অতিথি পাখির গুঞ্জনে মুখরিত চলনবিল

, ফিচার

সুজন সরকার, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেট, বার্তা ২৪.কম, সিরাজগঞ্জ | 2023-12-17 14:09:40

 

অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত চলনবিল এখন মুখরিত নানা জাতের পাখিদের গুঞ্জনে। প্রতি বছরের মতো এবারও এখানে খাবারের সন্ধানে ঝাঁকে ঝাঁকে ছুটে এসেছে রং-বেরঙের নানা আকৃতির বাহারি প্রজাতির পাখি। কয়েক হাজার কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে মিঠা পানির মাছসহ বিভিন্ন অতিথি পাখির সমাগম হয়েছে বিলটিতে।

এবারও শীত মৌসুমে অতিথি পাখির গুঞ্জনে মুখরিত হয়ে উঠেছে দেশের সর্ববৃহৎ বিলাঞ্চল সিরাজগঞ্জের চলনবিল। বিলে পাখিদের কোলাহল, কলরব, ডানা মেলে অবাধ বিচরণে সকলেরই দৃষ্টি আকর্ষণ করে। অতিথি ও দেশি পাখিদের আগমনে পুরো চলনবিল এলাকাই এখন  খুব দৃষ্টিনন্দন।

চলনবিলের ইতিকথা গ্রন্থ সূত্রে জানা যায়, রাজশাহী বিভাগের ৬ জেলার ১ হাজার ৮৮ বর্গকিলোমিটার এলাকা নিয়ে ছিল চলনবিল। বর্তমানে সিরাজগঞ্জ, পাবনা ও নাটোরের তিন জেলার ১০টি উপজেলার, ৬২টি ইউনিয়নের ১ হাজার ৬০০ গ্রাম নিয়ে বৃহত্তর চলনবিল। বিলে রয়েছে ২১টি নদ-নদী, ৭১টি নালা-খাল ৯৩টি ছোট বিল। ১৮২৭ সালে জনবসতি এলাকা বাদ দিয়ে চলনবিলের জলমগ্ন অংশের আয়তন ছিল ৫০০ বর্গ মাইলের বেশি। ১৯০৯ সালে চলনবিল জরিপের এক প্রতিবেদনে চলনবিলের আয়তন দেখানো হয় ১৪২ বর্গমাইল। এর মধ্যে ৩৩ বর্গমাইল এলাকায় সারা বছর পানি জমে থাকে। যদিও অনেকগুলোর অস্তিত্ব এখন আর পাওয়া যাবেনা। চলতি মৌসুমে পানি শুকিয়ে যাওয়ায় চলনবিলের নিজের আহার জোগাতে বক, ইটালি, শর্লি, পিয়াজ খেকো, ত্রিশুল,বাটুইলা, নারুলিয়া, লালস্বর, কাঁদোখোচা, ফেফি, ডাহুক, বালিহাঁস, পানকৌড়ি, শামকৈলসহ বিভিন্ন প্রজাতির অতিথি পাখির ঝাঁকে ঝাঁকে আগমন করছে। ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহ পর্যন্ত এই সকল পাখি চলনবিলের বিভিন্ন মাঠে ও গাছে অবস্থান করে। সকাল থেকেই খাবারের খোঁজে ভিড় করে বক, বালিচোরা, পানকৈড় রাতচোরাসহ নানা প্রজাতির পাখি। কিছু দেশি প্রজাতির পাখি সবসময় থাকে এই বিলে।

রোববার (১৭ ডিসেম্বর) সকালে স্থানীয়রা জানান, ‘বর্তমানে পাখিপ্রেমীরাও হরেক রকম পাখি দেখতে আসছেন এ বিলে। চলনবিলে সাধারণত রাতচরা, হারগিলা, ভাঁড়ই, ছোট সারস, বড় সারস ,কাঁদোখোঁচা, নলকাক, ডাহুক, হুটটিটি, চখাচখি, বুনোহাঁস, বালিহাঁস, বকসহ বিভিন্ন প্রজাতির পাখি দেখা যায়। তবে এ বছর বালিহাঁস, বক ও রাতচরা প্রজাতির পাখি বেশি দেখা মিলছে। কিন্ত এক শ্রেণির অসাধু পাখি শিকারি সুযোগে জাল ও খাঁচার মাধ্যমে অতিথি পাখি শিকার করছে। অবাধে পাখি শিকার করা হলেও স্থানীয় প্রশাসন ব্যবস্থাই নিচ্ছে না। এতে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। প্রত্যন্ত বিলাঞ্চলের বিভিন্ন স্থানে প্রতিটি বক ১০০ থেকে ১৫০ টাকা, রাতচোরা ৩০০ থেকে ৪৫০ টাকা জোড়া, বালিহাঁস ৪০০ থেকে ৬০০ টাকা দরে বিক্রি করছে।’

