আজ থেকে প্রায় ত্রিশ বছর (১৯৯৪ সালে) আগে কাপ্তাই পাল্প উড বন বিভাগের ফরেস্টার ও খালাত ভাই মোঃ সফিকুর রহমান বলেছিলেন সেখানকার গহীন অরণ্যে বনছাগল দেখেছেন। সেবার আমি তার সঙ্গে ঘোরাঘুরি করে চশমাপড়া ও মুখপোড়া হনুমান এবং রেসাস ও খাটোলেজী বানর ছাড়া অন্য কোনো স্তন্যপায়ী প্রাণীর দেখা পাইনি। এরপর সময় গড়িয়েছে। যতবারই সফি ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হয়েছে, বনছাগলের খোঁজ নিয়েছি। তার চাকুরিকালীন জীবনে তিনি কমবেশি ২০ বার বনছাগল দেখেছেন। যখনই বনছাগল দেখেছেন বা তথ্য পেয়েছেন, আমাকে জানিয়েছেন।
২০১১ সালের এপ্রিলের মাঝামাঝি তার ফোন পেলাম। তিনি বললেন চট্টগ্রামের ফটিকছড়ির দুর্গম পাহাড়ি অরণ্যে কিছু উপজাতীয় লোক দু’টি বনছাগলের দেখা পেয়েছিল। খবর শুনে তিনিও রওয়ানা হয়ে যান। উপজাতীয়রা ভোররাতে পাহাড়ের নিচের দিকে বিচরণরত একটি বনছাগলকে তাড়া করেছিল। তাদের তাড়া খেয়ে সেটি কিছুটা আহত হয়েছিল। তিনি আমাকে সেটার ছবি পাঠিয়েছিলেন।
একদা চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের পাহাড়ি মিশ্র চিরসবুজ বনে অবাধে বিচরণ করত বনছাগল। কিন্তু ক্রমবর্ধমান শিকার ও বনভূমি উজাড় এদেরকে করল বিপন্ন; সংখ্যা মারাত্মকভাবে হ্রাস পেল। গত তিন-চার দশকে এদের আবাস এলাকার প্রায় অর্ধেকই উজাড় হয়ে গেছে। মৌলভীবাজারের একটি ব্যক্তিগত চিড়িয়াখানা থেকে ২০১১ সালে দু’টি বনছাগল উদ্ধার করে ডুলাহাজরা সাফারি পার্কে রাখা হয়েছিল। খবর পেয়ে ১৫ই জুলাই ওখানে গেলাম ও ছবি তুললাম। যদিও এর আগে ২০০৬ সালে থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংককের রাজকীয় ডুসিত চিড়িয়াখানায় সর্বপ্রথম বনছাগল দেখি ও ছবি তুলি। কিন্তু ২০১১ সালে কক্সবাজারের ডুলা হাজরারস্থ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্কে প্রথম কোনো বন ছাগলকে স্পর্শ করলাম এবং তার বুনো স্বভাবের সঙ্গে পরিচিত হলাম। সে থেকেই চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামের গহীনে মাঝে-মধ্যে ওদেরকে দেখার তথ্য পেতে থাকলাম।
বান্দরবানের প্রত্যন্ত সাঙ্গু-মাতামুহুরী উপত্যকার স্থানীয় ম্রো বা মুড়ংদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন এবং সেখানকার বন্যপ্রাণী ও তাদের আবাস সংরক্ষণে নিয়োজিত ‘ক্রিয়েটিভ কনজারভেশন অ্যালায়েন্স’ (সিসিএ)। ২০১৭ সালে তারা ক্যামেরা ট্র্যাপিংয়ের মাধ্যমে প্রথম বান্দরবানে বনছাগলের দেখা যান। পরবর্তীতে ২০২০ সালে আলিকদম উপজেলার কুরুকপাতা ইউনিয়নে অবস্থিত মাতামুহুরি সংরক্ষিত বনের দুর্গম ইয়ংনং পাড়ায় গিয়ে সিসিএ-এর প্যারাবায়োলজিস্টারা মুড়ং ভাষায় ‘নিয়া’ নামে একটি বিরল তৃণভোজী বাচ্চা প্রাণীকে বাঁধা অবস্থায় দেখেন। মুড়ংরা বাচ্চাটিকে বিক্রি করতে চাচ্ছিল। সিসিএ-এর সদস্যরা এতে বাধা দেয় ও মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা শাহরিয়ার সিজার রহমানের শরণাপন্ন হয়। পরবর্তীতে তারা বন বিভাগের সহায়তায় বাচ্চাটি উদ্ধার করেন।
