৫শ’ শিক্ষার্থী ও এতিমের অভিভাবক পথের ভিখারি!

বিবিধ, ফিচার

ফাওজিয়া ফারহাত অনীকা, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | 2023-09-01 15:25:38

ছেলেবেলা থেকেই দারুণ প্রতিভাবান ছিলেন গাজী জালালুদ্দীন। স্কুল জীবনে প্রথম স্থানটি সবসময় তার দখলেই থাকতো। তবে দুঃখজনকভাবে এমন আনন্দময় দিনগুলো খুব বেশিদিন তার জীবনে স্থায়ী হয়নি। মাত্র সাত বছর বয়সেই কঠিন বাস্তবতার সম্মুখীন হতে হয় তাকে।

ব্যবসায় কোনমতেই লাভের মুখ দেখতে পাচ্ছিলেন না জালালুদ্দীনের বাবা। মেধাবী ছেলের পড়ালেখার খরচ চালানোটাও যেন ভীষণ কষ্টকর হয়ে উঠেছিল তার জন্য। পরিবারের ভাগ্যের চাকা পরিবর্তনের জন্য সপরিবারে তারা চলে আসেন কলকাতাতে। সেখানেও খুব একটা সুবিধা করতে পারেননি তিনি।

বরং সঙ্কট দেখা দেয় চূড়ান্ত আকারে। দিনের ভেতর এক বেলা পরিবারের সবার খাবারের আয়োজন করাই তখন বিলাসিতার মতো হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ফলাফল স্বরূপ, জালালুদ্দীনের পড়ালেখার গন্ডি আটকে যায়, ছেড়ে দিতে হয়ে স্কুল। স্কুল ও পড়ালেখা ছেড়ে দিয়ে, বাধ্য হয়েই তাকে বেছে নিতে হয় জীবিকা অর্জনের কঠিনতম পথ। হয়ে যেতে হয় পথের ভিখারি!

শৈশবের সেই স্মৃতিগুলো মনে করে জালালুদ্দীন বলেন, ‘স্কুল ছেড়ে দেওয়ার পর প্রথম একটা বিষয় খেয়াল করি আমি। আমার মতো দরিদ্র শিশুরা তখনই ভিক্ষা করা শুরু করে, যখন তাদের পরিবার স্কুলের জন্যে টাকা দিতে পারে না। এই চিন্তা থেকেই আমি সেই বয়সে ভিক্ষা করা শুরু করি’।

নিজ স্কুলের শিক্ষার্থীর সঙ্গে গাজী জালালুদ্দীন

পরবর্তীতে ১২ বছর বয়সে ভিক্ষাবৃত্তি বাদ দিয়ে রিকশা চালানো শুরু করেন কিশোর জালালুদ্দীন। প্রথম থেকেই রিকশা চালানোর আয় থেকে কিছু টাকা বাঁচিয়ে রাখতেন তিনি। জমানো এই টাকা দিয়ে অবসরে ট্যাক্সি চালানো শিখতেন তিনি। যে কারণে কিছুদিনের মাঝেই রিকশাচালক থেকে ট্যাক্সিচালক হয়ে যেতে পারেন তিনি।

কিশোর জালালুদ্দীন শুধু ট্যাক্সি চালানোর মাঝেই নিজের কার্যকলাপ সীমাবদ্ধ রাখেননি। সেই বয়সেই গঠন করেন ‘সুন্দরবন ড্রাইভিং সমিতি’। যার মাধ্যমে বেকার যুবকদের তিনি ট্রেইনিং দেওয়ার ব্যবস্থা করেন।

নিজ স্কুলের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে গাজী জালালুদ্দীন

তবে জালালুদ্দীনের স্বপ্ন আরও বড়, তার কাজ করার ও নিজেকে প্রকাশ করতে চাওয়ার পরিধিটা আকাশসম। তাইতো একটু একটু করে নিজের সীমাবদ্ধতা ও সাধ্যকে ছাড়িয়ে ১৯৮৮ সালে ‘সুন্দর শিক্ষায়াতন মিশন’ নামেও একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন স্ত্রী তাসলিমার সঙ্গে। তরুণদের জন্য কারিগরি ও শিক্ষা উন্নয়নের উদ্দেশ্যে গড়ে তোলা এই প্রতিষ্ঠানটি, নিজের দুই বাসার বেড রুমে ২২ জন ছাত্র ও দুই জন শিক্ষক নিয়ে যাত্রা শুরু করে।

সেই শিশু ভিক্ষুক কিংবা রিকশাচালক জালালুদ্দীনের বর্তমান বয়স এসে দাঁড়িয়েছে ৬৫’র ঘরে। একেবারে শূন্য থেকে শুরু করা জালালুদ্দীন, বর্তমানে তার নিজ হাতে গড়ে তোলা দুইটি স্কুল ও একটি এতিমখানা পরিচালনা করছেন। ৫০০ শিশু, ২৫ স্টাফ ও ২১ জন শিক্ষকের এই প্রতিষ্ঠানগুলো চলছে তার নিজ খরচে ও অনুদানের টাকায়।

নিজ ট্যাক্সিতে গাজী জালালুদ্দীন

ট্যাক্সি চালিয়েই যার ব্যয় বহন করেন তিনি। তার ট্যাক্সির গায়ে তিনি লিখে রেখেছেন, ‘এই ট্যাক্সির সম্পূর্ণ আয় দরিদ্রদের স্কুল ও এতিমদের উন্নয়নমূলক কাজে ব্যয় কয়া হয়। দয়া করে কোন মামলা দিবেন না’।  তার এই কাজে অর্থনৈতিকভাবে নানান সময়ে সাহায্য করেন তার দুই ট্যাক্সিচালক ছেলেও।

শুধু শিক্ষা নয়, দুপুরের খাবারও দেওয়া হয় সকল শিক্ষার্থীদের। সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের শিক্ষা প্রদানের বন্দোবস্ত করার প্রবল ইচ্ছা জালালুদ্দীন ও তাসলিমার স্বপ্ন বাস্তবায়নে পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি মোটেও।

উদ্ভাবনশীল ও দৃঢ়চেতা জালালুদ্দীন খুব চমৎকার একটি বিষয়ে পরিবর্তন আনার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছেন। তিনি বিশ্বাস করেন, অর্থনৈতিক অবস্থা কারোর শিক্ষা গ্রহণের একমাত্র নির্ধারক হতে পারে না। এই ধারণাকে বাস্তবায়নের পক্ষে যতদিন সম্ভব নিজ অবস্থান থেকে পরিশ্রম করেন যাবেন তিনি।

শুধু তাই নয়, ভবিষ্যতে কলেজ খোলার ইচ্ছাও রয়েছে তার। তিনি যদি কলেজ করতে না পারেন, তবে তার দুই ছেলে সেই স্বপ্ন বাস্তবায়ন করবে বলে আশা করেন জালালুদ্দীন। তিনি বলেন, ‘কলেজ শুরু করার বিষয়ে আমি আমার ছেলেদের উপর বিশ্বাস রাখি। আমি গাজী জালালুদ্দীন ভারত থেকে নিরক্ষরতা সম্পূর্ণরূপে দূর করতে চাই’।

এ সম্পর্কিত আরও খবর