবি ও কণ্ঠস্বরের মাধ্যমে প্রথম জীবন্ত হয়েছিল, তিনি মেজর হায়দার।

একাত্তরে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী তাঁর কেশাগ্র স্পর্শ করতে পারেনি। কিন্তু স্বাধীন ও সার্বভৌম সেই রাষ্ট্রেই তাঁকে হত্যা করা হয়, যে রাষ্ট্র অর্জনের জন্য তিনি প্রবল বিক্রমে লড়েছিলেন ও লড়াই করিয়েছিলেন অগণিত দুঃসাহসী গেরিলা যোদ্ধাকে। অবরুদ্ধ ঢাকা শহরকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল তাঁর নেতৃত্বাধীন অকুতোভয় যোদ্ধারা।

মেজর আবু তাহের মোহাম্মদ হায়দার (এ,টি,এম, হায়দার) সকলের কাছে মেজর হায়দার নামেই সমধিক পরিচিত।কিশোরগঞ্জ শহরের খড়মপট্টি এলাকার

মো. ইসরাইল মিয়া ও হাকিমুন্নেসার পুত্র এটিএম হায়দারের জন্ম কলকাতা শহরের দক্ষিণাংশের ভবানীপুরে, ১৯৪২ সালের ১২ জানুয়ারি। দুই ভাই ও তিন বোনের মধ্যে হায়দারের স্থান দ্বিতীয়। তাঁদের আদিবাড়ি করিমগঞ্জ উপজেলায়।

বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী ছিলেন মেজর হায়দার। অভিজ্ঞতায় ছিলেন ভরপুর। পাবনা জেলার বীণাপানি স্কুলে প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণের পর ১৯৫৮ সালে কিশোরগঞ্জ রামানন্দ হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিক, ১৯৬১ সালে কিশোরগঞ্জ গুরুদয়াল সরকারি কলেজ থেকে আইএ এবং ১৯৬৩ সালে লাহোর ইসলামিয়া কলেজ থেকে বিএসসি পাস করেন তিনি।

লাহোরের পাঞ্জাব ইউনিভার্সিটি থেকে পরিসংখ্যানে এমএসসি প্রথম পর্ব সমাপ্তির পর সামরিক বাহিনীতে অফিসার পদে মনোনীত হন হায়দার। তিনি ১৯৬৫ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কমিশন লাভ করেন।

হায়দার প্রথমে কাকুলে ট্রেনিং নেন এবং কমিশন প্রাপ্তির পর গোলন্দাজ বাহিনীর অফিসার হিসেবে নিয়োজিত হন। চেরাটে এমএসজি (স্পেশাল সার্ভিস গ্রুপ) ট্রেনিংয়ে অত্যন্ত কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়ে একজন দক্ষ গেরিলা কমান্ডার হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। কমান্ডো ট্রেনিংয়ে ৩৬০ জনের মধ্যে মাত্র দুজন বাঙালি অফিসার ছিলেন, যার একজন হায়দার।

কমিশন প্রাপ্তির পর ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত তিনি তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের মুলতান ক্যান্টনমেন্টে কর্মরত ছিলেন। ১৯৬৯ সালের শেষের দিকে তৃতীয় কমান্ডো ব্যাটালিয়নের একজন ক্যাপ্টেন হিসেবে তাঁকে কুমিল্লা সেনানিবাসে পাঠানো হয়। ১৯৭১ সালের জানুয়ারিতে তাঁকে ঢাকায় নিয়ে আসা হয়। ১৫-২০ দিন পর পুনরায় কুমিল্লায় নিয়োগ করা হয়।

