কালের বিবর্তনে হারিয়ে যাচ্ছে বগুড়ার মৃৎশিল্প

, ফিচার

মাহবুবা পারভীন, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, বগুড়া | 2023-11-30 12:52:51

বগুড়ার শাজাহানপুর উপজেলার আড়িয়া পালপাড়া গ্রামে প্রবেশ করতেই মাটির মিষ্টি পোড়া ঘ্রাণে মন ভরে যায়। আর গ্রামের রাস্তার দুই পাশে দেখা মেলে মাটির ঢিপি, আর চারিধারে সাজিয়ে রাখা বাহারি মাটির তৈজসপত্র।

গ্রামের নারী, শিশু, বৃদ্ধ বয়সী নারী পুরুষও মৃৎশিল্পের কাজ করেন। সাংসারিক কাজের ফাঁকে তারা বিভিন্ন তৈজসপত্র তৈরিতে ব্যস্ত সময় পার করছেন।

কেউ মাটি কাটছেন, কেউ মাটির গোলা তৈরি করছেন। কেউবা তৈরি করা তৈজসপত্রগুলো চুল্লিতে পোড়াচ্ছেন, আবার কেউ রং করছেন। তবে দই এর সরা গ্লাস, বাটি, খুটিই তাদের বাপ দাদার আমলের পেশাকে টিকিয়ে রেখেছে।


আড়িয়া পালপাড়া গ্রামের মৃৎকারিগর বিশু পাল বলেন, আজ থেকে প্রায় দুই যুগ আগেও তার এখানে তৈরি হতো বড়-ছোট পাতিল, কলসি, সানকি প্রভৃতি। কিন্তু এগুলো আর ক্রেতারা কিনতে আগ্রহী নন বলে তৈরি করা হয় না। তবে দই ব্যবসায়ীদের জন্য তারা এখনও টিকে আছেন। তিনি জানান, এ গ্রামের ১২০টি পরিবার মৃৎশিল্পের সঙ্গে জড়িত। এখানকার দইয়ের জন্য তৈরি সানকি, সারা ও ছোট কাপ বগুড়াসহ গাইবান্ধা এবং কুমিল্লায় বিক্রি করা হয়। একটি পরিবারের প্রায় পাঁচজন মিলে প্রতিদিন এক হাজার দইয়ের গ্লাস তৈরি করা যায়। বিক্রি করা যায় প্রায় এক হাজার ৩০০ টাকায়।

প্লাস্টিক, সিরামিক, মেলামাইন, অ্যালুমিনিয়ামসহ বিভিন্ন ধরণের পণ্যের ভিড়ে কমে গেছে মাটির তৈরি তৈজসপত্রের কদর। আধুনিকতার ছোঁয়ায় বগুড়ার ঐতিহ্যবাহী মৃৎশিল্প প্রায় বিলুপ্তির পথে। তবুও বাপ-দাদার পেশাকে টিকিয়ে রাখতে এখনও অনেকেই কাজ করছেন মৃৎশিল্পী হিসেবে। আল্পনা পাল নামের এক নারীকে দেখা যায় মাটির তৈরি তৈজসপত্র রোদে শুকিয়ে দিতে। আল্পনা বলেন, ' আমার স্বামীর বাপ, দাদা এই মৃৎশিল্পের সাথে জড়িত ছিলেন। আমার স্বামীও মৃৎশিল্পী।'

কল্পনার তিন মেয়ে আর দুই ছেলে। কল্পনার স্বামী মাটির তৈজসপত্র তৈরি করেন আর কল্পনা ও তার ছেলেমেয়েরাও একইভাবে এই কাজ করেন। এই শিল্প ছাড়া তারা অন্য কাজ করতে পারেন না।

সংসারের কাজের পাশাপাশি এই এলাকার অনেক নারীকেই দেখা যায় দই এর হাঁড়ি তৈরি করতে। সুমন নামের এক মৃৎশিল্পী বলেন, ‘মাটির হাঁড়ি পাতিল এখন আর চলে না। ছোটকাল থেকে বাপ দাদার সঙ্গে কাজ করছি। এক সময় মাটির জিনিস খুব ব্যবহার হতো। দস্তা, অ্যালুমিনিয়াম ও প্লাস্টিকের জিনিস বের হওয়ায় এখন মাটির জিনিস চলে না। এই শিল্পের সঙ্গে যারা আমরা রয়েছি তাদের চলা খুবই কষ্ট।' 

