জাপান এশিয়ার একটি অন্যতম সমৃদ্ধশালী দেশ। দেশটির অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির যাত্রা শুরু হয় ১৮ শতকের মেইজি বিপ্লবের মাধ্যমে। ওই সময়ে জাপান তাদের শিক্ষা ব্যবস্থাকে জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি নির্ভর করার জন্য অনেক তরুণ জাপানিকে ইউরোপ-আমেরিকা পাঠিয়ে দেয়। যাদের অনেকেই জাপানে ফিরে এসে এদেশের শিক্ষা ব্যবস্থার আধুনিকায়নে কাজ শুরু করে। অন্যদিকে কয়েক হাজার পশ্চিমা বিশেষজ্ঞ বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে আসে স্কুল-কলেজে আধুনিক বিজ্ঞান, গণিত, প্রযুক্তি ও বিদেশি ভাষা শেখানোর জন্য। পরবর্তীতে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে আধুনিক যুক্তি নির্ভর সেসব শিক্ষিত নাগরিকদের ভূমিকা ছিল অপরিসীম।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসযজ্ঞের পর নতুন করে অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার জন্য জাপানিরা পুনরায় মনোনিবেশ করে তাদের যুদ্ধ পরবর্তী সমাজ বিনির্মাণে। যেখানে আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিনির্ভর শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলা ছিল অন্যতম প্রধান লক্ষ্য। ফলশ্রুতিতে সে সময়ে তারা অর্জন করতে সক্ষম হয় পৃথিবীর সর্বোচ্চ সাক্ষরতার হার, যা পরবর্তীতে তাদের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রাকে অব্যাহত রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। পর্যায়ক্রমে এই দেশটি পশ্চিমা বিশ্বের বহু অর্থনৈতিক পরাশক্তিকে পেছনে ফেলে হয়ে উঠে পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ।
জাপানের বর্তমান জনসংখ্যা ১২৬.৭১ মিলিয়ন (২০১৭ সাল)। যার মোট জনসংখ্যার ২৭.৮% হচ্ছে ৬৫ বছরের ওপরে। ৫৯.৯% হচ্ছে ১৫ থেকে ৬০ বছরের মধ্যে। ১২.৩% হচ্ছে ০ থেকে ১৪ বছরের মধ্যে। জাতীয় জনসংখ্যা ও সামাজিক নিরাপত্তা গবেষণা ইনস্টিটিউটের তথ্য অনুযায়ী, ২০৬৫ সালে জাপানের জনসংখ্যা দাঁড়াবে ৮৮.১ মিলিয়ন যা বর্তমান জনসংখ্যার ৩ ভাগের ২ ভাগ।
এ ছাড়া অন্য আর একটি গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, ২০৬০ সালের মধ্যে জাপানের মোট জনসংখ্যার ৪০% হবে ৬৫ বছরের ওপরে। ওপরে উল্লেখিত তথ্য থেকে বুঝা যাচ্ছে, এই মুহূর্তে জাপানের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে- জনসংখ্যা বাড়িয়ে অর্থনীতিকে সচল রাখা।
২০১০ সালের পর থেকে জাপানের জনসংখ্যা ক্রমাগত হ্রাস পেয়ে যাচ্ছে। এর প্রধান কারণগুলোর অন্যতম হচ্ছে- চলমানযান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা। এই সমাজের প্রতিটি নাগরিক যেন পরিণত হয়েছে এক একটি যন্ত্রমানবে। যুগের পর যুগ ধরে যান্ত্রিক সভ্যতাকে টিকিয়ে রাখতে গিয়ে হারিয়ে যাচ্ছে ঐতিহ্যগত পারিবারিক বন্ধন। ফলাফল হিসেবে তরুণ-তরুণীদের বিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার আগ্রহ কমে যাচ্ছে। এ ছাড়া কর্মজীবী মেয়েদের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার ফলে যথাসময়ের পরে বিয়ে এবং কম সন্তান জন্ম দেওয়ার প্রবণতাকে অনেকে জনসংখ্যা হ্রাস পাওয়ার কারণ হিসেবে উল্লেখ করছেন।
