ঠাকুরগাঁও শহর থেকে ৪০ কিলোমিটার দূরে রানীশংকৈল উপজেলা। এ উপজেলার পূর্ব প্রান্তে কুলিক নদীর পূর্ব তীরে অবস্থিত ১০৩ বছরের পুরনো মালদুয়ার জমিদার রাজা টঙ্কনাথের রাজবাড়ি।
দীর্ঘদিন ধরে সংস্কার না হওয়ায় জঙ্গলে পরিণত হয়েছে এটি। বর্তমানে পরিত্যক্ত পড়ে রয়েছে রাজবাড়িটি। দেয়ালের প্রতিটি অংশ ধ্বংশের পথে। কম বেশি সবখানেই গাছপালায় ছেয়ে গেছে দেয়াল। এর পরেও কমেনি সাধারণ জনগণের কাছে তার কদর। দূর-দূরান্ত থেকে অনেকে এখনো আসছে এটি দেখতে।
মঙ্গলবার (১৩ নভেম্বর) দুপুরে সরেজমিনে দেখা যায়, উল্লেখযোগ্য সংখ্যক দর্শনার্থী রাজবাড়িতে বেড়াতে এসেছে। রাজা টঙ্কনাথের ইতিহাস জানার আগ্রহ তাদের মধ্যে প্রবল। রাজবাড়িটির ভবন সংস্কার ও পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলার দাবি জানান দর্শনার্থী ও এলাকাবাসী।
জানা যায়, রাজা টংকনাথের পিতা বুদ্ধিনাথ ছিলেন মৈথিলি ব্রাহ্মণ। রাণীশংকৈল থেকে সাত কিলোমিটার পূর্বে কাতিহার শ্যামরাই মন্দিরের সেবাইত ছিলেন বুদ্ধিনাথ। মন্দিরটির মালিক ছিলেন ঘোষ বা গোয়ালা বংশীয় নি:সন্তান এক জমিদার।
বৃদ্ধ গোয়ালা জমিদার কাশিবাসে যাওয়ার সময় সমস্ত জমিদারি সেবায়েতের তত্ত্বাবধানে রেখে যান এবং দলিল করে যান যে, তিনি কাশি থেকে ফিরে না এলে সেবাইত বুদ্ধিনাথ জমিদারির মালিক হবেন।
পরে জমিদার ফিরে না আসলে বুদ্ধিনাথ জমিদারির মালিক হয়ে যান। তবে অনেকে মনে করেনম, এ ঘটনাটি বুদ্ধিনাথের দু-এক পুরুষ পূর্বেরও হতে পারে। মতান্তরে আঠার শত খ্রিষ্টাব্দের শেষের দিকে মালদুয়ারের নাম ছিল রামগঞ্জ। সে সময় এলাকার জমিদারি ছিল দুই সহোদরের হাতে।
নাথপন্থী এই সহোদর যুগল ছিলেন চিরকুমারী। তারা পরিচিত ছিলেন বড় রাণী ও ছোট রাণী হিসেবে। উভয় রাণী কাশীধামে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলে তামার পাতে জমিদারি বুদ্ধিনাথের নামে লিখে দেন। কথা ছিল তারা ফিরে না আসলে জমিদারি সেবায়েতের হয়ে যাবে। রাণীরা আর ফিরে আসলেন না। রাজবাড়ি নির্মাণের কাজ বুদ্ধিনাথ শুরু করলেও সমাপ্ত করেন রাজা টংকনাথ রায়।
ঊনবিংশ শতাব্দির শেষ ভাগে রাজবাড়িটি নির্মিত হয়। বুদ্ধিনাথের তিন ছেলে রাম নাথ, টংকনাথ ও গৌরাঙ্গ নাথ। রাম নাথের অকাল মৃত্যু হয়, গৌরাঙ্গ ছিল হাবা গোবা। টংকনাথ ছিল চতুর। বুদ্ধিনাথের মৃত্যু হলে টংকনাথ সমস্ত জমিদারি হাতিয়ে নেন।
এ জনপদটি এক সময় ছিল মালদুয়ার পরগনার অন্তর্গত। পরে টংকনাথ ব্রিটিশ সরকারের আস্থা লাভ করে মালদুয়ার স্টেট গঠন করেন। কথিত আছে, টাকার নোট পুরিয়ে জনৈক ব্রিটিশ রাজ কর্মচারীকে চা বানিয়ে খাইয়ে টংকনাথ চৌধুরী উপাধি লাভ করেন। এরপর দিনাজপুরের মহারাজা গিরিজা নাথ রায়ের বশ্যতা স্বীকার করে রাজা উপাধি পান।
১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট ভারতবর্ষ ব্রিটিশদের শাসন থেকে মুক্ত হলে রাজা টঙ্কনাথ চৌধুরী সপরিবারে ভারতে চলে যান। বিশাল রাজবাড়ি জীর্ণশীর্ণ পরিত্যক্ত অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে। চারপাশে ছিন্নমূল মানুষের বসবাস। যে কোনো মুহূর্তে রাজবাড়িটি ভেঙে পড়তে পারে। চুরি হয়ে যাচ্ছে ইটসহ দামি সৌখিন দরজা, জানালা ও লোহার বিভিন্ন জিনিস।
স্থানীয়রা জানান, রাজবাড়িটি দেখতে অনেকেই আসেন। যদি এটাকে মেরামত করা হয়, তাহলে আবারো ঐতিহ্যবাহী রাজবাড়িটি সকলের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠবে।
রাজবাড়ি দেখতে এসেছেন মনি, রুপা, আশরাফসহ কয়েকজন। মনি বলেন, ‘বন্ধুরা মিলে এসেছি এই রাজবাড়িটি দেখতে। অনেকের মুখেই শুনেছিলাম এটার কথা। বাড়িটি অনেক সুন্দর কিন্তু দেখতে ভয় লাগছে। কারণ এটা পুরোটাই একটা জঙ্গলের মতো হয়ে গেছে।’
টঙ্কনাথের স্মৃতি বিজড়িত বাড়িটি সংস্কার ও সংরক্ষণ করতে সরকারের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করে ইতিহাস, ঐতিহ্যকে ধরে রাখার প্রত্যাশা করেন রাণীশংকৈলবাসী।
এ ব্যাপারে ঠাকুরগাঁও জেলা প্রশাসক ড. কে এম কামরুজ্জামান সেলিম বলেন, ‘রাজবাড়িটি দীর্ঘদিন আগের। ইতোমধ্যে এটি পরিদর্শন করেছি। চেষ্টা করবো এটি সংস্কার করে ঐতিহ্যকে ফিরেয়ে আনার।’