পৃথিবীর নজিরবিহীন নারকীয় নৃশংসতা চালানোর পরও আত্মসমর্পণকারী হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর যুদ্ধবন্দি সেনাদের সঙ্গে আন্তর্জাতিক রীতিনীতি মেনে জেনেভা কনভেনশনে নির্দেশিত মানবিক আচরণ করেছিল মিত্রবাহিনীর সদস্যরা। কিন্তু একটি বর্বর সেনাদলের মজ্জাগত আচরণে যে কোন পরিবর্তন হয় না, সেই প্রমাণও দিয়েছিল পাকিস্তানি সেনা সদস্যরা। যার ফলে আত্মসমর্পণের পরও তারা বাঙালি এক কর্ণলকে হত্যার চেষ্টা চালিয়েছিল এবং তা নিয়ে সৃষ্ট উত্তেজনা নিরসনে ভারতীয় সেনাবাহিনীকে প্রচেষ্টা নিতে হয়েছিল।
আমরা অন্বেষণের চেষ্টা করেছি, একাত্তরের সেই উত্তাল দিনগুলির অনেক ঘটনাপ্রবাহে আরও নূতন কিছু জানবার। মুক্তিযুদ্ধ ও ইতিহাস অনুসন্ধিৎসুদের জন্য সেই সময়ের ভারতীয় গণমাধ্যমের বিরল কিছু প্রতিবেদন ও সম্পাদকীয় নিবন্ধে প্রকাশিত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আমরা তুলে আনতে সক্ষম হয়েছি।
কলকাতার তৎকালীন প্রভাবশালী দৈনিক (অধুনালুপ্ত) যুগান্তর ১৭ ডিসেম্বর ১৯৭১-এ ‘রাহুমুক্ত বাঙলাদেশ’ শীর্ষক সম্পাদকীয়তে মর্মস্পর্শী এক আখ্যান রচনা করে। দৈনিকটি সেই সম্পাদকীয়তে লেখে, ‘বাংলাদেশ শান্ত। তার সব রণাঙ্গন স্তব্ধ। জওয়ানদের শাণিত অসি কোষবব্ধ। তাদের কামানের মুখ থেকে আর মৃত্যু বেরিয়ে আসবে না। মুক্তিবাহিনীর রণহুঙ্কারে আর পাকদুষমনদের বুক কেঁপে উঠবে না। নিঃশর্তে আত্মসমর্পণ করেছেন লেঃ জেনারেল নিয়াজী। যাঁরা এতদিন বাংলাদেশে চালিয়েছে গণহত্যা এবং নারীধর্ষণ, তারা ভূলুণ্ঠিত। মার্কিন সপ্তম নৌবহর রক্ষা করতে পারেনি তাদের।’
মুক্তিযোদ্ধা ও ভারতীয় সেনাদের মানবিক সত্ত্বার পরিচয় মেলে ধরে ওই সম্পাদকীয়তে আরও লেখা হয়, ‘জওয়ান ও মুক্তিযোদ্ধারা মানুষমারা যন্ত্র নয়। গণতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় নেমেছিল তারা লড়াই-এর ময়দানে। তাদের বিজয় সম্পূর্ণ। দখলদার বাহিনীর হৃদ্পিণ্ড ঢাকা আজ রাহুমুক্ত। যেখানে উড়ত নরপশু ইয়াহিয়ার ঘৃণিত পতাকা, সেখানে উড়ছে স্বাধীন বাংলাদেশের জয়ধ্বজা। লক্ষ লক্ষ নরনারী তাকে জানাচ্ছে সেলাম। পদানত শত্রু বিজয়ীর কৃপা-ভিখারী। জেনেভা কনভেনশনের যুদ্ধ-বন্দীর মর্যাদা পাবে ওরা। যারা চালিয়েছে নিরস্ত্র জনতার উপর অকথ্য অত্যাচার, তাদের ভাগ্যে জুটবে মানবতার উদার ব্যবহার। বর্বর পশ্চিম পাকিস্তান নয়, ভারত এবং বাংলাদেশ। তারা দিয়েছে জেনেভা কনভেনশন মেনে চলার প্রতিশ্রুতি। এ-প্রতিশ্রুতির খেলাপ হবে না।’
