বিশ্বের প্রাচীনতম কোম্পানিগুলোর টিকে থাকার রহস্য!

, ফিচার

সানজিদা খান, নিউজরুম এডিটর, বার্তা২৪.কম | 2023-12-27 12:51:56

জাপানে ৫৭৮ খ্রিস্টাব্দে অনেকগুলো কোম্পানি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল যেগুলো বিশ্বের প্রাচীনতম কোম্পানী হিসেবে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। প্রাচীন এই কোম্পানীগুলোর সফলতা ও টিকে থাকার রয়েছে দীর্ঘ ইতিহাস।

৫৭৮ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত একটি জাপানি নির্মাণ সংস্থা কঙ্গো গুমি বা সান্তা মারিয়া নোভেলা এবং একটি ইতালীয় ফার্মেসি যেটি মাইকেলেঞ্জেলোর সিলিং সাজানোর সময় থেকে অভিজাতদের সুগন্ধি সরবরাহ করে আসছে। এমন দুইটি কোম্পানীর দীর্ঘদিনের ব্যবসায়িক অভিজ্ঞতা সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে।

কঙ্গো গুমি কোং:  প্রতিষ্ঠাকাল আনুমানিক ৫৭৮ খ্রিস্টাব্দ

মূলমন্ত্র: প্রাচীন এ প্রতিষ্ঠানটির টিকে থাকার মূলে রয়েছে এর শ্রমিকদের দক্ষতার যথাযথ মূল্যায়ন। প্রতিষ্ঠানকে দীর্ঘমেয়াদে এগিয়ে নিয়ে যেতে হলে শ্রমিকদের কাজের যথাযথ মূল্যায়ন করতে হবে।

২০০৬ সালে পর্যন্ত কঙ্গো গুমি ছিল বিশ্বের প্রাচীনতম অপারেটিং কোম্পানি। এরপর এটি তাকামাতসু কনস্ট্রাকশন গ্রুপের সহায়ক সংস্থা হিসেবে পরিচালিত হয়ে আসছে। তবে আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে সহায়ক কোম্পানি হয়েও এটি এখনও সেই পুরানো আঙ্গিকেই তাদের নির্মাণ কার্যক্রমগুলো পরিচালনা করে থাকে। তাদের কাজের বিশেষত্ব হল বৌদ্ধ মন্দির এবং অন্যান্য ঐতিহাসিক ভবনের পুনরুদ্ধার।

এই প্রতিষ্ঠানে শ্রমিকদের ১০ বছর পর্যন্ত প্রশিক্ষণ দেয়া হয়ে থাকে। পরবর্তীতে তাদের মধ্যে কারিগরি দক্ষতা প্রদর্শনের জন্য প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। কে কতটা দক্ষতার সাথে মন্দির নির্মাণ করতে পারে তার পরীক্ষা নেয়া হয়। মূলত এইসব ঐতিহ্যবাহী মন্দির নির্মাণে ব্যবহৃত কাঠ এবং কাদামাটির সাথে কতটা নিপুনভাবে কাজ করতে পারে তা দেখার জন্য এই প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়ে থাকে।

জর্জিয়া ইনস্টিটিউটের একজন আর্কিটেকচার প্রফেসর ড্যানিয়েল উইলকেনস বলেন, ‘আমি মনে করি, এখানেই অন্যান্য অনেক ঐতিহ্য বা পেশাদার কারিগরের দক্ষতায় ফাটল ধরে গেছে। কারণ যথাযথ মূল্যায়নের অভাবে এসব কারিগররা তাদের দক্ষতার বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে পারে নি। কিন্তু কঙ্গো গুমি তাদের এই অভিনব কৌশলগুলোর মাধ্যমে নিজেকে জাপানি স্থাপত্যের সংরক্ষণের জন্য শীর্ষ কোম্পানীর জায়গা দখল করে নিয়েছে।’

সেন্ট পিটার স্টিফ্টস্কুলিনারিয়াম: প্রতিষ্ঠাকাল আনুমানিক ৮০৩ খ্রিস্টাব্দ

মূলমন্ত্র: এই কোম্পানীর ব্যবাসায়িক অভিজ্ঞতা থেকে এটাই শিক্ষণীয়, একাধিক কোম্পানীর সাথে একীভূত হওয়া বা সহায়ক প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচালিত হওয়া কোম্পানীর জন্য ইতিবাচক।  

শার্লেমেনের একজন রাজ দরবারী ইউরোপের সেরা ওয়াইন (মদ) সংগ্রহকারী হিসেবে খুব জনপ্রিয় ছিলেন। সেই সময়ে সেন্ট পিটার স্টিফ্টসকুলিনারিয়াম নামে একটি রেস্তোরাঁ ১২’শ বছরেরও বেশি সময় ধরে অস্ট্রিয়ার সালজবার্গে নৈশভোজের আয়োজন করতো। যদিও এটি বিশ্বের প্রাচীনতম রেস্তোরাঁ নয় তবে এটি সেই সময়ে বিখ্যাত রেস্তোরাঁগুলোর মধ্যে একটি ছিল।

