প্লাস্টিক; পরিবেশ দূষণে অন্যতম মাথাব্যথার কারণ। হাজার চেষ্টা করেও বন্ধ করা যাচ্ছে না প্লাস্টিকের ব্যবহার। বরং দিনদিন বেড়ে যাচ্ছে এর ব্যবহার। দূষণ এতটাই বেড়েছে যে বিজ্ঞানীরা সমুদ্রেও পেয়েছেন প্লাস্টিক দূষণ। যার নাম ‘গ্রেট প্যাসিফিক গারবেজ প্যাচ’।
যার আবিষ্কারক ক্যাপ্টন চার্লস মুর। ১৯৯৭ সাল চার্লস মুর হাওয়াই থেকে ক্যালিফোর্নিয়া যাওয়ার পথে সমুদ্রে প্লাস্টিকের একটি বিশাল স্রোত দেখতে পান। সেটাই ‘গ্রেট প্যাসিফিক গারবেজ প্যাচ’। মধ্য-উত্তর প্রশান্ত মহাসাগর থেকে এক হাজার মাইলও দূরে নয়। আর এই আর্বজনার স্তুপ দেখে সমুদ্র বিজ্ঞানী চার্লস মুর ও জাহাজের ক্যাপ্টেন বিভ্রান্ত হন। দূর থেকে বিষয়টা অতটা বোঝাও যাচ্ছিল না।
চার্লস মুর বলেন, ‘বিষয়টা এমন না যে হ্যানসেল ও গ্রেটারের রূপকথা গল্পের মতো আমাকে কেউ বাড়ি নিয়ে যাচ্ছে। তবে দূর থেকে দেখে ভেবেছি- ‘এটা বড় কিছু হতে যাচ্ছে’।
এর দুই বছর পর গবেষণা ও মডেল তৈরি করে চার্লস মুর আবার অনুসন্ধানে বেরিয়ে পড়েন। তিনি বলেন, ‘এরপর আমরা দেখি একটি অসাধারণ ব্যাপার।’ সমুদ্রের পৃষ্ঠের নমুনা করার জন্য একটি নেট সিস্টেম ব্যবহার করে, তিনি সাগরে ভাসমান প্লাঙ্কটনের চেয়ে ছয় গুণ বেশি প্লাস্টিক খুঁজে পান।
চার্লস মুর বিশ্বজুড়ে বিশাল পাঁচটি আবর্জনা প্যাচ আবিষ্কার করেন। যেগুলো ঘূর্ণায়মান সমুদ্রের স্রোত দ্বারা সৃষ্ট। যা গাইরস নামে পরিচিত, ঘূর্ণিয়মান আবর্জনা প্লাস্টিক চুষে তৈরি হয়। এ গুলো এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় স্থানান্তর হয়।
আবিষ্কারের পর থেকে, ‘গ্রেট প্যাসিফিক গারবেজ প্যাচ’ গণমাধ্যমে প্লাস্টিকের ভাসমান ভর হিসাবে পরিচিত হয়েছে। একে আবর্জনার দ্বীপও বলা হয়েছে।
যদিও মুর দাবি করেন, "এটি আবর্জনার পাহাড় বা আবর্জনার স্তুপ ছিল না। এমনকি আবর্জনার প্যাচও ছিল না। আবর্জনার ফলে সমুদ্রকে একটি ঘোলাটে স্যুপের মতো দেখাচ্ছিল। যা বিভিন্ন আকারের প্লাস্টিক দিয়ে তৈরি।
তিনি আরও বলেন, এই প্যাচটির কল্পনা করা কঠিন। গ্রেট প্যাসিফিক গারবেজ প্যাচের ছবি নেই’।
মুর বলেন, স্যাটেলাইট, ড্রোন এবং গুগল আর্থ মোবাইল দিয়ে এই আবর্জনার প্যাচের একটি ওভারভিউ ছবি তোলার জন্য এখনও লড়াই চলছে।
‘গ্রেট প্যাসিফিক গারবেজ প্যাচ’নিয়ে আবিষ্কারের ২৫ বছর পার হয়েছে। আবর্জনার প্যাচ সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান আরও গভীর হয়েছে। কেউ কেউ সেগুলো পরিমাপ করার এবং পরিষ্কার করার চেষ্টা করেছে। কিন্তু এই আবর্জনা প্যাচগুলো সম্পর্কে এখনও অনেক ভুল ধারণা বিদ্যমান। এই ভুল ধারণা দূর করতে খুব কম মানুষই উদ্যোগ নিতে পারবে।
‘গ্রেট প্যাসিফিক গারবেজ প্যাচ’-এর দীর্ঘ এত বড় যে, এটাকে প্রায়ই ল্যান্ডমাস হিসেবে কল্পনা করা হয়। ২০১৮ সালের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ১ দশমিক ৬ মিলিয়ন বর্গ কিমি এলাকায় অন্তত ৭৯ হাজার টন প্লাস্টিক সমুদ্রে ভাসছে। যা পূর্বে রিপোর্ট করা থেকে চার থেকে ১৬ গুণ বেশি। এই আবর্জনার স্তুপের আয়তন টেক্সাসের আয়তনের দ্বিগুণ বা ফ্রান্সের আয়তনের তিনগুণ।