দেশের টানে মুক্তিযুদ্ধের আহ্বানে তিনি

১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ কুমিল্লা সেনানিবাস ত্যাগ করেন এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অফিসারদের সঙ্গে মিলিত হন। সেখান থেকে তিনি তেলিয়াপাড়া যান এবং কিছু সংখ্যক সৈন্যসহ বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করেন। তিনি ময়মনসিংহ-কিশোরগঞ্জ মহাসড়কসহ মুসল্লী রেলওয়ে সেতু বিস্ফোরকের সাহায্যে উড়িয়ে দেন।

এরপর তিনি মেলাঘরে সেক্টর কমান্ডার খালেদ মোশাররফের অধীনে সেকেন্ড কমান্ডার নিযুক্ত হন। ক্যাপ্টেন হায়দার মেলাঘরে ছাত্রদের নিয়ে একটি কোম্পানি গঠন করেন এবং গেরিলাদের কমান্ডো ও বিস্ফোরক বিষয়ক প্রশিক্ষণ দানের দায়িত্ব পালন করেন। সেক্টর-২ এর অধীনে পরিচালিত গেরিলা অপারেশনগুলো এবং তাঁর হাতে গড়া গেরিলাগণ উজ্জ্বলতম অবদানের সাক্ষ্য হিসেবে ইতিহাসের পাতায় জাজ্বল্যমান।  

১৯৭৫ সাল। স্বাধীন দেশের বয়স তখনো ৪ বছর হয়নি। ৬ নভেম্বর (১৯৭৫) বাবার টেলিগ্রাম পেয়ে পারিবারিক কাজে কর্মস্থল বান্দরবানের রামু থেকে ঢাকায় এসেছিলেন হায়দার। সেদিন সকালে পারিবারিক কাজের পর দুপুরে তিনি জেনারেল ওসমানী ও সেনাবাহিনীর কয়েকজন বন্ধুর সাথে দেখা করেন।

একই দিন সন্ধ্যায় তাঁর প্রিয় সেক্টর কমান্ডার এবং নতুন সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল খালেদ মোশাররফের সাথে তাঁর যোগাযোগ হয়। সে রাতে তাঁর সাথে বঙ্গভবনে যান তিনি। চেষ্টা করেন দেশের সঙ্কটময় পরিস্থিতির উত্তরণ করতে এবং হত্যা ও যড়যন্ত্রে চলমান ধারা থামাতে। কিন্তু কে জানতো, যড়যন্ত্রের মাধ্যমে তাঁকে ও তাঁর সহযোদ্ধাদের নির্মমভাবে হত্যা করা হবে!

৭ নভেম্বর চরম বিশৃঙ্খলা ও পরস্পর-বিরোধী বিদ্রোহের সৃষ্টির খবর পেয়ে জেনারেল খালেদ পরিস্থিতি সামাল দিতে কর্নেল হুদা ও কর্ণেল হায়দারকে সঙ্গে নিয়ে প্রথমে ব্রিগেডিয়ার নুরুজ্জামানের বাসায় যান। সেখান থেকে ভোর প্রায় ৩ টায় জেনারেল খালেদ, কর্নেল হুদা ও কর্ণেল হায়দার শেরেবাংলা নগরে অবস্থিত ১০ বেঙ্গল রেজিমেন্টে যান। এই রেজিমেন্টের তৎকালীন কমান্ডিং অফিসার ছিলেন কর্নেল নওয়াজিস। 

৭ নভেম্বর ভোরবেলা, কথিত বিদ্রোহের প্রবল ঢেউ ১০ বেঙ্গলে এসে পড়ে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে থাকে। ঘোলাটে পরিস্থিতিতে শত্রু আর মিত্রের পার্থক্য করাও ছিল কঠিন। চারদিক থেকে স্রোতের মতো তীব্র বেগে নানা মাত্রার গোপন চক্রান্ত ও যড়য়ন্ত্র প্রকাশ্যে ধেয়ে আসতে থাকে।

১০ বেঙ্গলের অফিসার মেসে ছিলেন খালেদ মোশাররফ, হায়দার  এবং হুদা। এক সময় কিছু অফিসার কয়েকজন উত্তেজিত সৈনিক নিয়ে মেসের ভিতর প্রবেশ করেন। সে দলে একজন হাবিলদারও ছিল।

তারা চিৎকার দিয়ে জেনারেল খালেদকে বলল- "আমরা তোমার বিচার চাই"!

