পরিযায়ী পাখিরা আসছে

, ফিচার

আ ন ম আমিনুর রহমান, পাখি ও বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞ | 2023-10-27 13:39:51

অক্টোবর মাস। সেপ্টেম্বরের ঘাম ঝড়ানো ও অস্বস্তিকর গরম শেষ হয়ে শীতের হালকা আমেজ শুরু হয়েছে। বিভিন্ন দেশ থেকে অতিথি পাখিরা আসতে শুরু করেছে। যদিও আগে ভোরবেলা ও সন্ধ্যায় আকাশে উড়ে যাওয়া অতিথি পাখির কলকাকলি শোনা যেত, এখন তা তেমন একটা শুনি না। তবে, শহর থেকে খানিকটা দূরে খাল-বিল-নদী-হাওরের কাছাকাছি গেলে ঠিকই ওদের কলকাকলি শোনা যায়। এমনকি সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি খাগড়াছড়ি ও সাজেক গিয়ে বেশ কিছু অতিথি পাখির সঙ্গে দেখা হয়েছে। এই যে অতিথি পাখির কথা বললাম ওরা কী আসলেই আমাদের অতিথি? না, মোটেও না। সঠিকভাবে বললে ওরা হলো পরিযায়ী পাখি বা Migratory Bird। পরিযায়ী পাখির কথা বলার আগে পাখি সম্পর্কে কিছু তথ্য জেনে নেই।

বিশ্বব্যাপী প্রায় ৯,৯৩০ প্রজাতি ও ২২,০০০ উপপ্রজাতির পাখির বাস। অনুমান করা হয়, বিভিন্ন প্রজাতির পাখিগুলোর মোট সংখ্যা ২০-৪০ হাজার কোটি। পুরো ভারতে যেখানে ১,৩১১ প্রজাতির পাখির বাস, সেখানে বাংলাদেশে কমবেশি ৭১৮ প্রজাতির পাখি রয়েছে। বিভিন্ন গবেষণা থেকে জানা যায়, গত কয়েক শতকে ২০০ প্রজাতির পাখি পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। বর্তমানে প্রায় ১,২০০ প্রজাতির পাখি নানা কারণে হুমকির সম্মুখীন। এদেশের মোট পাখির মধ্যে কমবেশি ৩৪০ প্রজাতি স্থায়ীভাবে বসবাস করে, অর্থাৎ এরা সারাবছর এদেশে থাকে, ডিম পাড়ে ও ছানা তোলে। ওরাই হলো এদেশের আবাসিক পাখি। এছাড়াও প্রায় ৩৭০ প্রজাতির পাখি পরিযায়ী অর্থাৎ বছরের কোনো একটি নির্দিষ্ট সময় এদেশে আসে, বসবাস করে ও সময়মতো মূল আবাসে ফিরে যায়। এসব পাখি এদেশের মানুষের কাছে আগে, এমনকি এখনও, ‘অতিথি পাখি’ নামেই পরিচিত। এদেরই এক বিশাল অংশ এদেশে আসে শীতকালে যারা শীতের পরিযায়ী পাখি নামেও পরিচিত।

বাইক্কা বিলে পরিযায়ী কালো-লেজ জৌরালির ঝাঁক। ছবি- লেখক।

শীতপ্রধান দেশ থেকে আসা এসব পাখি মূল দেশে আবাসস্থল বসবাস অনুপযোগী হওয়া, খাদ্যের অভাব ও প্রচ- শীতের কবল থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্যই বাংলাদেশসহ আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া ও এশিয়ার অন্যান্য দেশে পরিযায়ন বা Migration করে। এটা ওদের জীবন চক্রের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। এখানে বেড়ানোর কোনো ব্যাপার নেই, আছে জীবন বাঁচানোর তাগিদ। তাই এসব দেশকে ওদের দ্বিতীয় আবাস বা শীতের আবাস বলা যায়। তবে ওরা কিন্তু এসব দেশে বংশবিস্তার করে না। অবশ্য কিছু ব্যতিক্রমও আছে, যেমন- কুড়া ঈগল শীতকালে এদেশে আসে বংশবৃদ্ধির জন্য।