সেন্ট পিটারের প্রচার প্রতিনিধি নোরা ওয়ান্ডারওয়াল্ড বলেছেন, মূলত ওয়াইন সেলার থেকেই সেন্ট পিটার স্টিফ্টস্কুলিনারিয়াম রেস্তোরাঁর উৎপত্তি হয়েছে। ওয়াইন সেলারটি প্রথমে সন্ন্যাসীদের ধন-সম্পদ সঞ্চয় করার জন্য নির্মাণ করা হয়েছিল। পরবর্তীতে সেটি সেন্ট পিটারের পৃষ্ঠপোষক যারা মদ পান করতেন তারা ওয়াইনের সাথে কিছু খাবার খাওয়ারও প্রয়োজন অনুভব করেন। আর সেখান থেকেই রেস্তোরাঁটি তৈরির উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। 

রেস্তোরাঁর বর্তমান অপারেটর ভেরোনিকা কির্চমায়ার এবং ক্লজ হাসলাউয়ার রেস্তোরাঁটির মেনুতে বৈচিত্র্য আনতে খুব চেষ্টা করছেন। ক্রিসমাস উপলক্ষে এ মাসে তারা বিশেষ অফারের ব্যবস্থা করেছেন। অফারগুলোর মধ্যে রয়েছে চারের একটি কনফিট ফিললেট, আর্টিকোক ওয়েলিংটন এবং শার্লেমেনের উদ্ভাবনকারী এমন কিছু খাবার যা দেশটির খাদ্যরসিকদের বিস্মিত করবে।

ওল্ডে বেল:  প্রতিষ্ঠাকাল আনুমানিক ১১৩৫ খ্রিস্টাব্দ

মূলমন্ত্র: এ প্রতিষ্ঠানটির ব্যবসায়িক সফলতার সূত্র হচ্ছে সময়ের পরিক্রমায় প্রতিষ্ঠানের আসবাবপত্র পরিবর্তন হতে পারে, কিন্তু পরিষেবা পরিবর্তন করা যাবে না।

ওল্ডে বেল একটি প্রাচীন রেস্তোরাঁ। সম্ভবত রাজা স্টিফেনের শাসনামলে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। সেই সময় ওল্ডে বেল গেস্ট কোয়ার্টার এবং আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হতো। ক্লান্ত ও তৃষ্ণার্ত ভ্রমণকারীরা সেখানে বিশ্রাম নিতেন এবং আরামদায়ক গদিতে বসে মদ পান করতেন।

এখনো লন্ডনের বাইরে প্রায় ৩৫ মাইল দূরে অবস্থিত ওল্ডে বেল হোটেলে প্রবেশ করলে আপনি পেতে পারেন রাজকীয় আপ্যায়ন।

ওল্ডে বেলের বর্তমান সেলস ম্যানেজার দেবী হেইস বলেন, ‘এখনও আমাদের কাছে আরামদায়ক গদি আছে। উইনস্টন চার্চিল, বরিস কার্লফ, ফ্র্যাঙ্কলিন ডেলানো রুজভেল্ট এবং এলিজাবেথ টেলর সবাই আমাদের হোটেলের আরামদায়ক কক্ষ এবং আরামদায়ক বারে সময় কাটিয়েছেন।’

সান্তা মারিয়া নভেলা: প্রতিষ্ঠাকাল আনুমানিক ১৬১২ খ্রিস্টাব্দ (ফার্মেসি ১৫৪২ খ্রিস্টাব্দ থেকে)।

মূলমন্ত্র: বিশেষ পণ্য বিশেষ উপলক্ষেই তৈরি করা উচিত।

‘অফিসিনা প্রফুমো-ফার্মাসিউটিকা ডি সান্তা মারিয়া নভেলা’ অন্যতম জনপ্রিয় একটি সুগন্ধি ব্র্যান্ড। এই ব্র্যান্ডের আকুয়া ডেলা রেজিনা এখনও সান্তা মারিয়া নোভেলার সর্বাধিক বিক্রিত পণ্যগুলোর মধ্যে একটি। যা এখনো ক্রেতারা পেলেই লুফে নিতে চায়৷

১৫৩৩ সালে রাজকন্যা ক্যাথরিন তার বিয়েতে হবু স্বামীর জন্য উপহার হিসেবে সুগন্ধি দিতে চেয়েছেন। তখন তার জন্য একটি সুগন্ধি প্রস্তুত করা হয়েছিল যেটি ফ্রান্সের আদালতকে পর্যন্ত বিমোহিত করেছিল। আর সেই সুগন্ধি প্রস্তুতকারী ব্যক্তিটি সান্তা মারিয়া নভেলার অধিবাসী ছিলেন। পরবর্তীতে সেখান থেকেই সান্তা মারিয়া নামে সুগন্ধি প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানটি গড়ে ওঠে।