জেনারেল খালেদ শান্তকণ্ঠে জবাব দিলেন," ঠিক আছে , তোমরা আমার বিচার করো। আমাকে জিয়ার কাছে নিয়ে চলো।"

স্বয়ংক্রিয় রাইফেল বাগিয়ে হাবিলদার চিৎকার করে বললো-"আমরা এখানেই তোমার বিচার করবো।"

ধীর স্থির জেনারেল খালেদ বললেন, " ঠিক আছে, তোমরা আমার বিচার করো"

খালেদ দু'হাত দিয়ে তার মুখ ঢাকলেন।

একটি ব্রাস ফায়ার।

মেঝেতে লুটিয়ে পড়লেন সেনাবাহিনীর চৌকস অফিসার বীর মুক্তিযোদ্ধা জেনারেল খালেদ মোশাররফ, যাঁর ললাটে ছিল বীরযোদ্ধার জয়টিকা, মাথায় ছিল মুক্তিযুদ্ধের বীর উত্তম-এর শিরোপা আর মাথার বাম পাশে ছিলো পাকিস্তানি গোলন্দাজ বাহিনীর কামানের গোলার গভীর ক্ষতচিহ্ন।

কামরার ভেতরেই গুলিবিদ্ধ হয়ে প্রাণত্যাগ করলেন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অন্যতম আসামী, মুক্তিযুদ্ধে ৮নং সেক্টরের সাবসেক্টর কমান্ডার  কর্নেল নাজমুল হুদা বীর বিক্রম ।

কর্নেল হায়দার ছুটে বেরিয়ে যান কিন্তু সৈনিকদের হাতে বারান্দায় ধরা পড়েন । উত্তেজিত সৈনিকদের হাতে তিনি নির্দয়ভাবে লাঞ্ছিত হন। তাঁকে সিপাহীরা কিল ঘুষি লাথি মারতে মারতে দোতলা থেকে নিচে নামিয়ে এনে গুলি করে হত্যা করে।

কঠোর সামরিক নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে মেজর হায়দারের মরদেহ কিশোরগঞ্জ শহরে সমাহিত করা হয়। অন্য নিহতদের শেষযাত্রার ছবিটিও ছিল একই রকম। স্বজনদের কেউ কোনও কথা বলতে পারেন নি। জানতে পারেন নি, কেন তাদেরকে নির্মমভাবে হত্যা করা হলো?

এইসব নির্মম হত্যাকাণ্ডের কোনও বিচার আজও হয়নি। এমন জঘন্য ও ঘৃণ্য হত্যাকাণ্ডের বিচারের দায় কার?

[পাদটীকা: ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বরের ঘটনাবলি নিয়ে অনেক বই রচিত হয়েছে। সেদিনের হত্যা, পাল্টা-হত্যা, ক্যু, কাউন্টার-ক্যু নিয়েও অনেক গবেষণা এবং প্রত্যক্ষদর্শির বিবরণ গ্রন্থাকারে প্রকাশ পেয়েছে। এই লেখার তথ্যসূত্র হিসাবে মূলত তিনটি বইয়ের সাহায্য নেওয়া হয়েছে। এগুলো হলো: জহিরুল ইসলাম রচিত 'মুক্তিযুদ্ধে মেজর হায়দার ও তার বিয়োগান্ত বিদায়',  নিলুফার হুদা রচিত 'কর্নেল হুদা ও আমার যুদ্ধ' এবং কর্ণেল এম এ হামিদ রচিত 'তিনটি সেনা অভ্যুত্থান ও কিছু না বলা কথা'।

 

এ সম্পর্কিত আরও খবর