শীতের হাওয়া বইতে শুরু করেছে। আর এর সাথে সাথে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত হবিগঞ্জের সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানে বাড়ছে পর্যটকদের ভিড়। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রতিদিন হাজারও পর্যটক এখানে ছুটে যান প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য উপভোগ করতে। প্রকৃতির মাঝে হারিয়ে গিয়ে ব্যস্ত জীবন থেকে কিছুটা হলেও পরিত্রাণ পেতে চান তারা। বনের ভেতর ছুটেন হরেক রকম প্রজাতির বন্যপ্রাণী দেখতে।
জেলার চুনারুঘাট উপজেলায় চারপাশে চা বাগান ঘেরা মনোরম পরিবেশে সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানের অবস্থান। ঢাকা থেকে এর দূরত্ব প্রায় ১৩০ কিলোমিটার। হবিগঞ্জ জেলা সদর থেকে প্রায় ৫০ কিলোমিটার এবং জেলার শায়েস্তাগঞ্জ থেকে প্রায় ৩২ কিলোমিটার দূরে এর অবস্থান।
ছোট বড় টিলা ও চা বাগান ঘেরা প্রকৃতির অপর সৌন্দর্যে লীলাভূমি এ সাতছড়ি জাতীয় উদ্যান। টিলার ভেতর দিয়ে ৭টি ছড়া বয়ে যাওয়ায় এর নামকরণ হয় সাতছড়ি। বনের ভেতর রয়েছে প্রায় ৬০ ফুট উঁচু একটি সু উঁচু ‘ওয়াচ টাওয়ার’। যেখান থেকে বিশাল এ বনকে উপভোগ করা যায়। বনে ঘুরতে বন বিভাগের নির্দেশনামূলক অনেক সাইনবোর্ড লাগানো রয়েছে।
২৪৩.১০ হেক্টর জমি নিয়ে সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানের বিস্তৃত। ২০০৫ সালের ১০ অক্টোবর এটিকে জাতীয় উদ্যান ঘোষণা করে সরকার। বনের প্রবেশ ফি প্রাপ্ত বয়স্কদের জন্য জনপ্রতি ২০ টাকা, অপ্রাপ্ত বয়স্ক ও ছাত্রদের জন্য ১০ টাকা এবং বিদেশি নাগরিকদের জন্য জনপ্রতি ৫ মার্কিন ডলার। কার, জীপ ও মাইক্রোবাস পার্কিং ২৫ টাকা। সিনেমা ও নাটকের শুটিং প্রতিদিন ৬ হাজার টাকা। পিকনিক স্পট ব্যবহার জনপ্রতি ১০ টাকা। বিকেল ৫টার পর বনে প্রবেশ নিষেধ।
সাতছড়ি জাতীয় উদ্যান যেন এক পাখি আর বন্যপ্রাণীর রাজ্য। প্রায় ১৯৭ টি প্রজাতির জীবের বসবাস। এর মধ্যে ১৪৯ প্রজাতিই পাখি। এছাড়া ২৪ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ১৮ প্রজাতির সরীসৃপ এবং ৬ প্রজাতির উভচর প্রাণীর সন্ধান মিলেছে সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানে।
বনের উল্লেখযোগ্য পাখি হল ফিঙ্গে, কাঠ ঠোকরা, মথুরা, বন মোরগ, ধনেশ, লাল ট্রগন, পেঁচা, সুই চোরা ইত্যাদি। প্রাণীদের মধ্যে আছে মুখপোড়া হনুমান, চশমা হনুমান, উল্লুক, লজ্জাবতী বানর, কুলু বানর, মায়া হরিণ, খিদির শুকর, বন্য শুকর, বেজি, গন্ধ গোকুল, বনবিড়াল, মেছো বাঘ, কটকটি ব্যাঙ, গেছো ব্যাঙ, গিরগিটি, বিভিন্ন রকম সাপ, গুইসাপ প্রভৃতি। এসব বন্যপ্রাণী দেখতে বনে কৌশলে চলতে হয়। নিঃশব্দে হাটতে হয়। শব্দ পেলেই বন্যপ্রাণীরা পালিয়ে যায়।