যদিও পরিযায়ী পাখি বলতে মূলত শীতের পাখিগুলোকেই বোঝানো হয়, তবে কিছু পাখি গ্রীষ্মেও পরিযায়ন করে, যেমন- বিভিন্ন প্রজাতির কোকিল ও হালতি বা সুমচা পাখি। বিভিন্ন প্রজাতির কোকিল এদেশে মার্চ থেকে এপ্রিলে আসে, অন্য উপযুক্ত পাখির বাসায় ডিম পাড়ে, ছানা ফোটে এবং ছানাসহ সকলেই আবার আগস্ট থেকে অক্টোবরের মধ্যে তাদের শীতকালীন আবাসে চলে যায়। অন্যদিকে, বিভিন্ন প্রজাতির হালতি পাখি ফেব্রুয়ারি থেকে মার্চে এদেশে আসে, জুন থেকে জুলাইয়ে ডিম পাড়ে ও ছানা তোলে, ছানারা বড় হয় ও ৭-৮ মাস এদেশে থেকে অক্টোবরের মধ্যে মূল আবাসে চলে যায়। ওরা গ্রীষ্মের প্রজনন পরিযায়ী পাখি নামে পরিচিত।

সুন্দরবনের ডিমের চরের পাশে পরিযায়ী বড় গুলিন্দার ঝাঁক। ছবি- লেখক।

এছাড়াও বেশকিছু প্রজাতির পরিযায়ী পাখির উপস্থিতি এদেশে অনিয়মিত। হয়তো এক বছর এল, এরপর আবার ৫ বা ১০ বছর পর এল, অন্যদের মতো প্রতি বছর এল না। এদেরকে তাই যাযাবর বা ভবঘুরে বা অনিয়মিত পরিযায়ী পাখি বলে। আর ওদের সংখ্যাও নেহাত কম না, এদেশে আসা সকল পরিযায়ী পাখির প্রায় এক-তৃতীয়াংশই ওরা। আবার কোনো কোনো প্রজাতির পাখি অন্য কোনো দেশে পরিযায়নের এক পর্যায়ে এদেশে স্বল্প সময়ের জন্য বিশ্রাম নিতে আসে, যেমন- বাদামি চটক, বন খঞ্জন ইত্যাদি। এরা পন্থ-পরিযায়ী পাখি নামে পরিচিত। মূলত হেমন্তে অর্থাৎ সেপ্টেম্বর থেকে অক্টোবরে অন্য কোনো দেশে পরিযায়নের পথে অল্প সময়ের জন্য এদেশে ওরা যাত্রা বিরতি করে ও বসন্তে অর্থাৎ ফেব্রুয়ারি থেকে মার্চে মূল দেশে ফিরে যাওয়ার সময়ও আরেকবার এদেশে যাত্রা বিরতি করে।

পাখির পরিযায়ন হলো একটি নিয়মিত মৌসুমী স্থানান্তর যা সচরাচর তার প্রজনন এলাকা ও শীতের আবাসের মধ্যে হয়ে থাকে। মেরু গাংচিল তার প্রজনন ক্ষেত্র উত্তর মেরু থেকে শীতের আবাস দক্ষিণ মেরুতে সবচেয়ে লম্বা পথ পাড়ি দেয়। ডোরা-লেজ জৌরালি এক উড়নে প্রায় ১১,০০০ কিলোমিটার উড়ন পথ পাড়ি দিয়ে আলাস্কা থেকে নিউজিল্যান্ডে পরিযায়ন করে।

কর্ণফুলী নদীতে পরিযায়ী ছোট গুলিন্দার ঝাঁক। ছবি- লেখক।

এবার আসা যাক কোন ধরনের পাখিরা এদেশে পরিযায়ন করে?

প্রধানত দুই ধরনের পাখিরা পরিযায়ণ করে। প্রথম ধরন হলো সৈকত, নদী, মোহনা ও জলাভূমির পাখি। কমবেশি ৮২ প্রজাতির পাখি এই ধরনের অর্ন্তভুক্ত; মোট সংখ্যার হিসেবে পরিযায়ী পাখিদের মধ্যে ওদের সংখ্যাই সবচেয়ে বেশি। এদেশে ওরা মূলত ছয়টি উড়নপথ আবাস্থল, যেমন- হাকালুকি, টাঙ্গুয়া ও হাইল হাওর (বাইক্কার বিলসহ), সোনাদিয়া দীপপুঞ্জ, নিঝুম দ্বীপ (দমার চরসহ) এবং গাঙ্গুইরার চর ছাড়াও রাজশাহীর পদ্মা নদী ও চরাঞ্চল, চাঁপাইনবাবগঞ্জের চরইল বিল, যমুনার চর, মেঘনার মোহনা, কাপ্তাই লেক, সুন্দরবন, উপকুলীয় এলাকাব্যাপী বিস্তৃত। সৈকত ও জলচর পাখিগুলোর মধ্যে বেশকিছু মহাবিপন্ন পাখি রায়েছে। যেমন- চামচঠুঁটো চাপাখি, সোনাজঙ্ঘা, মানিকজোড়, খুন্তে বক, বড়ো ভূতিহাঁস, তিলা সবুজ চাপাখি ইত্যাদি।

