আজ থেকে প্রায় এগারো বছর আগের ঘটনা। নওয়াজেশ নলেজ সেন্টারের উদ্যোগে আয়েজিত এক পাখি পর্যবেক্ষণ সফরে (বার্ডিং ট্রিপ) কাপ্তাই ও রাঙ্গামাটি গেলাম। প্রথম দিন কাপ্তাই জাতীয় উদ্যান ও নেভি ক্যাম্পের পাখি পর্যবেক্ষণ শেষে দ্বিতীয় দিন কাপ্তাই লেকের পাখি পর্যবেক্ষণের জন্য ট্রলারযোগে কাপ্তাই থেকে রাঙ্গামাটি হয়ে বরকল উপজেলার শুভলং ঝর্ণা পর্যন্ত গেলাম। শুভলং ঝর্ণার সৌন্দর্য উপভোগ শেষে ফেরার সময় ঝর্ণার পাশে গাছের নিচে আলো-আধারিতে সাদা টুপি পড়া লাল-কালো একটি পাখি দেখেছিলাম। কিন্তু বহু চেষ্টা করেও প্রায় অন্ধকারে থাকা পাখিটির ভালো ছবি তুলতে পারিনি।
এরপর প্রায় পৌনে ছয় বছর অতিবাহিত হয়েছে। অক্টোবর ২০১৮-এ পুজোর ছুটিতে পারিবারিক ভ্রমণে ভুটানের দর্শনীয় স্থান দেখতে গেলাম। সফরের দ্বিতীয় দিন ১৬ অক্টোবর ভুটানের রাজধানী থিম্ফুর রিভার সাইড হোটেল থেকে বের হয়ে ভোরের ঠান্ডা বাতাস গায়ে লাগতেই শিউরে ওঠলাম। ক্যামেরা হাতে ওয়াং চু নদীর তীরে এগিয়ে গেলাম। নদীতীরে স্তুপ করে রাখা রাস্তা তৈরির বিটুমিনের ড্রামের উপর হঠাৎই লাল-কালো সুদর্শন পাখিটি নেমে ওর চমৎকার লেজটি অনবরত নাড়াতে লাগল। খুশিতে মনটা ভরে ওঠল। এক মূহুর্ত দেরি না করে ক্যামেরায় শাটারে ক্লিক করলাম। দেশে না হলেও প্রতিবেশি ভুটানে ওর একটা সুন্দর ছবি তুলতে পেরে বহুদিন আগের জমাটবাঁধা দুঃখের পাথরটা যেন বুক থেকে সরে গেল।
এরপর আরও পাঁচ বছর অতিবাহিত হয়েছে। গত ১৩'র থেকে ১৬ ডিসেম্বর পাঁচজনের টিমে মৌলভীবাজারের বিভিন্ন বনাঞ্চল ও অভয়ারণ্যে পাখি ও বন্যপ্রাণী পর্যবেক্ষণে বের হলাম। ভ্রমণের শেষ দিন অর্থাৎ ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসের ভোরে মাধবকুণ্ড ইকো পার্কে ঢুকলাম। পার্কের সদর দরজা থেকে প্রায় এক কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে সকাল সাতটা নাগাদ জলপ্রপাতের সামনে পৌঁছলাম। আর পৌঁছেই ঝর্ণার পাশের একটি বড় পাথরের উপরে সাদা টুপি পড়া লাল-কালো পাখিটিকে বসে থাকতে দেখলাম। প্রায় ঘন্টাদেড়েক ওখানে থেকে মন ভরে বিভিন্ন অ্যাঙ্গেলে ওর বিভিন্ন কার্যকলাপের ছবি তুললাম।
সাদা টুপি পড়া সুদর্শন ও বিরল এই পাখিটির নাম সাদাটুপি লালগির্দি। এদেশের শীতের পরিযায়ী পাখিটির ইংরেজি নাম হোয়াইট-কেপড ওয়াটার-রেডস্টার্ট বা হোয়াইট-কেপড রেডস্টার্ট। এরা মধ্য এশিয়ার (তুর্কমেনিস্তান থেকে ইন্দোচীন পর্যন্ত) আবাসিক পাখি। তবে আফগানিস্তানসহ হিমালয়ের আশেপাশের দেশগুলোতেও বাস করে। শীতে বাংলাদেশসহ ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন এলাকায় পরিযায়ী হয়। Muscicapidae গোত্রের পাখিটির বৈজ্ঞানিক নাম Phoenicurus leucocephalus.
সাদাটুপি লালগির্দি দৈর্ঘ্যে ১৮ থেকে ১৯ সেন্টিমিটার ও ওজনে ২৪ থেকে ৪২ গ্রাম। স্ত্রী ও পুরুষে পার্থক্য না থাকলেও পুরুষের মাথার টুপিটি স্ত্রীর তুলনায় কিছুটা বড় ও প্রজননকালে দেহের কালো রং খানিকটা চকচকে দেখায়। প্রাপ্তবয়ষ্ক পাখির মাথার তালু ছাড়া বাকি অংশ, মুখমণ্ডল-ঘাড়-গলা-বুক, পিঠ, ডানা ও লেজের আগা কুচকুচে কালো। দেহতল, কোমড় ও লেজ কমলা-বাদামি। ডানা-ঢাকনির নিচটা কালো ও তাতে থাকে কমলা-বাদামি ফোঁটা। চোখ, চঞ্চু, পা ও পায়ের পাতা কালো। অপ্রাপ্তবয়ষ্কগুলো দেখতে বড়দের মতোই, তবে মাথার সাদাটুপিতে কালো রেখা দেখা যায়। তাছাড়া দেহের কালো রং কুচকুচে নয়, বরং ধূসরাভ-কালো।
শীতে এদেরকে চট্টগ্রাম ও সিলেট (মাধবকুণ্ড) বিভাগের পাহাড়ি পাথুরে নদী, জলধারা ও ঝর্ণার আশেপাশে একাকি বা জোড়ায় দেখা যায়। দিবাচর ও ভূচারি পাখিগুলো পাথুরে জলধারার পাশে বা অল্প পানিতে হেঁটে হেঁটে বিভিন্ন ধরনের কীটপতঙ্গ শিকার করে খায়। অবশ্য অনেক সময় চটক-এর (Flycatcher) মতো উড়ন্ত কীটপতঙ্গও ধরে খেতে পারে। প্রয়োজনের সময় রসালো ফল ও ঘাসবীচিও খায়। ছড়ানো লেজ ও ডানা বার বার নাচায়। মুখ উপরে তুলে ‘সিইট-সিইট-সিইট----’ স্বরে ডাকে।
মে থেকে আগস্ট প্রজননকাল। এসময় আবাস এলাকার পাথরের নিচে বা শিলামুখের গর্তে শেওলা, পাতা, শুকনো ঘাস ও পশম দিয়ে বেশ গভীর ও বড় আকারের বাটির মতো বাসা বানায়। তাতে তিন থেকে পাঁচটি গাঢ় দাগযুক্ত ফ্যাকাশে নীল বা নীলচে-সবুজ ডিম পাড়ে। স্ত্রী একাই ডিমে তা দেয়। তবে কত দিনে ডিম ফোটে তা জানা যায়নি। স্ত্রী-পুরুষ মিলেমিশে ছানাদের খাওয়ায় ও যত্ন করে। আয়ুষ্কাল প্রায় চার বছর।