অপরদিকে বিজ্ঞানসম্মত ও পরিবেশবান্ধব জীবনযাপনের পাশাপাশি উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থার কারণে গড় আয়ু বৃদ্ধি পাচ্ছে যা এদেশের প্রবীণ জনসংখ্যার চাপ বাড়িয়ে তুলছে। একটি দেশের অর্থনীতির মূলচালিকা শক্তির অন্যতম প্রধান উপাদান হচ্ছে সেই দেশের কর্মঠ তরুণ সমাজ। আগামী ৫০ বছরের মধ্যে সেই কর্মঠ তরুণদের চরম ঘাটতিতে পরবে সূর্যোদয়ের এই দেশটি। যার প্রভাব বর্তমান সময়ে বিভিন্ন ছোট ও মাঝারি শিল্প প্রতিষ্ঠানে পড়তে শুরু করেছে। তীব্র শ্রমিক ঘাটতির কারণে অনেক শিল্প প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এ ছাড়া গড় আয়ু বৃদ্ধির কারণে ৬৫ বছর ঊর্ধ্ব নাগরিকদের সংখ্যা বেড়ে চলছে, যা সরকারের চিকিৎসা ও পেনশন ভাতাসহ অন্যান্য আনুষাঙ্গিক খরচের পরিমাণ বাড়িয়ে তুলছে। অপরদিকে জনসংখ্যা হ্রাস পাওয়ার কারণে সরকারের আয়ের উৎস সংকুচিত হচ্ছে। এ অবস্থা মোকাবেলার জন্য জাপান সরকার বিদেশি দক্ষ জনশক্তির সঠিক ব্যবহার ও মূল্যায়নের ওপর জোড় দিচ্ছে।
বর্তমানে জাপানে ২.৫৬ মিলিয়ন অভিবাসী রয়েছে। যা জাপানের মোট জনসংখ্যার ১.৯ শতাংশ। এদের মধ্যে ১.২৮ মিলিয়ন বিভিন্ন পেশাতে কর্মরত। এমতাবস্থায় জাপান সরকার নতুন অভিবাসী আইনের আওতায় ৫ লাখ নতুন অভিবাসীকে স্বাগত জানানোর জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। যার কার্যকারিতা শুরু হবে ২০১৯ সালের এপ্রিল মাস থেকে।
এই আইনের আওতায় বিদেশিরা দুই ধরনের ভিসা নিয়ে জাপানে কাজের সুযোগ পাবে ১। নির্দিষ্ট দক্ষতা-১ এবং ২। নির্দিষ্ট দক্ষতা-২
নির্দিষ্ট দক্ষতা-১: এই ভিসাপ্রাপ্তির পূর্বশর্ত হচ্ছে, নির্দিষ্ট কাজে বিশেষ দক্ষতাসহ জাপানিজ ভাষায় যোগাযোগে পর্যাপ্ত দক্ষতা। এ ভিসায় বিদেশি নাগরিকরা সর্বোচ্চ ৫ বছর জাপানে কাজের সুযোগ পাবেন। এ ভিসার অধীনে পরিবার নিয়ে বসবাসের সুযোগ নেই। অপরদিকে এ ভিসার অধীনে আগত দক্ষ কর্মীরা নির্দিষ্ট দক্ষতা-২ এ ভিসা পরিবর্তন করতে পারবেন।
নির্দিষ্ট দক্ষতা-২: নির্দিষ্ট দক্ষতা-১ এর অধীনে কর্মরত বিদেশিরা নির্দিষ্ট কাজে বিশেষ দক্ষতা অর্জন করতে পারলে নির্দিষ্ট দক্ষতা-২ ভিসাতে রেসিডেন্স স্ট্যাটাস পরিবর্তনের জন্য আবেদন করতে পারবেন। এ ভিসা নিয়ে জাপানে দীর্ঘমেয়াদে পরিবারসহ বসবাস ও কাজ করার সুযোগ থাকবে। পাশাপাশি দীর্ঘমেয়াদে বসবাসকারী দক্ষ শ্রমিকরা পার্মানেন্ট রেসিডেন্স ভিসা নিয়ে স্থায়ীভাবে পরিবারসহ বসবাস করতে পারবেন।
জাপান নতুন অভিবাসন আইন প্রণয়নের মধ্য দিয়ে বহু বছরের লালিত সমজাতীয় সমাজ ব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে এসেছে। এই আইনটি নতুন অভিবাসীদের জন্য সুখবর বয়ে আনলেও অনেক কট্টরপন্থী জাপানিরা এর তীব্র সমালোচলা করছেন। তবে জাপানের অর্থনীতির চাকাকে সচল রাখতে নতুন অভিবাসীদের স্বাগত জানানো ছাড়া অন্যকোনো বিকল্প নেই সূর্যোদয়ের এই দেশটির।
শরিফুল ইসলাম: জাপান প্রবাসী
sharifapu@gmail.com