দ্বিতীয় ধরন হলো বনজঙ্গল, বাগান, কুঞ্জবন ও ঝোপঝাড়ের পাখি। প্রায় ১৫৬ প্রজাতির পাখি এই ধরনের অর্ন্তভুক্ত; মোট প্রজাতির হিসেবে এই ধরনের পাখির প্রজাতি সংখ্যাই সবচেয়ে বেশি। আর ওদের আশ্রয়স্থল সিলেট ও চট্টগ্রাম বিভাগের বিভিন্ন মিশ্র চিরসবুজ বন, কেন্দ্রীয় ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় বিভিন্ন পত্রঝরা বা শালবন, সুন্দরবন ও উপকূলীয় বাদা বন, গ্রামীণ বন, ঝোপঝাড়, ঘাসবন ও বাঁশবনজুড়ে বিস্তৃত।

সোনাদিয়া দ্বীপপুঞ্জের কালাদিয়া চরে পরিযায়ী সৈক পাখির খোঁজে লেখক।

এদেশের অনেককেই বলতে শুনেছি অতিথি পাখি তথা পরিযায়ী পাখিরা আমাদের খাদ্যে ভাগ বসায়, ওদের মলের মাধ্যমে আমাদের পরিবেশ নষ্ট করে, বিভিন্ন রোগ ছাড়ায় ইত্যাদি ইত্যাদি। কাজেই এগুলো শিকার করে খেয়ে ফেলাই ভালো। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এ কথা সত্য নয়। আসলে পরিযায়ী পাখি তো আমাদের কোনো অপকার করেই না বরং প্রকৃতি ও পরিবেশের সৌন্দর্য্য বৃদ্ধির পাশাপাশি ওরা আমাদের প্রভূত উপকার করে। যেমন- কৃষির ক্ষতিকারক পোকমাকড় দমনে সাহায্য করে, ময়লা-আবর্জনা খেয়ে পরিবেশ পরিচ্ছন্ন রাখে, ওদের মল জমির উর্বরাশক্তি বৃদ্ধি করে ও মাছের খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়, এবং পরিবেশের দূষণ নিয়ন্ত্রণ, ভারসাম্য রক্ষা ও পরিবেশ সূচক হিসেবে কাজ করে। এছাড়াও বর্তমানে এদেশের মানুষের মধ্যে পাখি পর্যবেক্ষণের হিড়িক পড়ে গেছে, যা অত্যন্ত জনপ্রিয় বিনোদনমূলক বিষয়। ক্রমবর্ধমান বৈশ্বিক পরিবেশ-পর্যটনের উন্নয়নে এটি সাহায্য করে যা বিলিয়ন ডলার শিল্প হয়ে উঠেছে। কাজেই ধীরে ধীরে এটি দেশের জন্য জৈব-অর্থনীতির সম্ভাব্য একটি উৎস হয়ে উঠছে। প্রতি বছর এদেশে যে সংখ্যক পরিযায়ী পাখি আসে সেগুলোর মধ্যে ৮টি মহাবিপন্ন, ৬টি বিপন্ন ও ৮টি সংকটাপন্ন প্রজাতি।

কাজেই এসব পাখিদের অতিথি না ভেবে আমাদের প্রকৃতি ও পরিবেশের অংশ হিসেবেই বিবেচনা করা উচিত। এ কথা মনে রাখা উচিত যে, এসব পরিযায়ী পাখি শিকার করে ওদের সংখ্যা কমিয়ে দিলে কোনো কোনো মহাবিপন্ন পাখি, এমনকি এদেশ তথা গোটা বিশ্ব থেকেই বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে। আর তা নিশচয়ই আমাদের জন্য ভালো হবে না। কাজেই নিজেদের অস্তিত্বের জন্যই পরিযায়ী পাখি রক্ষায় সকলকেই এগিয়ে আসতে হবে।

E-mail: aminoor69@bsmrau.edu.bd, aminoor69@yahoo.com

 

 

 

এ সম্পর্কিত আরও খবর