এ বছরের আগস্টে মৌলভীবাজারের রাজকান্দি সংরক্ষিত বনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক প্রাণিবিজ্ঞানী স্নেহাস্পদ মুনতাসি আকাশের এক গবেষণায় ব্যবহৃত ক্যামেরা ট্র্যাপে বাচ্চাসহ বনছাগলের ছবি উঠে। গবেষণাটি তিনি বাংলাদেশ বন বিভাগের সুফল স্মল ইনোভেশন গ্রান্ট-এর মাধ্যমে সম্পন্ন করেন।
ছাব্বিশ ডিসেম্বর ২০২৩-এ সুনামগঞ্জের বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার শক্তিয়ারখলা বনবিটের ঢুলারা বিজিবি ক্যাম্প এলাকা থেকে স্থানীয় জনগণের সহযোগিতায় বিজিবি সদস্যরা লালচে-বাদামি বর্ণের একটি স্তন্যপায়ী প্রাণী উদ্ধার করেন। এরপর তারা প্রাণীটিকে সুনামগঞ্জ বনবিভাগের কর্মকর্তাদের কাছে হস্তান্তর করেন। সুনামগঞ্জ বন বিভাগ এটিকে ট্রাকযোগে সিলেটের বিভাগীয় কার্যালয়ে পাঠায়। সেখান থেকে সে রাতেই মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গলে অবস্থিত লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের জানকিছড়া বন্যপ্রাণী উদ্ধার কেন্দ্রে নিয়ে আসা হয়।
পরেরদিন দুপুরে প্রাণীটিকে শ্রীমঙ্গলের বন্যপ্রাণী উদ্ধারকারী সংগঠন ‘স্ট্যান্ড ফর আওয়ার অ্যান্ডেনজারড ওয়াইল্ডলাইফ (সিউ)’-এর সদস্যদের সহযোগিতায় মৌলভীবাজার বনবিভাগ কমলগঞ্জের রাজকান্দি সংরক্ষিত বনে ছাড়ার জন্য নিয়ে যান। কিন্তু অনিবার্য কারণবশত এটিকে ওখানে না ছেড়ে জানকিছড়ায় ফেরত আনা হয়। সংশ্লিষ্ট অনেকেই ধারণা করেন যে, কোনো অদৃশ্য হাতের ইশারায় বিরল প্রাণীটিকে সাফারি পার্কে পাঠানোর চেষ্টা চলছিল। কিন্তু, সিউ-এর সদস্য ও মৌলভীবাজারের বন বিভাগের কর্মকর্তাদের অক্লান্ত প্রচেষ্টায় সন্ধ্যার দিকে এটিকে পুনরায় রাজকান্দি সংরক্ষিত বনে নিয়ে ছেড়ে দেয়া হয়। আশা করা যায় প্রাণীটি ওখানে টিকে থাকবে।
এতক্ষণ যে বনছাগলের গল্পগুলো বললাম সে হলো এদেশের একটি বিরল ও বিপন্ন প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী। বনছাগল বা পাহাড়ি ছাগল নামেই পরিচিত। ইংরেজি নাম সেরাও (Serow), রেড সেরাও (Red Serow) বা মেইনল্যান্ড সেরাও (Mainland Serow)। বোভিডি (Bovidae) অর্থাৎ গরু গোত্রের প্রাণীটির বৈজ্ঞানিক নাম Capricornis rubidus (ক্যাপ্রিকর্নিস রুবিডাস)। বাংলাদেশ ছাড়াও দক্ষিণ ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়া বিভিন্ন দেশে বনছাগলের দেখা মেলে।