তবে বনের পরিবেশ, নিরাপত্তাহীনতা, যুবক-যুবতীতের প্রকাশ্যে অশ্লীলতা ও অনুন্নত অবকাঠামোর কারণে ক্ষোভ প্রকাশ করেছে অনেক দর্শনার্থী। দর্শনার্থীদের গত ১০ বছরের একটি ওয়াচ টাওয়ার ও একটি ট্রি এনডভেঞ্জার ব্যতীত আর কোনো অবকাঠামোর উন্নয়ন হয়নি উদ্যানটিতে। সেই সাথে যেখানে সেখানে ময়লা আবর্জনা ফেলার কারণে নষ্ট হচ্ছে উদ্যানের পরিবেশ।
এ ব্যাপারে ব্রাক্ষণবাড়িয়া থেকে উদ্যানে ঘুরতে আসা এক দর্শনার্থী মো. আব্দুল হক বলেন- ‘সাতছড়ি জাতীয় উদ্যোনে প্রায় ৫ বছর পর ঘুরতে এসেছি। কিন্তু এখানকার পরিবেশ সেই আগের অবস্থাতেই রয়ে গেছে। এখানে তেমন কোন উন্নয়ন হয়নি। তাছাড়া দর্শনার্থীদের জন্য পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেই।’
মৌলভীবাজারের ব্যবসায়ী লুৎফুর রহমান তালুকদার বলেন- ‘জায়গাটির নাম অনেকবার শুনেছি। কিন্তু সময়ের অভাবে আসতে পারিনি। তাই এবার শীতের শুরুতেই পরিবার নিয়ে ঘুরতে আসলাম। কিন্তু এখানের অবস্থা খুবই নাজুক। নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেই বললেই চলে। তাছাড়া যেখানে সেখানে ময়লা আবর্জনা ফেলে রাখা হয়েছে।’
তিনি বলেন- ‘আমি কর্তৃপক্ষের কাছে অনুরোধ করবো। এখানের পরিবেশ যেন পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখা হয়। তাহলে আমরা যারা দর্শনার্থী আছি তাদের ঘুরতে অনেক ভালো লাগবে।’
চুনারুঘাটের বাসিন্ধা মখলিছ মিয়া বলেন- ‘বর্তমানে উদ্যানের অবস্থা ততটা ভালো না। উদ্যানের ভেতরে ঘুরতে গেলে বিভিন্ন অশ্লীল দৃশ্য চোখে পড়ে। যার কারণে এখন আর নারী-শিশুদের নিয়ে এখানে ঘুরতে আসার পরিবেশ নেই।’
তবে স্টাফ সংকট ও সরকারি অর্থ বরাদ্ধ না থাকার কারণে পর্যটকদের জন্য সুযোগ সুবিধা তৈরি করতে পারছেন না বলে দাবি করছে কর্তৃপক্ষ।
সাতছড়ি রেঞ্জ কর্মকর্তা মাহমুদ হাসান বলেন- এখানে স্টাফ সংকট রয়েছে। যার কারণে এখানের পরিবেশ একটু ময়লা আবর্জনাময়। তবে নিরাপত্তা কর্মী না থাকার কারণে আমরা দর্শনার্থীদের গভীর জঙ্গলে না যাওয়ার জন্য অনুরোধ করি।’
তিনি বলেন- ‘পর্যটকদের খাবার ব্যবস্থাতো আর আমাদের করার কথা না। তবে খাবার পানির জন্য একটি পাম্প বসানো হচ্ছে। ইতোমধ্যেই এর কাজ শুরু হয়ে গেছে’।
উদ্যানের সার্বিক অবস্থার উন্নয়ন ও নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করলে আবারও এখানে পর্যটকের সংখ্যা বাড়বে বলে দাবি বিনোদন প্রেমীদের।