তাড়াশের বারো হাঁস গ্রামের আলামিন  বলেন, প্রশাসন ও পরিবেশ কর্মীদের সচেতনতায় পাখি শিকার অনেকটাই বন্ধ হওয়ায় আগের চেয়ে বিলে পাখির সংখ্যা বাড়ছে। তবে কিছু অসাধু শিকারী এখনও রাতের বেলায় পাখি শিকার করছেন। এসব বন্ধের দাবী জানাই।

চলনবিলে পাখি দেখতে ও ছবি তুলতে আসা কামাল ও আরিফ জানান, ‘আমরা শাহজাদপুরের কৈয়জুড়ি গ্রাম থেকে এসেছি। শীতের এই মৌসুমে প্রতি বছরই পাখি দেখতে চলনবিলে আসি। চলনবিলে বিভিন্ন প্রজাতির পাখি দেখতে ভালো লাগে।’

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. নজরুল ইসলাম বলেন, পাখি শুধু প্রকৃতির শোভা বর্ধন করে না, প্রকৃতির ভারসাম্যও রক্ষা করে। বিভিন্ন ধরনের পোকামাকড় খেয়ে এরা কৃষকের উপকার করে। কিন্তু আইন থাকলেও পাখি নিধন বন্ধে তেমন কোনো পদক্ষেপ নেই। অবাধ পাখি শিকার করায় পরিবেশের ওপর প্রভাব পড়ছে ও জীববৈচিত্র্য বিপন্ন হয়ে পড়েছে।

চলনবিল জীববৈচিত্র্য রক্ষা কমিটির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের কারণেই মূলত চলনবিলে পাখির বিচরণ আর আগের মত নাই। চলনবিলে আগের মত দীর্ঘসময় পানি থাকে না। এছাড়া কৃষি আবাদে যত্রতত্র কীটনাশক ব্যবহার করায় পাখিসহ বিলের জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে। সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে খাল খননের পাশাপাশি বিলের নিচু এলাকায় মাছ ও পাখির অভয়াশ্রম হিসেবে ঘোষণা করতে হবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমরা মূলত পাখি শিকারিদের নিষেধ ও পাখি অবমুক্ত করে থাকি। এতে পাখি শিকারিরা ততোটা ভয় পায় না। কয়েক বছরে প্রায় দুই হাজারের বেশি শিকার করা পাখি উদ্ধার করে অবমুক্ত করেছি। প্রশাসন এ বিষয়ে একটু নজর দিলে কেউ আর অবাধে পাখি শিকার করতে পারবে না।’

দি বার্ডস সেফটি হাউজের চেয়ারম্যান মামুন বিশ্বাস বলেন, মৎস্য ভান্ডার খ্যাত চলনবিল অঞ্চলে স্বেচ্ছাসেবীরা শিকার করা পাখি অবমুক্ত করলেও তৃণমূল পর্যায়ে সরকারি-বেসরকারি সমন্বয়ের অভাবে এ বিলে স্থায়ীভাবে পাখি শিকার বন্ধ করা সম্ভব হচ্ছে না।

সিরাজগঞ্জ বন বিভাগের কর্মকর্তা হাসান মাহমুদ জানান, প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইন কার্যকর করার মতো সরকারি জনবল নেই। আগত পাখি গুলো জনগণ সচেতন না হলে কোনোভাবেই নিধন বন্ধ করা সম্ভব নয়।

জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মোঃ ওমর ফারুক বলেন, পাখিসহ বন্যপ্রাণী রক্ষায় যে যার অবস্থান থেকে ভূমিকা রাখতে হবে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ও প্রশাসনের নজরদারি রাখতে হবে। শিকারিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলে চলনবিলে পাখি নিধন বন্ধ হবে। তা না হলে আগামীতে বন্যপ্রাণীর নাম শুধু কাগজে-কলমেই থাকবে।

তাড়াশ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘শীত প্রধান দেশ থেকে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে এসব পরিযায়ী পাখি আমাদের চলনবিলসহ দেশের হাওর-বাওর ও নদী এলাকায় আসে। আমরা শুধু শীতের অতিথি পাখি নয় দেশী প্রজাতিসহ সব ধরনের পাখি শিকার বন্ধে সবসময়ই মনিটরিং করছি। জনসচেতনতা বাড়াচ্ছি। পাখি আমাদের পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে। আশা করছি আগামীতে চলনবিলে পাখির সংখ্যা আরও বাড়বে।’

এ সম্পর্কিত আরও খবর