স্বামী-স্ত্রী দুই জনকেই সাদা কাপড় পরিয়ে দিলেন পাড়া-প্রতিবেশী। স্ত্রীকে ইহকালের জন্য, স্বামীকে পরকালের জন্য। স্ত্রী সজাগ, স্বামী ঘুমন্ত। স্ত্রী দেখছে স্বামীকে, স্বামী দেখছে না স্ত্রীকে। স্ত্রীর বুক ফাঁটা কান্না, স্বামীর চিরন্তন ঘুম।
ঘুম দুই ধরণের। ঘুম থেকে জেগে উঠলে নতুন জীবন। আর না উঠলে এখানেই শেষ জীবন। বেঁচে থাকার মোহটার নামেই জীবন। ঘুম আর সজাগ হওয়ার মাঝে বহিত জীবন। শেষ ঘুম ঘুমিয়ে গেলো স্বামী। মা-বাবা আর তিন বোন নিয়ে স্বামীর সংসার। পরিবারের ভরণ-পোষণের একমাত্র অবলম্বন এই স্বামী।
সবাইকে জাগ্রত রেখে, নিজেই ঘুমিয়ে গেলেন চিরদিনের জন্য। যেই স্বামীর কথা বলছি, সেই স্বামী আমাদের সহকর্মী। সাপ্তাহিক মানবসমাজ পত্রিকার নিজস্ব প্রতিনিধি ইমাম হোসেন ইমন। ইমন চাঁদপুর জেলা আইনজীবী সহকারী সমিতির সদস্য ছিলেন। শুক্রবার সকাল সাড়ে ৯টায় হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। তার গ্রামের বাড়ি চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জ উপজেলার ২নং বালিথুবা ইউনিয়নের বালিথুবা গ্রামের ভূঁইয়া বাড়ি।
সাংবাদিক এসএম মিরাজ মুন্সীর মাধ্যমে ইমনের মানবসমাজ অফিসে আসা। ইমনের সাথে দেখা হলেই মুখে হাসিটা দেখতে পেতাম। সংবাদ মাধ্যমে যে যত বড় পদে আসীন হোক না কেন, ভাই/ ভাইয়া শব্দটা প্রচলিত। মানবসমাজ পরিবারে সংশ্লিষ্ট সবাই ‘ভাই’ শব্দে সম্বোধনরত। ইমন দেখা হলে বলতো ‘ভাই কেমন আছেন? চলেন চা খাবো।’
ইমনের তত্ত্বাবধানে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়সহ বিভিন্ন স্থানে পত্রিকা পৌঁছে যেতো। পত্রিকা না পেলে নিজে অফিসে এসে নিয়ে যেতো। মানবসমাজ পত্রিকা গত ২৬ নভেম্বরের সংখ্যাটিও অফিসে এসে ইমন নিয়েছিল। ফোন করে ইমনকে বকা দিয়েছিলাম। পরিবহনে একটি বান্ডিল পাঠালাম, আবার তুমি অফিসে এসে নিয়েছ। এখন একটি পত্রিকার বান্ডিল ফেরত পাঠাও? ইমন বলল- ‘আচ্ছা, ভাই পাঠাবো।’ পরদিন আবার মুঠোফোনে অন্য প্রসঙ্গে ইমনের সাথে কথা হয়েছিল। আর কথা হবে না, আর দেখা হবে না, আর চা-নাস্তা খাওয়া হবে না ইমনের সাথে- ভাবতে অবাক লাগে।
ত্রিশের কোটায় থেমে গেল ইমনের জীবনযন্ত্র। ইমনের জানাজার নামাজ পড়ে তার ঘরে প্রবেশ করলাম। পাড়া-পড়শী, আত্মীয়-স্বজনের ভীড়। ভীড়ের মাঝখানে সাদা কাপড় পরিহিত ইমনের বউ। মাথা নীচু হয়ে, চোখের জল মুছতে মুছতে আবার কান্না। ইমনের বউকে তো দেখেছি একাধিকবার। বোরকা পরা। আবার রঙ্গিন কাপড় পরা। আঠার বছর বয়সী এই গৃহবধূর পরণে সাদা কাপড়! অবশ্যই কেউ মানতে রাজি হবেন না। নিয়তি বয়সের ধার ধারে না।
মানবসমাজ পরিবারের যার সাথে দেখা হতো, কাজ রেখে ইমন কথা বলতো। এ পরিবারের কেউ চাঁদপুরে গেলে ইমন কর্মজীবনের ব্যস্ততা রেখে দেখা করতে চলে আসতো। ইমন ঋণগ্রস্ত ছিল ঠিকই, কিন্তু বিপদগামী ছিল না। ইমন সংসারে একমাত্র আয়ের বাহক ছিল। সেই ইমন ঋণের দায়ে নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেনি। যিনি টাকা পাবেন, তিনি প্রচণ্ডভাবে হয়তো তাকে চাপ প্রয়োগ করেছেন, এটি ইমন সইতে পারেনি। আমরা চাই ইমনের মতো আর কোনো তরুণের জীবন যেন থেমে না যায়।
ইমনের জীবনের শেষ মুর্হূতে একটি পরিস্থিতিতে পড়ে ছিল। গ্রামের এক সুদ ব্যবসায়ীর কাছ থেকে চার লাখ টাকা ধার নেয় ইমন। ঐ ব্যক্তিকে শুক্রবার এক লাখ টাকা দেওয়ার কথা। রাতে শ্বশুরবাড়িতে ছিল। সকাল সাড়ে সাতটায় ঐ ব্যবসায়ী টাকার জন্য ইমনকে ফোন করেন। ইমন বলেছিল- ‘ভাই, আমি বাড়িতে আসতেছি। তার পরপরই ইমন তার মাকে ফোন করে বলেছিল, ‘মা, টাকার জন্য ‘জ’ ভাই ফোন করেছে। আমি বাড়িতে আসতেছি। ভাই আসলে ঘরে বসতে বলবেন।’
ইমন বাড়িতে এসেছে ঠিকই। শেষবারের মতো ইমন বাড়িতে এসেছে। বাড়িতে এসে কাউকে কিছু বলেনি। দু’চোখ মেলে কারো দিকে তাকায়নি। এসে চলে গেল ঘুমের বিছানায়। সেই বিছানা শীতল মাটির। সাদা এক কাপড়ে বন্দি ইমনের ছাউনি হলো কলাপাতা আর বাঁশের শলা।