নিত্যদিনই এলোমেলো মাথার চুল আর ছেঁড়া জামা পড়ে গাজীপুর রেল ষ্টেশন প্লাটফর্মে ঘুরে বেড়াতে দেখা যায় এক ঝাঁক অসহায় কচিকাঁচাকে। এদের কারও মা-বাবা আছে কারো বা নেই, এদের বেড়ে উঠা অবহেলিত ও সুবিধা বঞ্চিত পরিবারে।
আমাদের সমাজের একটা বড় অংশ এদের হতে মুখ ফিরিয়ে নিলেও গাজীপুরের ১২জন তরুণ তাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। তারা গত ২ বছর ধরে এসব কচিকাঁচাদেরকে শিক্ষার আলোয় আনতে কাজ করে যাচ্ছেন, গড়ে তুলেছেন মুসাফির নামের পথ শিশুদের পাঠশালা। গত ২ বছরে প্রায় অর্ধশতাধিক শিশু এই পাঠশালা হতে শিক্ষা গ্রহন করে বিভিন্ন বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছেন।
পথশিশুদের এই পাঠশালার উদ্যোক্তা ভাওয়াল বদরে আলম সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা (সম্মান) বিভাগের শিক্ষার্থী ইমরান হোসেন। তিনি জানান, ২০১৬ সালের শেষের দিকে তিনি একদিন ট্রেনে করে সিরাজগঞ্জে যাচ্ছিলেন। এমন সময় সাত বছর বয়সী এক শিশু তাঁর পা জড়িয়ে ভিক্ষা চাচ্ছিল। তবে, তাকে ভিক্ষা না দিয়ে তিনি খাবার কিনে দিয়েছিলেন, নানা কথাবার্তার ফাঁকে সে সময় সেই শিশুটি তার কাছে পড়াশোনার ইচ্ছের কথাটাও বলেছিলেন। শিশুটির কথা তার মনে দাগ কেটে যায় তখনই। পরে তিনি গাজীপুরে ফিরে এসে তার বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধুদের সাথে পথশিশুদের পাঠশালা খোলার ব্যাপারে পরামর্শ করে কাজ শুরু করেন। এ কাজে যোগ দেয় তার আরো ১১ সহপাঠী।
পাঠদানের জন্য তিনি জয়দেবপুর রেল ষ্টেশন আঙিনাকে বেছে নেন, সেখানে খোলা আকাশের নিচে মাদুর বিছিয়ে পাঠদান করতে থাকেন পথ শিশুদের। তবে শিশুদের লেখাপড়ায় আগ্রহ তৈরি করতে তারা খাবার ও নানা ধরনের খেলনাও সরবরাহ করেন তাদের মাঝে। এই পাঠশালা চালানোর জন্য তারা বন্ধুরা নিজেদের নানা ধরনের খরচ বাঁচিয়ে অর্থযোগানের ব্যবস্থা করেন। আর শিশুদের পাঠদানের দিন হিসেবে বেছে নেন সাপ্তাহিক ছুটির দিন শুক্রবারকে।
তিনি আরও জানান, শিক্ষার আলো বঞ্চিত শিশুদের আমরা বাছাই করে আমাদের পাঠশালায় ভর্তি করি। এখানে শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষার পাশাপাশি বিনোদনমূলক শিক্ষা প্রদানের মাধ্যমে লেখাপড়ায় আগ্রহ তৈরি আমাদের মূল লক্ষ্য। এছাড়াও তাদের মৌলিক শিক্ষাটাও আমরা প্রদান করি। এক সময় যখন শিশুটির লেখাপড়ার প্রতি আগ্রহ তৈরি হয় এবং বিদ্যালয়ে ভর্তির উপযোগী হয় তখন আমরা তাদের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করিয়ে দেই। এ কাজের পাশাপাশি শিশুদের সাথে তাদের পরিবারের সদস্যদেরও শিশুদের উজ্জল ভবিষ্যতের বিষয়ে বুঝানো হয়। গত ২ বছরে এ পর্যন্ত প্রায় অর্ধশতাধিক শিশুকে এই মুসাফির পাঠশালায় শিক্ষা প্রদান করা হয়েছে।
তবে মুসাফির পাঠশালায় শিক্ষক হিসেবে এই তরুণদের দুঃখ একটাই যখন এই শিশুরা বড় হয়ে যায় তখন তারা লেখাপড়া ছেড়ে আর্থিক আয়ের পথে নেমে যায়।
এ বিষয়ে গাজীপুরের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) আবু নাসার উদ্দিন জানান, মুসাফিরের আলোয় পথশিশুরা শিক্ষায় উদ্ভাসিত হচ্ছে এটা একটা গর্বের বিষয়। তরুণ যারা এ কাজে এগিয়ে এসেছে তারা অবশ্যই কৃতিত্বের দাবীদার। প্রশাসনের পক্ষ থেকে তরুণদের সার্বিক সহযোগিতা করা হবে।