আকার ও ওজনে বনছাগল গৃহপালিত ছাগলের থেকে অনেক বড়। লম্বাটে ধরনের এই ছাগলের মাথা বড়, মুখ লম্বাটে ও ঘাড় মোটা। খাড়া ও ছুঁচালো কান দুটো অনেকটা গাধার কানের মতো। কালো রঙের পেছন দিকে বাঁকানো শিং দুটো লম্বায় ২৩ থেকে ২৫ সেন্টিমিটার, যার আগা চোখা। আগাবাদে শিংয়ের বাকি অংশে বলয় বা রিং-এর মতো থাকে। শক্তপোক্ত পা। স্ত্রী-পুরুষ দেখতে অনেকটা একই রকম। দৈর্ঘ্য ১.০ থেকে ১.১ মিটার। ওজনে পুরুষ ৭০ থেকে ৭৫ ও স্ত্রী ৫০ থেকে ৫৫ কেজি। দেহের লালচে-বাদামি পশমগুলো রুক্ষ ও লম্বা। লেজ দেশি ছাগলের মতোই ছোট, তবে রোমশ। চোখের চারদিক ও খুরের উপরের পশম সাদাটে। খুর কালো।
এরা ঘন ঘাস-লতাপাতাপূর্ণ খাড়া পাথুরে পাহাড়ে লোকচক্ষুর অন্তরালে বাস করে। ভূপৃষ্ঠের ২৭০০ মিটার উঁচুতেও বাস করতে পারে। পাহাড়ের খাড়া ঢালে একাকী বা ছোট দলে ঘুরে বেড়ায়। এদের চলাচলের পথ এতটাই সরু যে সরীসৃপ ছাড়া অন্য কোন প্রাণীর পক্ষে চলাচল করা কষ্টকর। ছাগলের মতো এরাও তৃণভোজী ও রোমন্থক প্রাণী। সচরাচর সন্ধ্যা ও ভোররাতে বিচরণ করে। সাধারণত ঘাস, বাঁশের কচি পাতা ও পাথরের গায়ে জন্মানো শেওলা খায়। দিনে পাহাড়ের চূড়ার বড় পাথরের আড়ালে বা গুহায় বিশ্রাম নেয় ও জাবর কাটে। কোনো কোনো সময় পাহাড়ের চূড়ার এমন জায়গায় বসে থাকে যেখান থেকে এদের সীমানার চতুর্দিকে চোখ রেখে বিপদ আঁচ করা যায়।
অক্টোবর থেকে নভেম্বর এদের প্রজনন মৌসুম। বনছাগী ৮ থেকে ৯ মাস গর্ভধারণের পর পাহাড়ের গুহা বা পাথরের ফাঁকে একটি বাচ্চা প্রসব করে। এদের আয়ুষ্কাল সম্পর্কে তেমন কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। বর্তমানে এদেশে এদের সংখ্যা কত তা জানা যায়নি। তবে সংখ্যা যে নিতান্তই কম তা সহজেই অনুমেয়। কাজেই এদের সংরক্ষণে এখনই সঠিক ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে অচিয়েই বিপন্ন প্রাণীটি বিলুপ্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
গত ২৭ ডিসেম্বর মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার রাজকান্দি সংরক্ষিত বনাঞ্চলে বনছাগলটিকে ছেড়ে দেয়া হয়। যদিও রাজকান্দি সংরক্ষিত এলাকা। কিন্তু বাস্তবে এর ভিতরে রয়েছে মানুষের অবাধ যাতায়াত। এখানে পানের বরজ, লেবু বাগান ইত্যাদি রয়েছে। কাজেই পুরো বনটিকেই সত্যিকারের সংরক্ষণের আওতায় আনার প্রয়োজনীয়তা বোধ করছি। ছাগলের মাংসের লোভে যেন বনছাগল হারিয়ে না যায়। সেজন্য সরকার, বন বিভাগ ও জনগণ সকলকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। তবেই প্রকৃতিতে বনছাগলসহ অন্যান্য বন্যপ্রাণী টিকে থাকবে। আমাদের প্রকৃতি হবে সমৃদ্ধ, যা প্রকৃত অর্থে আমাদেরকেই সমৃদ্ধ করবে।
E-mail: aminoor69@bsmrau.edu.bd, aminoor69@yahoo.com