আজ পহেলা অগ্রহায়ণ মোতাবেক ১৫ অক্টোবর। হেমন্ত ঋতুর দ্বিতীয় মাস। হৈমন্তী আবেশে অঘ্রাণে-নবান্নে-উৎসবে মেতে বাংলায় তারপর আসবে পৌষের হাত ধরে শীতকাল।
অগ্রহায়ণ এক বর্ণবহুল মাস। এ মাসে মাতবে বাংলাদেশ। চিরায়ত গ্রাম-বাংলা সাজবে ফসলের গৌরবে। উৎসব ও নবান্নের সাজে সাজবে রূপসী বাংলা।
আবহমান বাংলার উৎসবমুখর মাস অগ্রহায়ণ। আর্দ্রা তারার নাম অনুসারে নাম রাখা হয়েছে অগ্রহায়ণ মাসের। কার্তিকের পর আসে সর্বজনীন লৌকিক উৎসব নবান্ন। ‘অগ্র’ও ‘হায়ণ’এ দু’অংশের অর্থ যথাক্রমে ‘ধান’ও ‘কাটার মওসুম’বা 'বছর'। মুঘল সম্রাট জালালউদ্দীন মুহাম্মদ আকবর অগ্রহায়ণ মাসকেই বছরের প্রথম মাস বা খাজনা তোলার মাস ঘোষণা দিয়েছিলেন।
এক সময় অগ্রহায়ণ ছিল বছরের প্রথম মাস। 'অগ্র' শব্দের অর্থ 'আগে' আর 'হায়ণ' শব্দের অর্থ 'বছর'। বছরের আগে বা শুরুতে ছিল বলেই এই মাসের নাম 'অগ্রহায়ণ'।
ছবির মতো সুন্দর এ মাসটির আরেক নাম মার্গশীর্ষ। প্রাচীন বাংলা ভাষায় এই মাসটিকে আঘন নামেও চিহ্নিত করা হত। মৃগশিরা নামক তারা থেকে 'মার্গশীর্ষ' নাম এসেছে। তবে আমাদের কাছে অগ্রহায়ণ এখন বাংলা সালের অষ্টম মাস।
‘অগ্রহায়ণ’ শব্দের অভিধানিক অর্থ বছরের যে সময় শ্রেষ্ঠ ব্রীহি (ধান) উৎপন্ন হয়। অতীতে এই সময় প্রচুর ধান উৎপাদিত হতো বলে এই মাসটিকেই বছরের প্রথম মাস ধরা হত। এখনও এ মাসের সঙ্গে রয়েছে ফসলের নিবিড় সম্পর্ক।
অগ্রহায়ণকে চলতি বাংলা ভাষায় আদর করে ডাকা হয় অঘ্রান। এ মাসটি লোকসংস্কৃতি ও বাংলার প্রকৃতিতে যেমন মিশে আছে, তেমনি স্মরণীয় হয়ে আছে আমাদের বাংলাদেশের জাতীয় সংগীতের চরণে। কবিগুরুর রচনায় আমাদের যে জাতীয় সংগীত, তাতে গীত হয়েছে সমবেত কণ্ঠে এই মোহনীয় লাইনটি: 'ও মা, অঘ্রানে তোর ভরা ক্ষেতে আমি কী দেখেছি মধুর হাসি।’
শ্বাশত বাংলায় অঘ্রানের ভরা ক্ষেতে এই হাসি হলো ফসলের উল্লাস। এই হাসি কৃষাণ-কৃষাণীর হৃদয়ের উচ্ছাস। মাতৃরূপী জন্মভূতির ভরা ক্ষেতে মধুর হাসি হয়ে দোলে উঠে আদিঅন্তহীন পাকা ধানের সোনালী আভা। যে সৌন্দর্য্যের সাথে একমাত্র মায়ের পবিত্রতম হাসির রয়েছে অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক।
হিন্দু সমাজের বিশ্বাস অনুযায়ী, অগ্রহায়ণ মাস বিয়ে-শাদির পক্ষে বিশেষ শুভ মাস। নবান্নে উৎসবে হিন্দু লোকসমাজে অগ্রহায়ণ মাসকে 'লক্ষ্মীর মাস' মনে করা হয়। এ কারণে এই মাসেই নবান্ন উৎসব ও লক্ষ্মীপূজার বিশেষ আয়োজন করা হয়।
হেমন্তের ফসল কাটাকে কেন্দ্র করেই নবান্ন উৎসবের সূচনা হয়। নবান্ন (অর্থ- নতুন অন্ন) বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী শস্যোৎসব। নবান্ন হলো নতুন আমন ধান কাটার পর সেই ধান থেকে প্রস্তুত চালের প্রথম রান্না উপলক্ষে আয়োজিত উৎসব, যা সাধারণত অগ্রহায়ণ মাসে আমন ধান পাকার পর এই উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশের কোনো কোনো অঞ্চলে ফসল তোলার পরদিনই নতুন ধানের নতুন চালে ফিরনি-পায়েশ অথবা ক্ষীর তৈরি করে আত্মীয়-স্বজন ও পাড়া-প্রতিবেশীর ঘরে ঘরে বিতরণ করা হয়। নবান্নে জামাইকে নিমন্ত্রণ করা হয়, মেয়েকেও বাপের বাড়িতে ‘নাইওর’আনা হয়।
নবান্নে নানা ধরনের দেশীয় নৃত্য, গান, বাজনাসহ আবহমান বাংলার সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পালিত হয়। লাঠিখেলা, বাউলগান, নাগরদোলা, বাঁশি, শখের চুড়ি, খৈ, মোয়ার পসরা বসে গ্রাম্য মেলায়।
প্রাণোচ্ছল এ মাসের কথা মনে রেখেই সম্ভবত বাংলার চিরায়ত গায়ক গেয়েছেন: 'আবার জমবে মেলা, বটতলা হাটখোলা। অঘ্রাণে নবান্নে উৎসবে, সোনার বাংলা ভরে উঠবে সোনায়, বিশ্ব অবাক চেয়ে রবে।’
প্রকৃতির শাশ্বত সৌন্দর্য্যের অনিন্দ্য রূপে-রসে ও মূর্ছনায় ভর উঠুক লোকায়ত বাংলার চিরায়ত জীবন।