নীলতিমি সমুদ্রে বাসকারী সবচেয়ে বড় আকারের জীব- একথা সবাই জানে। পৃথিবীর বৃহত্তম প্রাণী হিসেবেও একে বিবেচনা করা হয়। তবে, মিঠা পানির মধ্যে বাসকারী আকারে সবচেয়ে বড় প্রাণী কোনটি, জানেন?
আমাজনের নদীতে এক প্রজাতির মাছের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। প্রথম দেখায়, একে সাপ ভেবে ভুল করাও অবান্তর নয়। বলিভিয়ার জেলে গুইলের্মো ওটা পারুম গত ৫০ বছর ধরে আমাজন নদীতে মাছ ধরেন। আগে তিনি এখানকার স্থানীয় মাছ ধরতেন। হঠাৎ একদিন দেখতে পেলেন বিশাল আকারের একটি সাপ।
পরে বুঝতে পারলেন এটি কোনো সাপ নয়, বরং বিশাল একটা মাছ। যার প্রচলিত নাম ‘পাইচে’। তারা ভেবেছিলেন এটি খাওয়া স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হবে। কে জানে, হয়তো বিষাক্তও হতে পারে! পরে তাদের এই ধারণা দূর হয়। পাইচে ধরে ছোট ছোট টুকরো করে, তারা এলাকাবাসীকে খেয়ে দেখার জন্য দেয়। অনেকে এটা খেতে ভয় পাচি্ছল । তাই কিছু জেলে চালাকি করে ক্যাটফিশের প্রজাতি বলে চালিয়ে দেয়। তাদের জীবনে পাইচে বরকত এনেছে। বলিভিয়ায় এখন সবাই হরদম ‘পাইচে’ মাছ খাচ্ছে।
মিঠা পানির মাছের মধ্যে এটিই আকারে সবচেয়ে বিশাল বলে ধারণা করা হচ্ছে। এরা ৪ মিটার লম্বা আর ওজনে ২০০ কেজি অবধি হতে পারে। আমাজনের অববাহিকায় বছরে ৪০ কিলোমিটার গভীর অবধি পাইচের বিস্তার বেড়ে চলেছে। ধারণা করা হয়, পেরুর কোনো মাছ চাষাবাদ ভেঙ্গে এরা ছড়িয়ে পড়েছে। পেরু অঞ্চলেই মূলত এদের জন্ম।
মৎস্যজীবীদের মতে পরিবেশের উপর এই মাছ নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। আমাজনের বিশাল বিস্তৃতির মধ্যে পাইচে খুঁজে বের করার চেষ্টা করছেন তারা। পাইচে’র একটি ফুসফুসের মতো অঙ্গ রয়েছে। তাই এরা শ্বাস নেওয়ার জন্য নিয়মিত বাতাসের কাছাকাছি আসে। তারা শান্ত জল যেমন-হ্রদ এবং উপহ্রদে বাস করে। কোনো বিপদে এলে জায়গা পরিবর্তন করে।
বেনি অটোনোমাস বিশ্ববিদ্যালয়ের জলজ সম্পদ গবেষণা কেন্দ্রের পরিচালক ফেদেরিকো মোরেনো। তার মতে, পাইচে দিন দিন দেশীয় মাছদের জন্য হুমকিস্বরূপ হয়ে যাচ্ছে। আঞ্চলিক এই মাছ পানির বিশাল অংশ দখল করে থাকে। এদের আকারের মতো, ক্ষুধার পরিমাণও বিপুল। যা একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। হিংস্র প্রজাতির পাইচে’র ভয়ে অন্যান্য প্রজাতির মাছ পালিয়ে অনেক দূরে চলে যাচ্ছে। তাই পাইচে’র শিকার করা এবং এর সংখ্যাকে নিয়ন্ত্রণ করে রাখা প্রয়োজন।
জীবনকালের প্রথম বছরগুলোতে এরা ১০ কেজি হারে বাড়তে থাকে। কারণ, এরা প্রচুর পরিমাণে অন্য মাছদের খাচ্ছে। শিকারী মাছ পিরানহার মতো এদের ধারালো এবং বড় দাঁত নেই। তাতে কি হবে! ধারালো দাঁতের পিরানহাদেরও এরা গোগ্রাসে গিলে নেয়। নদীর গাছপালা, মলাস্কা- এমনকি পাখিদেরও খেয়ে ফেলে।
জীববিজ্ঞানী এবং বিশেষজ্ঞ ফার্নান্দো কারভাজাল এই প্রজাতির ব্যাপারে মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেন, আগামী ১ থেকে ২ দশকের মধ্যেই সম্ভাব্য সব এলাকায় পাইচে ছড়িয়ে যাবে। প্রকৃতির আক্রমণাত্মক প্রজাতি জীববৈচিত্রের ক্ষতি করে এবং ভারসাম্য নষ্ট করে দেয়। ক্ষতির ‘২য় বৃহত্তম কারণ’ হিসেবে বিবেচনা করা হয় আক্রমণকারী প্রজাতিকে।
অনেক জেলেই এখন পাইচে ধরে জীবনযাপন করে। এই পেশার জন্য তাদের লাইসেন্স বানাতে হয়। মাছ ধরা নিয়ে আদিবাসীদের সাথে তাদের দ্বন্দ্বও সৃষ্টি হয়। আদিবাসীদের যুক্তি, তারা কেবর সেখানকার প্রকিৃতিক সম্পদকে রক্ষা করছেন। বলিভিয়ার সরকার তাদের এই অধিকার দিয়েছেন।
জেলে এডসন সুজানো ব্রাজিলের সীমান্তের কাছে একটি ‘পাইচে-প্রসেসিং প্ল্যান্ট’ চালান। উত্তর-পূর্ব বলিভিয়ার একটি শহর রিবেরাল্টায় সেটি অবস্থিত। বেশ কিছুদিন নৌকায় করে তারা মাছ ধরে নিয়ে আসে। প্রতি মাসে প্রায় ৩০ হাজার কেজি মাচ প্রক্রিয়াকরণ করা হয়।
তথ্যসূত্র:বিবিসি