এদিকে ‘গ্রেট প্যাসিফিক গারবেজ প্যাচ’কে বিশ্বের প্লাস্টিক সমস্যার বড় প্রোফাইল হিসেবে উপস্থাপন করা হচ্ছে। এটিকে ঘিরে পৌরাণিক কাহিনী গড়ে উঠেছে। গুগলে ছবি সার্চ দিলে ভুল ছবিও দেখানো হয়।
কিন্তু, বাস্তবতা হচ্ছে- সমুদ্রে চলাচল করা জাহাজগুলো ‘গ্রেট প্যাসিফিক গারবেজ প্যাচ’এর ভেতরে এবং বাইরে যেতে পারে। নাবিকরা আবর্জনার প্যাচের মধ্য দিয়ে যেতে পারে। বিভিন্ন গবেষণা বলছে, ‘গ্রেট প্যাসিফিক গারবেজ প্যাচ’এ পাওয়া আবর্জনার মোট ভর ৭৫ শতাংশ, পানিতে ভাসা ৫ সেমি (১.০ ইঞ্চি) কোন বস্তুকে ধ্বংস করতে পারে।
যুক্তরাজ্যের ম্যানচেস্টার মেট্রোপলিটান ইউনিভার্সিটির পরিবেশ ও প্রযুক্তির অধ্যাপক ওয়াল্টার লিল বলেন, ‘সমস্যাটি হলো যে বেশিরভাগ মানুষ এই সমস্যাটি সম্পর্কে সচেতন নয়, তাই তারা সমাধান নিয়ে কাজ করতে তাগিদ অনুভব করেন না। এই সমস্যা নিয়ে না ভাবলে আবর্জনার প্যাচ আরও জমা হবে।
‘আসলে, আমরা কথা বলার সাথে সাথে এগুলো আরও বড় হচ্ছে,’ লিল বলেছেন। ২০২১ সালের এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, বর্তমান প্রবণতার ওপর ভিত্তি করে এর বৃদ্ধির হার আড়াই শতাংশ।
সমুদ্রের প্লাস্টিক দূষণ কচ্ছপসহ বিভিন্ন সামুদ্রিক প্রাণী থেকে শুরু করে পাখি এবং মাছের খাদ্য ঝুঁকি তৈরি করছে। কারণ বিভিন্ন জলজ প্রাণী এবং মাছেরা হামেশাই এইসব প্লাস্টিককে নিজেদের খাবার ভেবে ভুল করে।
সমস্যাটি এতই বিস্তৃত যে এটি ‘প্লাস্টিস্ফিয়ার (প্লাস্টিকভীতি)’-এর জন্ম দিয়েছে। যদি এই শব্দটি বাস্তুতন্ত্রের জন্য ব্যবহৃত একটি শব্দ। যা মানুষের তৈরি প্লাস্টিকের পরিবেশে বসবাসের জন্য মারাত্মক ক্ষতি করছে।
সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, গবেষকরা জিপিজিপি থেকে মাছ ধরা প্রায় ১০০ টুকরো প্লাস্টিক থেকে ৮৮৪টি অমেরুদণ্ডী প্রাণী শনাক্ত করেছেন। সমুদ্রের স্রোত কিছু প্রজাতিকে তাদের প্রাকৃতিক বসবাসস্থল থেকে ভাসিয়ে নিয়ে প্লাস্টিকের প্যাচে বসবাস করতে নিয়ে যায়। সেখানে অদ্ভুত মিউটেশন বা জৈব ঝুঁকি তৈরি হয়।
লিল সম্প্রতি দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরী ফিজি, দ্য কুক দ্বীপপুঞ্জ এবং ভানুয়াতুসহ কিছু দ্বীপ রাষ্ট্র ভ্রমণ করেছেন। এই দেশগুলোতে প্লাস্টিক উৎপাদন হয় না। তবে কিছু প্লাস্টিক উপকূলে যাওয়ার পথ খুঁজে পায়। পর্যটনের কারণে এ প্রভাব পড়ে বলে যোগ করেন তিনি।
সমুদ্র দূষণ রোধে দেশগুলো সরকারি পদক্ষেপের অভাব রয়েছে বলে মনে করেন যুক্তরাজ্যের ম্যানচেস্টার মেট্রোপলিটান ইউনিভার্সিটির পরিবেশ ও প্রযুক্তির অধ্যাপক ওয়াল্টার লিল।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, প্লাস্টিক উৎপাদন হ্রাস সমুদ্রে আবর্জনার প্যাচ কমাতে পারে।
প্লাস্টিক দূষণ রোধে ‘সিলভার লাইনিং’ চুক্তি, ২০২৪ সালে যা আলোচনায় আসছে। এতে বিশ্বের ১৭৫ টি দেশ প্লাস্টিক দূষণ রোধে একটি আইনত বাধ্যতামূলক সাক্ষর করবে। যাতে নতুন করে প্লাস্টিক সমুদ্রের আবর্জনা প্যাচগুলোতে পৌঁছাতে না পারে।
সূত্র: বিবিসি