মাটির যেকোনো পাত্র তৈরিতে কাদা প্রস্তুত করতে হয় প্রথমে। এরপর নির্দিষ্ট পণ্যের জন্য প্রস্তুতকৃত কাদা গোল্লা বা চাকা তৈরি করতে হয়। পরে তা চাকার মাঝখানে রাখা হয়। চাকা ঘুরতে ঘুরতে মৃৎশিল্পীদের নিপুণ হাতের ছোঁয়ায় মাটি হয়ে ওঠে আকর্ষণীয় তৈজসপত্র। এরপর তা শুকিয়ে স্তুপ আকারে সাজিয়ে চুল্লিতে নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় পোড়ানোর পর পণ্যের গায়ে রঙ করতে হয়। বিলুপ্ত প্রায় এই পেশাটি বেশ যত্নের সাথে আগলে রেখেছেন মৃৎশিল্পীরা।

মৃৎশিল্পীদের ভাষ্যমতে, মাটির তৈরি অন্যান্য পণ্যের কদর এখন তেমন না থাকলেও দইয়ের সরা ও হাঁড়ি-পাতিলের চাহিদা দিন দিন বেড়েই চলেছে। দইয়ের জন্য বিখ্যাত হওয়ায় বগুড়ায় এর ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। বলা যায়, এই দইয়ের পাত্রের চাহিদার উপর নির্ভর করেই জেলার মৃৎশিল্প টিকে আছে।


তারা বলেন, দই-এর পাত্র তৈরি করেই টিকে আছে আমাদের পাল পাড়ার দুই হাজার পরিবার। সনাতন পাল নামের একজন মৃৎশিল্পী বলেন, 'এখন সব জিনিসের দাম বেশি। মাটির দাম বেশি, লাকরি, খরির দাম বেশি তাই আমাদের খুব বেশি লাভ হয়না। তবুও এই বাপ, দাদার পেশাকে টিকিয়ে রাখতে আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি।' 

জানা যায়, প্রতিদিন শত শত মণ দই তৈরি হয় এ জেলায়। দই সাধারণত মাটির তৈরি পাত্রেই রাখা হয়। বগুড়া জেলার চাহিদা মিটিয়ে এই দই এবং এর পাত্রও বিভিন্ন জেলায় যায়। আর সে কারণেই জিবীকা নির্বাহের জন্য এখনও এই পেশাকে ধরে রাখার চেষ্টা করছেন জেলার অনেক মৃৎশিল্পী।
মৃৎশিল্পীরা বলেন, একটি দইয়ের পাতিল বানাতে ৩০ টাকা, সড়া বানাতে ৬ টাকা ও কাপ বানাতে ৪ টাকার মতো খরচ হয়। স্থানীয় বাজারে এসব দইয়ের পাতিল ৫০ টাকা, সড়া ৮-১০ টাকা ও কাপ ৯ টাকায় বিক্রি করা হয়।


বগুড়া সদরের নন্দীগ্রাম, শেখেরকোলা ও গাবতলী উপজেলায় গিয়েও দেখা মেলে এই পাল পাড়া। এইসব গ্রামে ঘুরে জানা গেল, মৃৎশিল্পের সঙ্গে জড়িতদের জীবন ধারণের কথা। তারা জানালেন, মাটির কলস, হাঁড়ি, দইয়ের সড়া, বাসন, পেয়ালা, সুরাই, মটকা, পিঠা তৈরির নানা ছাঁচসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস আগে বাসাবাড়িতে গ্রহণযোগ্য ছিল। বর্তমানে এসব তৈজসপত্রের ব্যবহার গ্রামে চললেও শহরে ব্যবহার বিলুপ্ত প্রায়। তাই তাদের আয়-রোজগারও এখন কমে গেছে। তবে দইয়ের সড়া ও হাঁড়ির ব্যবহার এখনও আছে। ফলে এ শিল্পটিকে আঁকড়ে টিকে থাকার আশার আলো এখনো দেখেন তারা।

এই মৃৎশিল্পকে ধরে রাখার বিষয়ে জানতে চাইলে বগুড়া বিসিক উপ-মহাব্যবস্থাপক এ কে এম মাহফুজুর রহমান বলেন, ‘আধুনিকতার ছোয়ায় হারিয়ে যাওয়ার পথে এই শিল্পটি। এই শিল্প হারিয়ে গেলে মৃৎশিল্পীরা বিপদগ্রস্ত হবেন। তাই মৃৎশিল্প টিকিয়ে রাখতে বিভিন্ন পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। শিল্পীদের আর্থিক সহায়তা দেওয়ার পাশাপাশি স্বল্প সুদে ঋণ প্রদানসহ বিভিন্ন সহযোগিতা করা হবে বলেও জানান তিনি।' 

এ সম্পর্কিত আরও খবর