পাকিস্তানের বর্বরতার অনুপুঙ্খ বিবরণও ফুটে উঠে তাতে, ‘মনে পড়ে গত ২৫শে মার্চের বিভীষিকার কথা। পাক ঘাতকদের গুলিতে প্রাণ হারিয়েছিল হাজার হাজার নিরপরাধ মানুষ। মনে পড়ে টিক্কা খানের নারকীয় তাণ্ডবের কথা। জন জনপদ পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। কত ধর্ষিতা নারী আকুল হাহাকারে বাতাস ভারাক্রান্ত হয়ে উঠেছে। মনে পড়ে গৃহতাড়িত মানুষের মিছিল। তারা চলছে। দৃষ্টি ভারত-সীমান্ত। এখানে এলে তারা পাবে নিরাপদ আশ্রয়। এই সর্বহারার মিছিলগুলোও নিস্তার পায়নি ইয়াহিয়ার নেকড়েদের কবল থেকে। যখন-তখন চলেছে তাদের উপর মেশিনগানের গুলি। এক সর্বনাশা হত্যার উৎসবে মেতে উঠেছিল জানোয়ারগুলো। কোথায় আজ তাদের রণহুঙ্কার। সব আস্ফালনের অবসান ঘটেছে। ওরা কৃপা প্রার্থী।’
আত্মসমর্পণের পরেও বদলায়নি হানাদারদের চরিত্র
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গোড়াপত্তনের পর থেকে এর সেনাদের যে উগ্রতার শিক্ষা দিয়ে গড়ে তোলা হয়েছিল পরবর্তী সময়গুলোতেও তাদের চরিত্রে তার স্বাভাবিক বহিঃপ্রকাশ লক্ষনীয়। বিশেষ করে পাক সেনাবাহিনীর সেনাধ্যক্ষদের নৈতিক মূল্যবোধে সামান্যতম পরিচয় মেলেনি। মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় সেনাদের কাছে পর্যুদস্ত হয়ে সর্বস্ব খুইয়েও তাদের সামান্য আত্মশুদ্ধি যে আসেনি তার একটি বড় প্রমাণ সেই সময়ের যুগান্তরের এক প্রতিবেদনে উঠে আসে।
২০ ডিসেম্বর ১৯৭১-এ প্রকাশিত যুগান্তরে সুখরঞ্জন সেনগুপ্তের সেই প্রতিবেদনে প্রকাশ, ‘আত্মসমর্পণকারী পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যদের একটি বিরাট অংশ অস্ত্র সমর্পণ না করায় এবং গত সন্ধ্যায় পশ্চিম পাকিস্তানি সৈনিকেরা তাদের ব্যারাক থেকে ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের একজন কর্ণেলকে হত্যা করার চেষ্টা করলে কাল রাত্রে ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় প্রচণ্ড উত্তেজনা দেখা দেয়। মুক্তিবাহিনীর একটি প্লাটুন ক্যান্টনমেন্টে প্রবেশ করে পশ্চিম পাকিস্তানিদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে চায়। ভারতীয় সামরিক বাহিনীর কর্তৃপক্ষ অনেক চেষ্টা পর তাদের নিবৃত্ত করে।’
‘এই ঘটনার পর আজ সকালে ক্যান্টনমেন্টে গলফ কোর্সে ভারতীয় বাহিনী পাকিস্তানি সৈন্যদের কাছ থেকে অস্ত্র জমা নিতে আরম্ভ করেছে। আজ যাদের কাছ থেকে অস্ত্র জমা নেওয়া হয়, তারা সকলেই লেফটেন্যান্ট থেকে বিগ্রেডিয়ার পর্যন্ত অফিসার শ্রেণির লোক। জানা গেছে, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রায় এক লক্ষ অফিসার ও সৈন্য বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে ভারতীয় কমান্ডারদের কাছে অস্ত্র সমর্পণ করেছে।
মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের প্রধান মিত্র ভারতের জনগণের মাঝে যে উন্মাদনা সৃষ্টি হয়েছিল বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামকে ঘিরে তা ইতিহাসে বিরল। অভিন্ন ভাষা ও সংস্কৃতির মিলের সঙ্গে ঐতিহাসিকভাবে এক দেশ হওয়ার কারণেই বোধহয় এই পরম মমত্ববোধ সেদিন দেখা দিয়েছিল ভারতের জনগণের মাঝে।
‘আসুক সপ্তম নৌবহর, আসুক চীনারা-মা ভৈঃ’ শীর্ষক প্রতিবেদনে ধরা দিয়েছে তারই প্রতিচ্ছবি। সেই প্রতিবেদনে প্রকাশ, ‘সাধারণ মানুষের মনোবল আজ কি উচ্চ পর্যায়ে উঠেছে-ট্রামে-বাসে কান পাতলে তা বোঝা যায়। মঙ্গলবার আমেরিকার সপ্তম নৌবহর ও চীনাদের সৈন্য চলাচল নিয়ে উত্তেজিত আলোচনা চলেছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা গেল, একটু ভীরু প্রকৃতির লোক চিরাচরিত অভ্যাসমতো কথাটার অবতারণা করেছেন এইভাবেঃ সবই তো হল, ঢাকাও না হয় মুক্ত হল, কিন্তু বিশ্বযুদ্ধ বাধে যে!’
গল্পচ্ছলে প্রকাশিত সেই প্রতিবেদেনে আরও প্রকাশ, ‘কি রকম?/কাগজে দেখেন নি মার্কিন নৌবহর আর চীনারা তৈরী হচ্ছে।/তাতে কি হল?/তাতে কি হল কি মশাই, তাতে সবই হল। দুই সাক্ষাৎ নামলে আর রক্ষে আছে?/কি করবে, যুদ্ধ?/বলা বাহুল্য হাওয়া খেতে তো আসবে না।/ঐ হাওয়া খেয়েই যেতে হবে।/বলেন কি, আমেরিকা!/হ্যা হ্যা, ওটা গোদাপায়ের লাথি!
‘‘জানেন না গল্পটা?/না তো।/শুনুন তবে। ধরুন হাওড়ার পুলের কোন এক প্রান্তে একটি লোক বসে আছে। তার একটি পায়ে ভয়াবহ গোদ। সে লোকের কাছে ভিক্ষে চাইত। না দিলে বলত, মারব গোদা পায়ের লাথি। লোকে ভয়ে এক আধটা পয়সা দিয়েই দিত। একদিন এক বেয়াড়া লোক বলল, মার দেখি তো তোর গোদাপায়ের লাথি। লোকটাও চটেমটে সবকিছু ভুলে উঠল, ভারী পা-টা তুলতেই নিজেই টাল খেয়ে পড়ে গেল।’’
‘‘যিনি প্রশ্ন করেছিলেন, তিনিও চটেমটে বললেন, কি কথায় কি কথা।/যিনি জবাব দিচ্ছিলেন, তিনি বললেন, বেশ তবে মিলিয়ে দেখুন গোদাপ উত্তর ভিয়েতনামের উপর মার্কিন হামলাটা।/কি হয়েছে?/কি হয়নি তাই বলুন। একে বারে যারে বলে ন্যাজে-গোবরে। এখন ছেড়ে দে মা-কেঁদে বাঁচি। প্রচারের হিসেবটা যদি মানতে হয়, তবে তো এদ্দিনে উত্তর ভিয়েতনাম পাউডার হয়ে যাওয়ার কথা, একটা প্রাণী কেন; একটা ঘাসেরও অস্তিত্ব থাকা উচিত ছিল না। কিন্তু আশ্চর্য ওরা বেঁচে আছেন এবং প্যারিসে যখন শান্তি বৈঠক বসল ওরা ডাঁটের মাথায় মার্কিনী কুটনীতিকদের নাস্তানাবুদ করে তুললেন।’’