ব্রুকস ব্রাদার্স: প্রতিষ্ঠাকাল আনুমানিক ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দ

মূলমন্ত্র: এ প্রতিষ্ঠানটির ব্যবসায়িক কৌশল ছিল মূল গ্রাহকদের উপর ফোকাস করা। আর এখান থেকে শিক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে গ্রাহকদের চাহিদাকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে।

লোয়ার ম্যানহাটনে একটি ছোট পোশাক প্রস্তুতকারক এবং দোকান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত, ব্রুকস ব্রাদার্স প্রায় ২’শ বছর ধরে স্কুলের ছাত্রছাত্রী এবং ওয়াল স্ট্রিট ব্যাঙ্কারদের স্টার্চড শার্ট ও নীল ব্লেজার সরবরাহ করে আসছে।

২০২০ সালের শেষের দিকে যখন কেন ওহাশি কোম্পানির দায়িত্ব গ্রহণ করেন, তখন মানুষের নিত্য প্রয়োজনীয় পোশাক সরবরাহের উপর নির্ভরশীল ব্র্যান্ডটির জন্য এক অদ্ভুত মুহূর্তের সৃষ্টি হয়।

করোনাকালীন সেই সময়টিতে ওহাশির জন্য বড় চ্যালেঞ্জ ছিল ব্র্যান্ডটিকে ধরে রাখা। এজন্য সে এক অভিনব কৌশল অবলম্বন করেন। আর এটাই ছিল তার প্রতিষ্ঠানটিকে দীর্ঘস্থায়ী করার মূল চাবিকাঠি। সে তার নিয়মিত গ্রাহক যারা আছেন তাদের প্রয়োজনকে জানার চেষ্টা করলেন।

ওহাশি বলেন, ‘গ্রাহকদের চাহিদা অনুযায়ী দৈনন্দিন পরিধানের জন্য বড় আকারের ডোরাকাটা রাগবি শার্ট এবং জান্টি শিকারী কুকুরের সাথে এমব্রয়ডারি করা কর্ডুরয় প্যান্টের মতো আইটেমগুলো তৈরি করেন। এতে কোম্পানির লাভের পরিমাণ ২০ থেকে ৪০ শতাংশ বেড়ে যায়।’  

একত্রিত এডিসন, প্রতিষ্ঠাকাল আনুমানিক ১৮২৩ খ্রিস্টাব্দ (নিউ ইয়র্ক গ্যাস লাইট কোম্পানি হিসেবে)

মূলমন্ত্র:  প্রতিষ্ঠানটির ব্যবসায়িক সফলতার মূল চাবিকাঠি হলো এর ব্যবসায়িক অবস্থান। এখান থেকে শিক্ষণীয় এটাই যে কখনো প্রতিষ্ঠানের ব্যবসায়িক অবস্থান পরিবর্তন করা যাবে না। 

কনএড নিউ ইয়র্ক স্টক এক্সচেঞ্জের তালিকাভুক্ত সবচেয়ে পুরানো অপারেটিং কোম্পানি। এটি থমাস এডিসনের জন্মেরও আগে প্রতিষ্ঠিত একটি কোম্পানী যেটি পরবর্তীতে নিউ ইয়র্ক গ্যাস লাইট কোম্পানি হিসেবে এডিসনের নামে পরিচালিত হয়ে আসছে।

ম্যানহাটন জুড়ে গ্যাস লাইটের বাজারে আধিপত্য বিস্তার করে ১৮৮০ এর দশকের গোড়ার দিকে কোম্পানির নাম পরিবর্তন করে নিউ ইয়র্ক স্টিম কোং. হিসেবে গড়ে ওঠে।

ConEd-এর একজন প্রধান প্রকৌশলী ড্যান টাফ্টের বলেন, ‘১৮৮২ সালে নিউ ইয়র্ক স্টিম কোং.   যখন লোয়ার ম্যানহাটনের রাস্তায় আসল বৈদ্যুতিক ফিডার তারগুলো স্থাপন করা হয়েছিল, তখন এডিসন নতুন এই কাজের গুণমান দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন। পরবর্তীতে তিনি এই কোম্পানীর সাথে সংযুক্ত হন।’

এরপর ১৯২০ এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে যখন বেশিরভাগ কোম্পানিই নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল তখন ১৯৩৬ সালে নিউ ইয়র্ক শহরে বৈদ্যুতিক আলোর একমাত্র উৎস হিসেবে পরিচিত এই কোম্পানিটি সরকারি আওতাভুক্ত হয়।

তথ্যসূত্র- এনডি টিভি

এ সম্পর্কিত আরও খবর